বোরোতে কৃষকের আয় নেই

লাভজনক করতে না পারলে কৃষির অগ্রগতি ধরে রাখা কঠিন হবে

ধান উৎপাদনে বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্বে প্রশংসিত হয়ে এলেও উৎপাদক তথা কৃষক সবসময়ই বঞ্চিত থাকছেন। ধানের সবচেয়ে বড় জোগান আসে বোরো মৌসুম থেকে, কিন্তু সেখানেই কৃষক লোকসান গুনছেন। এর পেছনে কারণ হিসেবে সামনে আসছে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়টি। সেচ সার বেশি দিতে হওয়ায় অন্যান্য ধান থেকে বোরো উৎপাদনের ব্যয় অপেক্ষাকৃত বেশি। আবার বোরো বেশি হওয়ায় সময়ে বাজারে ধানের দামও থাকে কম। ফলে ব্যয় মিটিয়ে লাভ করা কৃষকের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়ে। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণার বরাত দিয়ে বণিক বার্তায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, প্রতি হেক্টর বোরো আবাদে কৃষকের এখন ক্ষতি হচ্ছে প্রায় হাজার ৩৫ টাকা। তবে আউশ আমনে লাভের মুখ দেখছেন কৃষক। প্রতি হেক্টর আউশ আবাদে কৃষকের মুনাফা হচ্ছে প্রায় ১০ হাজার ৭১০ টাকা। অন্যদিকে আমন ধানে মুনাফা হচ্ছে হাজার ৬৯০ টাকা। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, কৃষক কেন লোকসান দিয়ে প্রতি বছর বোরো ধান উৎপাদন করছেন? সাবেক কৃষি সচিব যথার্থই বলেছেন, বোরোতে সেচ শ্রমিকের খরচ অত্যধিক বেশি হওয়ার কারণে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমানো যাচ্ছে না। পাশাপাশি অন্যান্য খরচ বৃদ্ধি তো আছেই। মূলত তিনটি কারণে বোরো ধান থেকে কৃষক সরতে পারছেন না। প্রথম কারণটি হচ্ছে, নিজের নিত্য চালের চাহিদা মেটাতে ধান উৎপাদন ধরে রাখতে চান কৃষক। শস্য আবাদ করলে স্বল্প সময়ে বাড়তি চাল উৎপাদন করা সম্ভব। দ্বিতীয়ত, ধান বিক্রি করে নিশ্চিত নগদ অর্থ ঘরে আসে। কেজিপ্রতি ধানের দামে কিন্তু খুব বেশি পার্থক্য হয় না। তৃতীয় কারণটি হলো, বেশির ভাগ কৃষকের দ্বিতীয় কোনো অপশন নেই। বিশেষ করে হাওড় অঞ্চলের কৃষকরা মূলত একটি ধান চাষ করতে পারেন।

আজ প্রযুক্তির বহু উন্নতি হয়েছে, চাষীর কাছে নানা প্রযুক্তি সুবিধে সরকার পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু চাষীকে আত্মনির্ভর হতে দেয়া হয়নি। কম খরচে উন্নত মানের ফসল ফলিয়ে বাজারে চড়া দামে বিক্রির ক্ষমতাএটাই চাষে স্বনির্ভরতার উপায়। প্রযুক্তি, বিনিয়োগ, বিপণন, এই সবকিছুর উদ্দেশ্য শেষ পর্যন্ত উৎপাদন ব্যয় কমানো এবং বাজারে লাভ বাড়ানো। সরকারি সহায়তার লক্ষ্যও হতে হবে চাষীর সঙ্গে বাজারের মজবুত বোঝাপড়া। তাকে নতুন প্রযুক্তি, নতুন বিপণন ব্যবস্থা, নতুন বাজারের খোঁজ দেয়া। সরকারি ভর্তুকির ভরসায় উৎপাদন আর সরকারকেই বিক্রি, এটাই সরকারি সহায়তার আসল ছবি। বিশেষত ছোট চাষীর সরকারনির্ভরতা বেশি হওয়ায় চক্রের বাইরে বেরোতে পারছেন না। পেশা হিসেবে কৃষি অর্থহীন হয়ে পড়ছে। অথচ সরকারের কাজ বিস্তর। উন্নত কৃষি খামার তৈরি ছাড়াও কৃষিকে নিবিড়ভাবে যুক্ত করতে হবে খাদ্যশৃঙ্খলের সঙ্গে; ক্ষেতখামারের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে ফসলের প্রক্রিয়াকরণ, খাদ্যগুণ বৃদ্ধি, বিপণনের পরিকাঠামো তৈরি।

ধান উৎপাদনকারী দেশ ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ভিয়েতনামের তুলনায় বাংলাদেশে প্রতি কেজি ধানের উৎপাদন খরচ ২০-৩০ শতাংশ বেশি। এর পেছনে কারণ অদক্ষ সেচ ব্যবস্থাপনা, পেস্টিসাইডের লাগামহীন দাম অতিরিক্ত ব্যবহার, ধানচাষ যান্ত্রিকীকরণ না হওয়া, রাসায়নিক সারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, কৃষি শ্রমিকের অপ্রাপ্যতা ক্রমবর্ধমান মজুরি এবং কম ফলন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে সেচ ব্যয় এখনো ধান উৎপাদন ব্যয়ের প্রায় ২৮-৩০ শতাংশ। অথচ ভারতের মরুময় এলাকা পাঞ্জাবে সেচ ব্যয় মোট উৎপাদন ব্যয়ের মাত্র ১৩ শতাংশ, যা থাইল্যান্ডে শতাংশ ভিয়েতনামে মাত্র শতাংশ। আমাদের দেশে যে সিংহভাগ এলাকায় ডিজেলচালিত সেচযন্ত্র ব্যবহার হয়, সেখানে কোনো ভর্তুকি নেই। অথচ সেচে বিদ্যুৎ বিলের ওপর ২৫ শতাংশ ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। কৃষককে যৌক্তিক মূল্য ভোক্তাকে কম দামে চাল জোগাতে হলে ধান উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনার বিকল্প নেই।

ন্যায্য দাম না পাওয়ায় কৃষক গত তিন বছর লোকসান দিয়েছেন। তার পরও তারা চাষ অব্যাহত রেখেছেন এবং ধান উৎপাদনে বাংলাদেশকে তৃতীয় স্থানে নিয়ে এসেছেন। আমরা বিশ্বাস করি, কৃষক প্রয়োজনীয় সমর্থন সহযোগিতা পেলে ধান উৎপাদন আরো বাড়াতে সক্ষম হবেন। এজন্য কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করাসহ পরিবহন বাজারজাতের প্রতিটি স্তরে নজরদারি বাড়াতে হবে। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সময় কৃষি এবং কৃষকই প্রধান ভরসা। করোনা সংকটের প্রেক্ষাপটে বিশ্ব খাদ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের আশঙ্কা করছে। বাংলাদেশ যদি সেই সংকট থেকে দূরে থাকতে পারে, তবে সেটা হবে বড় সাফল্য।

চাল রফতানিকারক দেশ ভারতে ধান চাষ লাভজনক করার জন্য উপকরণ ভর্তুকি, বিনা সুদে ঋণ সহায়তা ছাড়াও মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস (এমএসপি) নিশ্চিত করা হচ্ছে। সে দেশে ধানচাষীর ন্যায্যমূল্য ভোক্তার জন্য যৌক্তিক বাজারদর নিয়ন্ত্রণের জন্য শক্তিশালী এগ্রিকালচার প্রাইস কমিশন আছে। বাংলাদেশে কৃষি খাতে ভর্তুকি দিয়েও কৃষকের মুখে হাসি আনা যাচ্ছে না। কৃষক ভোক্তার স্বার্থ সমন্বয়ের জন্য শক্তিশালী প্রাইস কমিশন গঠন করতে হবে। সমস্যা সমাধানে নীতিনির্ধারক, কৃষক, প্রযুক্তিবিদ, আমদানিকারক, মিলার, উপকরণ ব্যবসায়ী সবাইকে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে। কৃষিজমির দাম ইজারামূল্য বাড়ছে। বর্গামূল্য সেচের মূল্য বাড়ছে। বীজের মূল্য সার-কীটনাশকের দাম বাড়ছে। মজুরির দামও বাড়ছে। জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। শুধু কৃষকের ধানের দাম কমছে। এক্ষেত্রে ধানের দাম না বাড়িয়ে ভোক্তাকে সন্তুষ্ট রাখতে হলে সেচে ভর্তুকি বাড়ানো এবং যান্ত্রিকীকরণ বৃদ্ধির মাধ্যমে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে হবে। কৃষিকে লাভজনক করতে না পারলে, কৃষক ধান উৎপাদন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। সর্বোপরি কৃষিকে লাভজনক না করতে পারলে কৃষির অগ্রগতি খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়বে।  

বাংলাদেশে অন্যান্য পণ্যের দাম যে হারে বেড়েছে, সে হারে কৃষিপণ্যের দাম বাড়েনি। শহরে বাড়লেও কৃষক পর্যায়ে দর পায় না। খুচরা ব্যবসায়ী, পাইকারি ব্যবসায়ী, রফতানিকারক, চালকল মালিক, পথে পথে ফড়িয়া বেপারিরা মাত্রাতিরিক্ত লাভ করেন। ট্রাকওয়ালা বেশি ভাড়া নেন, পথে পথে চাঁদা দিতে হয়, গুদাম মালিক ভাড়া বেশি নেন। সরবরাহ চেইনগুলো সুষ্ঠু সুন্দর করার মাধ্যমে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয়ের ব্যবস্থা নিতে হবে। কৃষকদের মূলধন সংকট দূর করার জন্য কৃষিঋণ যেন প্রান্তিক কৃষকের হাতেই পৌঁছে, সেজন্য ডিজিটাল ব্যাংকিং সিস্টেম ব্যবহার করতে হবে এবং প্রকৃত কৃষক বাছাইয়ে বিস্তৃত অন্তর্ভুক্তিমূলক কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। সেচ, সার কৃষিযন্ত্র আমদানিতে ভর্তুকির সুফল যেন প্রান্তিক কৃষকরা পান, সেজন্য মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য দূর করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন