সুরের আকাশে বিচিত্র ভুবনে আর দেখা যাবে না এন্ড্রু কিশোরকে

অনজন কুমার রায়

প্রিয় মানুষগুলোর চির বিদায়ে ধীরে ধীরে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ভীতটুকু ছোট হয়ে আসছে। যার গানগুলো মনকে ছুঁয়ে যেত তার কণ্ঠটি আর জাগরুক হয়ে থাকবে না। স্মৃতির পাতা স্মৃতিময় কাব্যের ধারায় আরো প্রসারিত হলো! চিরকাল নিস্তব্ধতায় রয়ে যাবে তার নাম। কঠিন সময়ের মাঝে যার গানগুলো মনকে প্রশান্তি এনে দিতো, যার গানগুলো অসীম মমত্ববোধে বারবার শোনার চেষ্টা করতাম তিনি আমাদের মাঝ থেকে চির বিদায় নিয়ে চলে গেলেন! সংস্কৃতি অঙ্গন থেকে আরও এক নক্ষত্রের চলে যাওয়া মানে বিষণ্ন মনকে আরও বিষণ্নতায় নিমজ্জিত করে রাখা!

বরাবরই আমি গানপ্রিয় মানুষ। এন্ড্রু কিশোরের গানগুলোর মাঝে এক ধরনের ভালা লাগার নান্দনিক অনুভূতি কাজ করতো। তাই, ছোটবেলায় স্কুল থেকে ফিরে বিকেলবেলা ঘুমাতে যাওয়ার আগে 'রেডিও' নামক যন্ত্রটা সাথে রাখতাম। সকালবেলায় বাংলাদেশ বেতারে ‘অনুরোধের আসর গানের ডালি’ আয়োজনেও তার শ্রুতি মধুর কণ্ঠে গান শোনার অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। কোনদিন তার শুনতে না পেলে মনে আনন্দে কোথায় যেন একটু ছেঁদ পড়তো। এখন আর রেডিও নেই। অনেক দিন ধরে সেই মধুমাখা কণ্ঠের গানও শোনা হয়নি। ছোটবেলার তালটুকু কখন যেন হারিয়ে ফেলেছি নিঃশব্দতায়।

এন্ড্রু কিশোর ১৯৫৫ সালের নভেম্বর রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। মা মিনু বাড়ৈ এবং বাবা ক্ষিতীশ চন্দ্র বাড়ৈ। মা মিনু বাড়ৈর গানের প্রিয় শিল্পী ছিলেন কিশোর কুমার। তাই মায়ের কোলে জন্ম নেওয়া ফুটফুটে শিশুটির নামকরণ করা হয় প্রিয় শিল্পীর নামে অর্থাৎ কিশোর। মূল নাম এন্ড্রু কিশোর কুমার বাড়ৈ। পরবর্তী সময়ে সঙ্গীত জগতে এন্ড্রু কিশোর নামেই পরিচিত লাভ করেন। মা স্কুল শিক্ষিকা ছিলেন বিধায় মার সাথেই স্কুলে আসা যাওয়া। তারপর কলেজ জীবন রাজশাহীতে পড়াশুনা চালিয়ে যান। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন নিজ শহর অর্থাৎ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন। রাজশাহী সিটি কলেজে পড়ার সময়ই গান গেয়ে সেখানে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ধীরে ধীরে নিজের জীবনকে সঙ্গীতের সাথে নিবদ্ধ করেন। মহিমান্বিত হয়ে ওঠেন নিজের গানগুলো গেয়ে। সঙ্গীত বিষয়ে হাতে খড়ি শুরু হয় রাজশাহীর আব্দুল আজিজ বাচ্চুর কাছে।  

মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে রাজশাহী বেতারে তালিকাভুক্ত শিল্পী হন। তখন থেকেই বিভিন্ন ধরনের গান গেয়ে যান। প্রকৃতপক্ষে সঙ্গীতের প্রতি মোহের নিবিষ্টতাই এন্ড্রু কিশোরের শিল্পীসত্ত্বার গুণাগুণ প্রকাশের ঐশ্বর্য বজায় থাকে। শিল্পীসত্ত্বার মাঝে নান্দনিকতার মিশেল ঘটিয়েছেন বলেই বিভিন্ন সময় রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল গীতি, দেশাত্মবোধক, লোকগীতি আধুনিক গান গেয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন নিজেকে!

চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৭ সালে দেশ বরেণ্য সুরস্রষ্টা ও সঙ্গীত পরিচালক আলম খানের হাতে ধরে ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’ গানের মধ্য দিয়ে। তবে প্রথম দর্শক সকল যে গান শুনে জনপ্রিয়তা লাভ করেন সেটি হল ‘এক চোর যায় চলে’। সেখানে তার ক্যারিয়ারের বিশেষ মুহূর্তে মোড় ঘুরিয়ে দেয়। আধুনিক ও কালজয়ী অনেক গান গেয়ে বালাদেশের গানের জগৎ সমৃদ্ধ করে রেখেছেন। চলচ্চিত্রে প্রায় ১৫ হাজার গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। তিনি 'প্লেব্যাক সম্রাট' হিসেবেই পরিচিতি লাভ করে।

কতটুকু শিল্পীসত্ত্বার গুণাগুণ থাকলে একজন শিল্পী সব ধরনের গান গেয়ে যেতে পারেন, তা ওনার কাছ থেকে বুঝতে পারি। সবক্ষেত্রেই বিচরণ করেন অতি সহজেই। রোমান্টিক থেকে বেদনার সব ধরনের গানের ক্ষেত্রেই বিচিত্রতায় ভরপুর হয়ে উঠে তার কণ্ঠস্বর। সেজন্যই তাঁর মধুমাখা কন্ঠের গান ‘ওগো বিদেশিনী তোমার চেরিফুল নাও’ কিংবা ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে, রইব না আর বেশিদিন তোদের মাঝারে’ গানগুলো আজও মনকে মাতিয়ে রাখে।

বৈচিত্র্যের আভাস দেখতে পাওয়া যায় রোমান্টিক গানের মাঝেও যার ফলে শ্রোতাদের মন কেড়ে নেয় অতি সহজেই। বিশেষ করে গ্রাম বাংলার মানুষদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠার একটি অন্যতম কারণ প্রেমের গানে রোমান্সের অবয়ব। তাইতো গ্রাম বাংলায় ‘কী যাদু করিলা পিরিতি শিখাইলা, থাকতে পারি না ঘরেতে’ গানটি সমভাবে সমাদৃত।

‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান’- গানটির মধুময়তা ফিরে আসে সত্যকারের দ্যোতনায়। কিংবা ‘পড়ে না চোখের পলক’ গানটির রোমান্স ধরা দেয় সবার মনেই। অন্যদিকে ‘কী যাদু করিলা পিরিতি শিখাইলা’ এবং ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’ প্রাণ সজনী চলচ্চিত্রে এক নতুন অবয়ব এনে দেয়। যার ফলে আমাদের প্রাণের অবারিত সৌন্দর্যে বার বার ধরা দেয় সুন্দর গানগুলোর প্রিয় মুহূর্ত। গানগুলো শ্রুতাদের মাঝে বিপুলভাবে সাড়া ফেলে।

দীর্ঘদিন কন্ঠশিল্পী হিসেবে দুই বাংলাতেই গান করেছেন এন্ড্রু কিশোর। একের পর এক জনপ্রিয় গান উপহার দিয়ে শ্রোতাদের মন কেড়ে নেন নিমিষেই। সেজন্যই আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮২ সালে ‘বড় ভাল লোক ছিল’, ১৯৮৭ সালে ‘সারেন্ডার’, ১৯৮৯ সালে ‘ক্ষতিপূরণ’, ১৯৯১ সালে ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ১৯৯৬ সালে ‘কবুল’, ২০০০ সালে ‘আজ গায়ে হলুদ’, ২০০৭ সালে ‘সাজঘর বিজয়ী’, ২০০৮ সালে ‘কি যাদু করিলা’- সিনেমাগুলোর জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ গায়কের পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৮ সালে ‘পদ্ম পাতার পানি’ গানটির জন্য সালে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার লাভ করেন।

অগণিত মানুষের ভালবাসার শিল্পী অসুস্থ হওয়ায় গত বছর ৯ সেপ্টম্বর উন্নত চিকিৎসার্থে সিঙ্গাপুর গমণ করেন। কিছুদিন পর জানা যায় তিনি ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত। সেখানে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা সেবা নিয়েছিলেন।

জীবনে অগণিত মানুষের ভালবাসা ও শ্রদ্ধা পেয়েছেন। চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে যাওয়ার পর গেটওয়ে থিয়েটার হলে আয়োজন করা হয় ‘এন্ড্রু কিশোরের জন্য ভালবাসা’ শিরোনামে সঙ্গীতানুষ্ঠান। আয়োজন করে বাংলাদেশ চেম্বার এবং সিঙ্গাপুর বিজনেস সোসাইটি। কষ্টের সীমানা পেরিয়ে হুইল চেয়ারে বসেই গাইলেন শিল্পী ‘জীবনের গল্প থাকে বাকি অল্প’। আবেগে ভাসিয়ে দিলেন দর্শক ও শ্রুতাদের। নিজ দেশের পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে অনেকেই আপ্লুত হয়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। তিনি দেখতে পেয়েছেন তার প্রতি মানুষের অগাধ ভালবাসাটুকুর বিস্তৃতি। আঁচ করতে পেরেছেন নিজের মমত্ববোধের জায়গাটুকু থেকে। তিনি আমাদের মাঝে কতটুকু জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তা আমরা বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে কিংবা সিঙ্গাপুরের সঙ্গীতানুষ্ঠানের মাধ্যমেই আঁচ করতে পারি।

শরীরের অবস্থা বেশি ভাল যাচ্ছিল না বলে ১১ জুন সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে আসেন দেশে। নিজ শহর রাজশাহীর মহিষবাথানে শেষ হলো তার ‘জীবনের গল্প’! তার বোন ডা. শিখা বিশ্বাসের বাড়িতে গত ৬ জুন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে স্ত্রী এবং এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন। রেখে গেছেন আরো অগণিত গানের ভক্ত।

এ বিস্ময়কর কণ্ঠরাজের জীবনাবসানে নেমে আসে শোক। গানের জলসাঘর থেকে চির বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। রেখে গেলে অজস্র সঙ্গীতপ্রেমীদের। যাদের জীবনের জলসাঘরে তার স্থান থাকবে অমলিন। চির ভাস্বর হয়ে বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে।

লেখক: ব্যাংক কর্মকর্তা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন