যন্ত্র যেন না হয় যন্ত্রণার কারণ

আব্দুল্লাহ-আল-মুসাব্বির

বাংলাদেশের শতকরা ৭০-৮০ ভাগ মানুষ প্রত্যাক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। কৃষির সাথে খাদ্য জড়িত, আর খাদ্যের সাথে জীবন। এই জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে সর্বপ্রথম সনাতন চাষ পদ্ধতি থেকে বের হয়ে প্রযুক্তিগত বা যন্ত্র নির্ভর কৃষি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। কৃষিযান্ত্রিকীকরণ ব্যতীত খাদ্য নিরাপত্তার লক্ষ্য অর্জন কখনই সম্ভব নয়। কৃষিযান্ত্রিকীকরণের প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করে বর্তমান সরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণে বিশেষ গুরত্ব আরোপ করেছে।

প্রেক্ষাপট বলছে, দেশে ফসলের মৌসুমে ৩৫-৪০ শতাংশ শ্রম ঘাটতি ও প্রকৃতিক দুর্যোগের প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে কৃষিক্ষেত্রে কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা এখন সুস্পষ্ট। প্রযুক্তি নির্ভর কৃষি এবং যন্ত্রে দক্ষ কৃষক গড়ে তোলা ব্যতীত বাণিজ্যিক কৃষির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কখনোই সম্ভব নয়।

কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সুবিধা
কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ফসলের নীবিড়তা ও ফলন বৃদ্ধি করে, ফলন বৃদ্ধির পাশাপাশি উৎপাদন ব্যয়সহ ফসল কর্তনজনিত ক্ষতি অনেকাংশে কম হয়। কৃষি উপকরনের ব্যবহার হ্রাস করে, কৃষকদের সময় এবং শ্রম বাঁচায়, খাদ্য মান যোগ করতে সাহায্য করে, এবং দীর্ঘ সময় ধরে শস্য গুদামজাত করতেও সহায়তা করে। প্রত্যেকটি যন্ত্রেরই স্বতন্ত্র সুবিধা রয়েছে, যার ব্যবহার কৃষকের বর্তমান প্রচলিত সনাতন পদ্ধতির চেয়ে অধিক লাভজনক।

কৃষি যান্ত্রিকীকরণে জন্য সরকারি পদক্ষেপ
প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশে কৃষক তথা দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা পরিবর্তন করার জন্য কৃষি যান্ত্রিকীকরণ আবশ্যক। এ লক্ষে সরকার ২০০৯-২০১২ সালে  ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে এবং ২০১৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সময়ে ৩৩৯ কোটি টাকা ব্যয়ে খামার যান্ত্রিকীকরণের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্পের মাধ্যমে যথাক্রমে ৩৮ হাজার ৩৩৮টি ও ২৫ হাজার বিভিন্ন কৃষি যন্ত্র কৃষকদের সরবরাহ করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য সরকার ৩২০০ কোটি টাকার একটি বৃহৎ প্রকল্প (তৃতীয় ধাপ ২০২০-২০২৪) পাস করতে চলেছে। গনমাধ্যমসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় এই প্রকল্পে সরকার ৫৭ হাজার ২৫০টি কৃষিযন্ত্র কৃষক পর্যায়ে সরবরাহ করবে যেখানে কৃষকরা হাওর অঞ্চলে ৭০ শতাংশ এবং অন্যান্য অঞ্চলে যন্ত্রপাতি কেনার ক্ষেত্রে ৫০-৬০ শতাংশ ভর্তুকি পাবেন। প্রকল্পের আওতায় ধান ও গমের জন্য ১৫ হাজার ও ভুট্টার জন্য ৫০০টিসহ মোট সাড়ে ১৫ হাজার কম্বাইন হারভেস্টার, ৬ হাজার রিপার ও ৩ হাজার রিপার বাইন্ডার, ৫ হাজার রাইস ট্রান্সপ্লান্টার, ৫ হাজার সিডার বা বেড প্লান্টার, ৫ হাজার পাওয়ার থ্রেসার, ৫ হাজার মেইজ শেলার, ৫ হাজার ড্রায়ার, ১ হাজার ৫০০টি পাওয়ার স্প্রেয়ার, ৩ হাজার পটেটো ডিগার, ৫০০টি ক্যারেট ওয়াশার ও ২ হাজার আলুর চিপস তৈরির যন্ত্র কৃষক পর্যায়ে সরবরাহ করা হবে। এ প্রকল্পে মোট যন্ত্র ক্রয়ের ব্যয় মোট প্রকল্প ব্যয়ের ৮৮ শতাংশ।

এই বৃহৎ কর্মযজ্ঞে কৃষকের জন্য প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, খুচরা যন্ত্রাংশ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, খুচরা যন্ত্রপাতির কাঁচামালের ট্যাক্স  হ্রাস, যন্ত্রপাতি পরীক্ষা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ, যন্ত্রপাতিতে ভর্তুকি দেওয়ার ব্যবস্থা করা গেলেও টেকসই কৃষিযান্ত্রিকীকরণ ব্যবস্থা নিশ্চিতের জন্য আরো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ প্রয়োজন। কারণ আধুনিক যন্ত্র নির্ভর কৃষি প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত পরিপূর্ণ ভাবে পৌঁছানো আক্ষরিক অর্থেই অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের কাজ। উচ্চমূল্যের এবং জ্ঞানভিত্তিক নতুন প্রযুক্তি ভর্তুকি মূল্যে সরবরাহের পূর্বে প্রয়োজন যথাযথ পরিকল্পনা, সুনির্দিষ্ট  নীতিমালা, প্রকৌশল জনশক্তি এবং সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনার।

বর্তমান সরকারের কৃষি যন্ত্রপাতি ভর্তুকি দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য কৃষক পর্যায়ে ভর্তুকির সুবিধা পৌঁছানো এবং কৃষককে যন্ত্র ব্যবহারে উৎসাহ প্রদান করা। কিন্তু দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থা এবং প্রযুক্তিগত সল্প জ্ঞানের কারনে আমাদের প্রান্তিক কৃষকদের উচ্চমূল্যের ও জ্ঞানভিত্তিক যন্ত্রপাতি ক্রয়ের সামর্থ্য ও আগ্রহ নেই। তাদের বেসরকারি কৃষি যান্ত্রিকীকরণ উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে হেক্টর বা একর প্রতি হারে এই যন্ত্রপাতি ভাড়া নিতে হবে। সেক্ষেত্রে এখনও আমাদের প্রান্তিক কৃষকদের ভর্তুকি হারে যন্ত্র ভাড়া দেওয়ার জন্য যন্ত্র ক্রয়কারীদের  বাধ্য করার নীতিমালার অভাবে প্রান্তিক কৃষকরা একর প্রতি ভর্তুকি হার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন।

দ্বিতীয়ত, কোনো উপজেলায় উদ্যোক্তা পর্যায়ে উচ্চ মূল্যের কৃষিযন্ত্র ক্রয়কারী না পেলে সরকারকে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে, অন্যথায় অনেক উপজেলায় কৃষক যন্ত্র ব্যবহারের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে।

তৃতীয়ত কৃষকদের মধ্যে অনৈক্য এবং সরকারের পরিকল্পনা অনুসারে কৃষকদের কৃষিকাজ করতে বাধ্য করার নীতিমালার অভাবে, অনেক উপজেলায় কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রেতা ভর্তুকি মূল্যে যন্ত্র ক্রয়ের পরে যন্ত্রের দ্বারা প্রতি বছর প্রত্যাশিত মুনাফা অর্জন থেকে বঞ্চিত হবেন।

চতুর্থত কিছু মুনফা লোভী অসাধু ব্যবসায়ী ভর্তুকি মূল্যে কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয় করে বর্তমানে বাজার মূল্যে যন্ত্রটি অন্যত্র বিক্রি করে দিতে পারে যা ভর্তুকির উদ্দেশ্য ব্যহত করবে।

সুতরাং, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, নীতিমালা ও আইন ব্যতিত যন্ত্রপাতি ক্রেতা এবং প্রান্তিক কৃষক উভয়েরই বঞ্চিত হওয়া এবং মুনাফা লোভী অসাধু ব্যবসায়ীদের দৈরত্ব বাড়ার আশংকা রয়েছে।

উত্তরণের সম্ভাব্য উপায়
এসব প্রতিকূলতা উত্তোরণের জন্য ভর্তুকি মূল্যে সরবরাহকৃত যন্ত্রের একর প্রতি ভাড়া নির্ধারণ, উপজেলা ভিত্তিক মাটির প্রকৃতির ভিত্তি করে ‘যন্ত্রের চাহিদা নিরূপণ ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ, দুর্নীতি রোধে যন্ত্র ক্রেতা আইন’ তৈরি, আইনের সঠিক প্রয়োগ ও সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী কৃষককে ফসল উৎপাদনে বাধ্য করতে ‘কৃষকের জমি ব্যবহারের বিধিমালা’ তৈরি করতে হবে।

পাশাপাশি টেকসই কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য আরও কিছু চ্যালেঞ্জ উত্তীর্ণ হতে হবে। যেহেতু যন্ত্রগুলো বছরের নির্দিষ্ট সময় ব্যতীত অন্য সবসময় অব্যবহৃত অবস্থায় থাকবে তাই যন্ত্র যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চতকরণ, মাঠে সৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে তাৎক্ষণিক কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহন, যন্ত্র ব্যবহারের উপযোগী করে গ্রামীণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন, যে কোন ধরনের যান্ত্রিক সমস্যায় বিক্রয় পরবর্তী সেবা নিশ্চিৎকরন, খুচরা যন্ত্রাংশের প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণ, দক্ষ যন্ত্রচালক তৈরিকরণ ইত্যাদি বিষয়ে বিশেষ গুরত্ব আরোপব্যতীত টেকসই যান্ত্রিকীকরণ কখনোই সম্ভব নয়।

এছাড়াও ভর্তুকি মূল্যে পূর্বের সরবরাহকৃত যন্ত্রগুলোর ও যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।  প্রতিটি যন্ত্র ক্রেতাকে তার যন্ত্রটি  প্রত্যাশিত জীবনকাল অবধি ব্যবহার করতে বাধ্য করতে হবে। প্রকল্পের ব্যয় করা অর্থের ন্যায্যতা এবং টেকসই যান্ত্রিকীকরণের জন্য এটি আবশ্যক। অন্যথায় এই প্রকল্পটিতে বিপুল অর্থের অপচয় হতে পারে এবং যা পরবর্তী উন্নয়নের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

এটি স্পষ্ট যে, বর্তমানে মাঠ পর্যায়ে পর্যাপ্ত সংখ্যক কৃষি সম্প্রসারণ কর্মী ও কৃষিবিদ থাকার ফলে অঞ্চল ভেদে কৃষির সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণের পাশাপাশি ফসল, শাকসবজি, ফল, ফুল, ফলের অঞ্চল ভেদে বিভিন্ন জাতের বীজ, ভালমানের সার ও কীটনাশক এবং নানাবিধ সমস্যার সমাধান কৃষকের দোরগোড়ায় পৌছানো সম্ভব হয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় মাঠ পর্যায়ে কৃষি প্রযুক্তি সম্প্রসারন কাজের জন্য পর্যাপ্ত প্রকৌশল জনবলের অভাবে এখনো কৃষিযন্ত্র ও কৃষি যন্ত্র বিষয়ক গবেষনা লব্ধ বিভিন্ন ফলাফল, উন্নত সেচ ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন কার্যকর ভাবে কৃষকের দোর গোড়ায় পৌছানো সম্ভব হয়নি।

সকল নীতিমালা তৈরি ও পরিকল্পনা গ্রহন করলেও পর্যাপ্ত জনশক্তি এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে সকল  দপ্তর, সংস্থা ও গবেষনা কার্যক্রমে জড়িত প্রকৌশল জনবলকে কারীগরি জ্ঞান সম্পন্ন দক্ষ জনবলে রূপান্তর ব্যতীত এর বাস্তবায়ন কোন ভাবেই সম্ভব নয়।


প্রয়োজনের তুলনায় কৃষি খাতে প্রকৌশল জনবল নিতান্তই অপ্রতুল। যেমন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি)  ক্ষুদ্রসেচ বিভাগের শুধু  উন্নত  সেচ ব্যবস্থাপনা  নিশ্চিত করার জন্যও পর্যাপ্ত জনবল নেই। অতিসত্বর  উপজেলা ভিত্তিক প্রকৌশলী, ডিপ্লোমা প্রকৌশলী ও মেকানিক  সমন্বয়ে  জনবল নিয়োগ দেওয়ার পাশাপাশি বিএডিসি ক্ষুদ্রসেচ বিভাগকে শুধুমাত্র সেচ যান্ত্রিকীরন ও সেচ ব্যবস্থপনা কার্যক্রমে আবদ্ধ না রেখে বর্তমান চাহিদা অনুযায়ী কৃষির অন্যান্য অংশ যান্ত্রিকীকরণেও ব্যবহার করা জরুরি।

এছাড়াও কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধিনস্ত বিভিন্ন দপ্তর, সংস্থায় কর্মরত কৃষি প্রযুক্তি সম্প্রসারণ কাজে নিয়োজিত সকল প্রকৌশল জনবলকে ঢেলে সাজানোই হওয়া উচিত টেকসই কৃষি যান্ত্রিকরণের প্রথম পদক্ষেপ। পাশাপাশি কৃষি যন্ত্র বিষয়ক গবেষণা কার্যক্রম জোরদারকরণ ও গবেষণা কর্মীদের সাথে প্রযুক্তি সম্প্রসারণ কর্মীদের সমন্বয় সাধন করতে হবে।

নিশ্চয় প্রকৌশল জনবল কৃষি বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন এনে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে সামনে দিকে।

সবশেষে বলা যায় উন্নত সেচ ব্যবস্থাপনা, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নকে একসূত্রে বেধে সকল বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা ও আইন তৈরির মাধ্যমে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক করে মাঠ পর্যায়ে কাজ বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। তাই টেকসই কৃষি যান্ত্রকীকরণে লক্ষ্যে সরকারের সু-দৃষ্টি ও দ্রুততম পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন। অন্যথায় এই যন্ত্রই হবে যন্ত্রণার কারণ।

লেখক: সহকারী প্রকৌশলী, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন