ঢাকা ব্যাংকে আমার পাঁচ বছর

আজম খান

২০০৪ সালের কথা। আমি তখন জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করতাম ডাচ-বাংলা ব্যাংকে। ওই ব্যাংকে আমার একজন প্রিয় সিনিয়র কলিগ ছিলেন ইকবাল আমিন। একদিন ইকবাল আমিন ভাই বললেন, ঢাকা ব্যাংকে কাজ করবেন? চলেন আপনাকে একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। যার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন উনি হলেন আরহাম মাসুদুল হক। ঢাকা ব্যাংকের তখনকার কোম্পানি সচিব। অনেক মিশুক, আন্তরিক আর প্রাণখোলা মানুষ হলেন আরহাম স্যার। শুধু তার সুন্দর কথা আর ব্যবহারের জন্য মানুষ তাকে চিরদিন মনে রাখবেন। আলাপের পরে উনি আমার কাছে সিভি চাইলেন। আর বললেন, আজম সাহেব আপনার মতোই একজনকে আমাদের দরকার। তার কিছুদিন পরে ইন্টারভিউ হল এবং যথারীতি এপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে পেলাম। ঢাকা ব্যাংকের জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে।

আমি যেদিন জয়েন করতে গেলাম, সেদিনের অভিজ্ঞতাটা ছিল আমার সম্পূর্ণ অন্যরকম। ঢাকা ব্যাংকের তখন এমডি ছিলেন সাহেদ নোমান। তখন সেখানে একটা রীতি ছিল জয়েন করার পরে সবাইকে এমডি সাহেব তার সাথে চা খাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাতেন। সেদিন বেশ কয়েকজন একজিকিউটিভ জয়েন করেছিল। আমি ছিলাম সবার শেষে। আমি অপেক্ষা করছি। কিন্তু আমার আর ডাক আসছে না। একদম অফিস শেষ হওয়ার সময় পিওন এসে বলল, স্যার আপনাকে ডাকছেন।  

চেম্বারে ঢোকার পরে এমডি স্যার আমাকে বসতে বললেন। কুশল জিজ্ঞাসা করে চা-ও অফার করলেন। আমার জয়েনিং বস ছিলেন তখন শাকীর আমিন চৌধুরী (পরবর্তীতে উনি ঢাকা ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসাবে ২০২০ সালে অবসর নেন)। তারপর আমাদের অবাক করে দিয়ে এমডি স্যার বললেন, আজম তোমাকে ঢাকা ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা মির্জা আব্বাস (উনি তখন সরকারের গৃহায়ন মন্ত্রী)  সাহেব দেখা করতে বলেছেন। তুমি আজকেই তার সাথে তার বাসায় দেখা কর। 

আমি ভয়ে ভয়ে গেলাম মির্জা আব্বাস স্যারের সাথে দেখা করতে তার শাহজাহানপুরের বাসায়। উনাকে একজন রাশভারী রাজনীতিবিদ হিসাবে চিনতাম আমি। কিন্তু পরিচয়ের পরে আমার ভুল ভাঙল। অনেক কেয়ারিং আর সামাজিক মানুষ মির্জা আব্বাস। আমার পড়াশোনা,  কাজের অভিজ্ঞতা, ফ্যামিলি সব খবর নিলেন। আর ভাল করে কাজ করতে বললেন। তারপর বহুবার মির্জা আব্বাস স্যারের সাথে আমার দেখা হয়েছে ব্যাংক বা তার বাসায়। অনেক কথা হতো, আর পছন্দও করতেন আমাকে। 

ঢাকা ব্যাংকের এমডি হিসাবে জয়েন করার আগে সাহেদ নোমান স্যার ছিলেন বিদেশী ব্যাংকে। সুইটজারল্যান্ডের মেরিল লিঞ্চে ছিলেন তিনি দীর্ঘদিন। যার জন্য তিনি বেশ ফরম্যাল ছিলেন, গম্ভীর থাকতেন, খুব কম কথা বলতেন, এপয়েন্টমেন্ট করে দেখা করতে হতো। তার মুখে খুব কম সময়ই হাসি দেখা যেতো।

আর আমার রিপোর্টিং ছিল এমডি স্যারের কাছে। অন্যদিকে আমার ডিপার্টমেন্টে  আমিই একমাত্র কর্মকর্তা। কারণ আমার জয়েনের পরেই ঢাকা ব্যাংকে প্রথম পিআর অফিস হয়েছিল। আর তাই আমার জন্য ছিল অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। 

একা কাজ করতাম। অনেক ফরম্যাল একজন এমডির অধীনে। তখন ঢাকা ব্যাংকের কাজ করতো দুইটা এজেন্সি। গ্রে আর মিডিয়াকম। ঢাকা ব্যাংকের ব্র্যান্ডিং আর সিএসআর ছিল আমার কাজ। অনেক ব্যস্ত থাকতাম সারাদিন। সকালে অফিসে ঢুকতাম আর বের হতাম রাত ৯/১০ টায়। এমডি স্যার বের হতেন ৯টার দিকে। একদিন বের হওয়ার সময় উনি এসে দাঁড়ালেন আমার ডেস্কের সামনে। টুকটাক কথাবার্তা বললেন কাজ নিয়ে। তারপর কি মনে করে বললেন, তোমার তো অনেক কাজ। আপাতত একা একাই কাজ করতে হবে। পরে দেখবো কাউকে দেয়া যায় কিনা। আর তারপরই আমাকে অবাক করে বললেন, আজম সবার সাথে আমার খুব ফরম্যাল সম্পর্ক। কিন্তু তোমাকে আমি লাইক করি, তুমি আমাকে স্যার না বলে এখন থেকে নোমান ভাই বলে ডেকো। 

সেই থেকে তার অবসরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত অনেক ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি সাহেদ নোমান স্যারের সাথে। ব্রাঞ্চ ওপেনিং, বিভিন্ন ভিজিট আর বিভিন্ন প্রোগ্রামে গিয়েছি এক সাথে। স্যারের রুমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অফিসের বিষয় নিয়ে কথা হতো। তার একটা নিয়ম ছিল তার রুমে কেউ থাকলে, যত সিনিয়রই আসুক অন্য কাউকে তিনি এলাউ করতেন না। ঢাকা ব্যাংক থেকে অবসর নেয়ার পরেও স্যারের সাথে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে বহুবার।

আমার দায়িত্বকালে উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসাবে আমি পেয়েছিলাম খন্দকার ফজলে রশীদ আর মোহাম্মদ আবু মুসা স্যারকে। খন্দকার ফজলে রশীদ স্যার পরবর্তীতে প্রিমিয়ার ব্যাংকে এমডি হন এবং আবার ঢাকা ব্যাংকে ফিরে আসেন এমডি হিসাবে। ২০০৯ সনে আমি ঢাকা ব্যাংক থেকে চলে আসার সময় খন্দকার ফজলে রশীদ স্যার এমডি ছিলেন। মোহাম্মদ আবু মুসা স্যার সাহেদ নোমান স্যারের চলে যাওয়ার পরে ভারপ্রাপ্ত এমডি হয়েছিলেন।

আরেক জন নিরেট ভদ্র মানুষের সাথে আমি কাজ করেছি। তিনি গোলাম হাফিজ আহমেদ। আমার চাকরিকালীন সময়ে প্রথমে লোকাল অফিসের ম্যানেজার আর পরে হেড অব কর্পোরেট ব্যাংকিং ছিলেন তিনি। পরবর্তীতে এনসিসি ব্যাংকের এমডিও হয়েছিলেন। একজন সজ্জন মানুষ ছিলেন তিনি।

ঢাকা ব্যাংকে আর একজন ছিলেন, নিয়াজ মোহাম্মদ খান। আমি স্যারকে প্রথমে পেয়েছিলাম ফরেন এক্সচেঞ্জ শাখার ম্যানেজার, পরবর্তীতে লোকাল অফিসের ম্যানেজার এবং সর্বশেষ পেয়েছিলাম উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসাবে। আমাকে অনেক পছন্দ করতেন।  মরন ব্যাধি ক্যান্সারে মারা যাওয়ার আগে ২০১৩ সনে শ্রীলংকার কলম্বো থেকে মিহির লংকার ফ্লাইটে ঢাকায় ফিরেছিলাম পাশাপাশি বসে। আমি তখন অন্য ব্যাংকে। অনেক গল্প হয়েছিল ঢাকা ব্যাংকের সেই পুরানো দিনের। সেটাই ছিল শেষ স্মৃতি স্যারের সাথে। পরে মৃত্যু শয্যায় স্কয়ার হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম তাকে আমি। জানি না আমাকে চিনতে পেরেছিলেন কিনা।

খান শাহাদত হোসেন আর একজন সাবেক উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক। যাকে আমার চাকরিকালীন সময় প্রথম পেয়েছিলাম ঢাকা ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ শাখা এবং পরবর্তীতে বনানী শাখার ব্যবস্থাপক হিসাবে। অমায়িক এবং সংস্কৃতি প্রিয় একজন মানুষ তিনি। 

বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইমরানুল হকের সাথে প্রথম পরিচয় হয়েছিল ২০০৪ সনে গুলশান শাখার ব্যবস্থাপক হিসাবে। তখন তিনি ছিলেন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট। ঢাকা ব্যাংকের বোর্ড মিটিং হত তখন গুলশানে। আমাকেও মাঝে মাঝে আসতে হতো সে সময়। আর সেই কারণেই তার সাথে সখ্যতা গড়ে উঠেছিল আমার।

ঢাকা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের মধ্যে প্রতিষ্ঠাতা মির্জা আব্বাস ছাড়াও কাজ করেছি প্রাক্তন চেয়ারম্যান আব্দুল হাই সরকার, এটিএম হায়াতুজ্জামান খান, রোকশানা জামান, খন্দকার মনির উদ্দীন, আলতাফ হোসেন সরকার এবং বর্তমান চেয়ারম্যান রেশাদুর রহমান শাহীনের সাথে। বাংলাদেশ যুব অনুর্ধ ১৯ ক্রিকেট দলকে স্পন্সর করেছিল ঢাকা ব্যাংক। আর সেই কারনে ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এসেছিলাম আর এক পরিচালক খন্দকার জামিল উদ্দীনের।

এটিএম হায়াতুজ্জামান খান ছিলেন একজন স্নেহ প্রবণ আর আবেগী মানুষ। অত্যন্ত অতিথি পরায়ন। অনেক কেয়ারিং। অনেক স্মৃতি রয়েছে তার সাথে ভালো আর মন্দের। অনেক কাজ করেছি সরাসরি তার অধীনে।

খন্দকার মনির উদ্দীন চেয়ারম্যান থাকাকালীন সরাসরি তার সাথেও কাজ করেছি। খুব ফর্মাল মানুষ। তার উদ্দ্যোগে সেসময় জনপ্রিয় বিজ্ঞাপন নির্মাতা মোস্তফা সরোয়ার ফারুকীকে দিয়ে একসাথে ছয়টি টিভিসি বানিয়েছিলাম আমরা। ঢাকা ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড আর রিটেইল ব্যাংকিং নিয়ে। গল্ফ প্রিয় খন্দকার মনির উদ্দীনের সময় আমরা প্রথম কোন গল্ফ টুর্নামেন্ট স্পন্সর করেছিলাম অনেক জাঁকজমক ভাবে। তার সময় ঢাকা ব্যাংকের ব্র‍্যান্ডিং এক নতুন মাত্রা পেয়েছিল।

বর্তমান চেয়ারম্যান রেশাদুর রহমান শাহীন ছিলেন আর একজন ইনফরমাল মানুষ।  সরাসরি কথা বলতেন। সবাই তার কাছে যেতে পারতেন। ব্যাংকের বিভিন্ন কাজের খোজ নিতেন। আমি যখন ঢাকা ব্যাংক থেকে চলে আসি তখন রেশাদুর রহমান শাহীন স্যার দেশে ছিলেন না। আমি অনেক অবাক হয়েছিলাম উনি দেশে ফিরে যখন ফোন করেছিলেন আমার খোজ নেয়ার জন্য।

আমি ঢাকা ব্যাংকে ছিলাম পাঁচ বছরের কিছু বেশী সময়। ২০০৪ থেকে ২০০৯। আমার কর্মকালের শেষের দিকে একজন তরুণ সহকর্মী আমার বিভাগে জয়েন করেছিলেন। সফিকুল ইসলাম মিল্টন। সেসময় ঢাকা ব্যাংক ছিল, দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে অনেক শক্তিশালী একটি ব্র্যান্ড। তখন সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না। প্রিন্ট আর ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে ছিল আমাদের শক্ত অবস্থান। বিভিন্ন সেক্টরে ছিল আমাদের স্পন্সরশিপ। ২০০৫ সনের সার্ক সম্মেলনে ঢাকা মহানগরীর বিউটিফিকেশন কাজের অংশ হিসাবে জাতীয় ঈদগাহ এর সামনে অবস্থিত কদম ফোয়ারা স্থাপন করেছিলাম আমরা। করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির আওতায় স্বাস্থ্য, শিক্ষা আর দুর্যোগ প্রতিরোধে অনেক কাজ করেছিলাম আমরা তখন।

আজ অনেকের মধ্যে কিছু প্রিয় নাম এখনো মনে পড়ে। সৈয়দ মিজানুর রহমান, শাহ আজিজুর রহমান, আলতাফ হোসেন, নাসের হাসান, অসীম চৌধুরী, আলকোনা চৌধুরী, এম এইচ কাফী, সাইফুল মোমেন, মো. সিরাজুল হক, সুজাউর রহমান,  ইমদাদুল ইসলাম, আহসান কবীর, ফখরুল ইসলাম, ফখরুল আবেদীন, মোকাররম হোসেন চৌধুরী, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, শেখ বাকির হোসেন, আখলাকুর রহমান, মোশতাক আহমেদ খান, মোশতাক হোসেন খান, দারাশিকো খসরু, শামসাদ বেগম, সালাহুদ্দিন আহমেদ, মাহবুবুল আলম তৈয়ব, সৈয়দ ফয়সাল ওমর, ফয়সাল ফারুকী, জিয়াউর রহমান, পীযুষ কান্তি দে, মুস্তফা হোসেন, কামরুল হুদা, সোহেল শাহরিয়ার আখন্দ।

`এক্সিলেন্স ইন ব্যাংকিং' এর ঢাকা ব্যাংক আজ ২৫ বছর পর তার রজতজয়ন্তীতে গ্রাহক আর শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে এন্ডলেস পসিবিলিটিস।

লেখক: ব্যাংকার ও অভিনেতা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন