নগর উন্নয়নের বলি ছায়াদায়ী বৃক্ষ, ঝুঁকিতে ফেরিওয়ালাদের খাদ্যনিরাপত্তা

বণিক বার্তা অনলাইন

ফুটপাতে ও ফেরি করে নানা পণ্য বিক্রি করে যারা পেট চালান, রাস্তার পাশের ছায়াদানকারী বৃক্ষ তাদের অন্যতম আশ্রয়। প্রখর রোদে, বৃষ্টিতে তারা এসব গাছের নিচে বসেন, ক্লান্তি ঝরান, দিনের বাকি সময়ের জন্য শক্তি সঞ্চয় করেন। তাছাড়া এ গাছের নিচেই বসে খাবার, পোশাক, ফল ইত্যাদির দোকান। এসব গাছ নগরের ভাসমান দোকানদারদের জন্য ব্যবসার একটি আরামদায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করে। বিশেষ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যখন নগরের তাপমাত্রা দিন দিন অসহ্য হয়ে উঠছে।

কিন্তু নগর উন্নয়ন, সড়ক প্রশস্তকরণ, সৌন্দযবর্ধন, অভিজাত এলাকা নির্মাণের অজুহাতে হয় এসব গাছ কাটা পড়ছে, নয়তো ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা এসব গাছের ছায়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে ভারতে একটি গবেষণা হয়েছে। ভারতের হায়দ্রাবাদের ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা গাছের ‘ছায়ার অধিকার’ হারাচ্ছেন- গবেষণায় এমন মন্তব্য করা হয়েছে। 

গবেষকরা বলছেন, উন্নয়নের জন্য উপযুক্ত স্থান থেকে বিতাড়িত হওয়ার কারণে ফুটপাতের এই বিক্রেতারা ব্যবসা হারালে শহুরে দরিদ্রদের খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। 

গবেষণাটি ল্যান্ডস্কেপ অ্যান্ড আরবান প্ল্যানিং জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। পরিবেশ ও সামাজিক ন্যায়বিচারের সম্মিলিত দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতীয় শহরগুলোর টেকসই উন্নয়নের চিত্র বোঝার জন্য আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড সাস্টেইন্যাবিলিটির গবেষণার একটি অংশ ছিল এটি। 

গবেষণাটির সহযোগী সুকন্যা বসু ব্যাখ্যা করেন, একাধিক গবেষণার মাধ্যমে এটা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, নগরের গাছগুলো একটা বাস্তুসংস্থান তৈরি করে। উন্নয়নের নামে গাছগুলো কাটার সময় এগুলোর ওপর নির্ভরশীলদের কথা বিবেচনা করা হয়নি।

তিনি বলেন, আমরা যখন ভারতের শহরগুলোর রাস্তাগুলো পর্যবেক্ষণ করি, তখন স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে গাছগুলোর ওপর সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল ফুটপাতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। তারা অত্যন্ত নাজুক ও অরক্ষিত একটি গোষ্ঠী, যারা প্রায় দিনের পুরো কর্মসময়ই প্রচণ্ড রোদের মধ্যে কাটান। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আমরা এমন কোনো গবেষণা বা সাহিত্য খুঁজে পাইনি, যা গাছের সঙ্গে এই মানুষগুলোর সম্পর্ক বিশ্লেষণ করেছে। 

গবেষণাটিতে দেখানো হয়েছে, ফুটপাতের এই বিক্রেতারা রাস্তার গাছগুলোর ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল। তাদের নির্ভরতা কেবল গাছের ছায়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর সঙ্গে তাদের আবেগ ও আত্মিক একটা সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে রাস্তার গাছগুলোতে বিক্রেতাদের অধিকার সীমিত হয়ে গেছে। 

বিষয়টির ব্যাখ্যায় সুকন্যা বসু বলেন, রাস্তার গাছগুলোতে ব্যবসায়ীদের অধিকার সীমিত হওয়ার পেছনে আমরা তিনটি বিস্তৃত চ্যালেঞ্জকে শনাক্ত করেছি। 

প্রথমত, রাস্তায় গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া। রাস্তা প্রশস্তকরণের মতো বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের কারণে রাস্তার গাছগুলোকে কেটে ফেলা হয়েছে। 

দ্বিতীয়ত, শহরে বাসবাসরত নাগরিকদের মধ্যে একটা বৈষম্যমূলক পৃথকীকরণ ব্যবস্থা রয়েছে। যেমন, হায়দ্রাবাদের সিকান্দারবাদ স্ট্রিট মার্কেটে ফুটপাতের বিক্রেতাদের ঘনত্ব অনেক বেশি। কিন্তু সেখানে গাছের সংখ্যা কম। অথচ এটি একটি জনপ্রিয় সড়ক। অন্যদিকে বানজারা হিল ও জুবলি হিলসের রাস্তাগুলোতে প্রচুর ক্যানোপি (সামিয়ানার মতো বিস্তৃত ছায়াদানকারী গাছ) গাছ থাকলেও বিক্রেতার সংখ্যা কম। কারণ এটি একটি অভিজাত এলাকা।

তৃতীয়ত, শহরগুলোর বিভিন্ন স্থান উন্নয়ন, বেসরকারিকরণ ও সংস্কারের ফলে বেড়া ও দেয়াল তোলা হয়েছে। এতে অনেক রাস্তা থেকে গাছ কাটা গেছে। আবার কোনো রাস্তা থেকে ফুটপাতের বিক্রেতাদের উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। আবার বিশেষ করে বেরসরকারি অফিস পাড়াগুলোতে এবং অভিজাত আবাসিক এলাকায় গার্ডদের বাধার কারণে ব্যবসায়ীরা ফুটপাতের বসতে পারেন না।

সুকন্যা বসু বলেন, রাস্তার বিক্রেতারা শহরের জনজীবনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। কিন্তু এটি স্বীকৃতি নেই। যেমন, তারা কেবল শহুরে দরিদ্রদেরই নয়, শহরের অন্য বাসিন্দাদের জন্যও খাদ্য, পোশাক এবং অন্যান্য পণ্যের জোগান ও প্রাপ্তি নিশ্চিত করেন। নগরের রাস্তার সংস্কৃতির (স্ট্রিট কালচার) রূপদান করেন মূলত তারাই। 

দুঃখের বিষয়, টেকসই উন্নয়নের আওতায় থাকা শহরগুলোর লক্ষ্য উদ্দেশ্যের মধ্যে এই গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক গোষ্ঠীর জীবনযাপন ও সংস্কৃতি খুব একটা অন্তর্ভুক্ত থাকে না। নগর পরিকল্পনার ক্ষেত্রে নগর পরিকল্পনাবিদ ও নীতি নির্ধারকদের নগরীর সমস্ত স্বর অন্তর্ভুক্ত করার কথা মাথা রাখা উচিত। তাদের ব্যক্তিগত, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক নির্ভরতা এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনের দুর্বলতাগুলো বোঝা প্রয়োজন। 

পুনঃউন্নয়ন, ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইনিং এবং সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পের দোহাই দিয়ে ফুটপাতের বিক্রেতাদের মতো গোষ্ঠীগুলোকে বিতাড়িত করা কোনোমতেই সমীচীন নয়। তারা বিশেষত কেবল প্রান্তিক নয়, শহরের অর্থনীতি ও রাস্তার সংস্কৃতি গঠনে প্রধান ভূমিকা পালন রাখেন। 

বিবিসি অবলম্বনে 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন