এতে সুবিধা পেয়েছেন ৫০০ কোটি টাকার ওপরে যাদের ঋণ। ছোট ও মাঝারিরা তখন কোনো সুবিধা পাননি। দেখাই যাচ্ছে ব্যাংকিং খাত ‘খেলাপি ঋণে’ ভরে যাচ্ছে। পুনঃতফসিলের সুবিধা ছিল। তা উদারভাবে ব্যবহার করে পচিয়ে ফেলা হয়েছে। আমদানি ঋণ (ট্রাস্ট রিসিটের বিপরীতে ঋণ) দীর্ঘমেয়াদি ঋণে পরিণত করা হয়েছে। বড় ঋণগ্রহীতাদের ‘খাতির’ করে এত্ত বেশি ঋণ দেয়া হয়েছে যে তারা টাকা ফেরত দিতে পারছেন না। তাই ২০১৯ সালে গণহারে পুনঃতফসিলের ব্যবস্থা হয়। ১০ বছরে ঋণ পরিশোধ করা হবে। এক বছর ‘গ্রেস পিরিয়ড’। মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট। এমন সুবিধা আর কোথায় পাওয়া যাবে! কেউ কেউ ভেবেছিলেন, যাক বাঁচা গেল। ‘খেলাপি ঋণ’ আর বাড়বে না। অন্তত অর্থমন্ত্রী তা-ই বলেছিলেন। উপায়ন্তর না দেখে কথা রাখার জন্য তিনি খেলাপি ঋণের সংজ্ঞাই বদল করেছিলেন। মানুষ তো বোঝে না।
খেলাপির সংজ্ঞা এমন করা যায়, যাতে পরিসংখ্যান বলবে দেশে কোনো খেলাপি ঋণ নেই। বিষয়টি সংজ্ঞার এবং সেই সংজ্ঞা স্থির করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যার জন্য আন্তর্জাতিক কিছু বাধ্যবাধকতা আছে। তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক কখনো মানে, কখনো মানে না, মানতে পারে না। এ পরিস্থিতিতেই এসে গেল মহমারী নভেল করোনাভাইরাস। সারা পৃথিবীকে আক্রান্ত করল এই মহামারী। বাংলাদেশ এর কোনো ব্যতিক্রম নয়। সব হিসাবপত্র তছনছ হয়ে গেছে এই মহামারীতে। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ। কলকারখানা বন্ধ। বেচাকেনা নেই বললেই চলে। এতে আর কার কী হয়েছে, তা পরের কথা, প্রথমেই বিপদে পড়েছে দেশের ব্যাংকগুলো। তাদের খেলাপি ঋণ সমস্যা দীর্ঘদিনের। এতে তাদের পুঁজির স্বল্পতা হচ্ছে। প্রভিশনিংয়ে (সঞ্চিতি) ঘাটতি হচ্ছে। সারা দেশ তাদের গালিগালাজ করছে। যত অপবাদ সব তাদের ওপরে। এখন কী হবে? সরকারের প্রণোদনা কার্যকর করতে হবে। সরকারের প্রণোদনা ব্যাংকনির্ভর। সরকার ব্যবসায়ী-শিল্পপতিকে সরাসরি টাকা দেবে না। দেবে সেই গালি খাওয়া ব্যাংকগুলোকে দিয়েই। এখানেই বিপত্তি। খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। করোনার ফলে যে ‘খেলাপি’ ঘটছে তা নতুন বিধি অনুযায়ী এখন আর খেলাপি বলা যাবে না। কিন্তু দুদিন পরে কী হবে? সময়সীমা পেরিয়ে গেলে তো তাদেরকে খেলাপি বলতে হবে। সেই চাপ ব্যাংকের ওপরই পড়বে। তাই নয় কি? এদিকে দৈনিক বণিক বার্তায় আরেক স্টোরিতে দেখা যাচ্ছে ‘এসএমই’ খাত নিয়ে ব্যাংকাররা মহাবিপদে। ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ এই খাতে। মোট ঋণের তা ২১ শতাংশ বলে বণিক বার্তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এসএমই খাত নিয়ে ব্যাংকাররা উদ্বিগ্ন। এই টাকার কী হবে? দেখা যাচ্ছে আগের খেলাপি ঋণ, নতুন ‘স্ট্রেসড লোন’ (দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ) এবং সম্ভাব্য খেলাপি ঋণের দুঃস্বপ্নে ভুগছেন ব্যাংকাররা। দুঃস্বপ্ন আরো বেশি, কারণ এখন দেয়ার সময়। এ সময়েই ব্যাংকাররা অভিযুক্ত। তারা ঋণ দিচ্ছেন না। দরখাস্ত হাতে নিয়ে বসে আছেন। কোনো কোনো ব্যাংক বলছে ডিসেম্বরের আগে কোনো ঋণ দেয়া যাবে না। চাতক পাখির মতো শিল্প মালিকরা ঋণের জন্য ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। এ সম্পর্কে বণিক বার্তায় সুন্দর একটি খবর আছে। খবর অন্যত্রও আছে। মিডিয়ায় বস্তুত প্রায় প্রতিদিন ব্যাংকারদের দোষারোপ করা হচ্ছে। এতদিন ঋণের ‘গাইডলাইন’ দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বসেছিল। এখন ব্যাংকারদের ডাকাডাকি করছে। বলছে অচিরেই ঋণের টাকা ডিসপাস করতে হবে। সরকার থেকে বলা হবে। হতাশাগ্রস্ত ব্যাংকাররা, ব্যাংকের কর্মচারী-কর্মকর্তারা কাজ করে যাচ্ছেন। দেখা যাবে দুদিন বাদে আবার তাদেরকে গালিগালাজ করা হবে সেই পুরনো সমস্যার জন্য। কারণ ব্যাংকাররা নিশ্চিত নন, যে টাকা এখন দেয়া হবে তা ফেরত আসবে কিনা। তখন খেলাপি ঋণ ছাড়া দেশে আর কিছুই থাকবে না। কারণ পরিস্থিতি যা, তাতে বোঝাই যায় শত শত হাজার হাজার দরখাস্ত ব্যাংকগুলো পাচ্ছে। এর মধ্যে কে আসল কে নকল, এ প্রশ্ন ভীষণভাবে আছে। ব্যাংকাররা জীবননাশের হুমকি পাচ্ছেন। এক্সিম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও আরো কয়েকজন কর্মকর্তা মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে এসেছেন। ৫০০ কোটি টাকার ঋণ। মর্টগেজ দেয়ার ক্ষমতা ঋণগ্রহীতার নেই। যে সম্পত্তি মর্টগেজ তারা দেবেন, এর মূল্য ধরতে হবে বেশি। এই ছিল ঋণগ্রহীতার দাবি। ব্যাংকাররা তা মানছেন না। অতএব গুলির সম্মুখীন তারা। এই একটা ঘটনা কাগজে এসেছে। বাকি সব চাপের ঘটনার কয়টা কাগজে আসে? ঊর্ধ্বচাপ, পার্শ্বচাপে কর্মকর্তারা ব্যতিব্যস্ত। কোনটা রেখে কোনটা দিই। সত্যিকারভাবে বিবেচনা করলে কেউ পায় কেউ পায় না। অথচ যে পাওয়ার যোগ্য নয়, তার দাবিই প্রথম। তার তদবিরই প্রধান। এক গ্রুপের তো কোটি টাকা ঋণ দরকার। এই গ্রুপ তো সরকারের কাছে বলেইছে যে তাদের ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ দরকার। এই পরিমাণের ঋণ দেয়া শুরু হলে ১ লাখ কোটি টাকার ঋণ পাবে কয়জন? এতে ছোট ছোট ও মাঝারিদের অবস্থা কী দাঁড়াবে? তারা টাকা পাবে কোত্থেকে? অথচ সরকার ছোট-বড় সবার জন্য আলাদাভাবে, রফতানিকারকদের জন্য আলাদাভাবে ঋণের বরাদ্দ ঘোষণা করেছে। দেখা যাচ্ছে হতাশাগ্রস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী, দিশেহারা ব্যাংক মালিক, তাগিদকারী কেন্দ্রীয় ব্যাংক, প্রভাবশালী বড় বড় ঋণগ্রহীতার পারস্পরিক কর্মকাণ্ডে এক বিশৃঙ্খলা অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার উপক্রম; যা প্রণোদনা প্যাকেজ কার্যকর করার ক্ষেত্রে বড় বাধা। এদিকে আমানতের সমস্যা তো আছেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছু কিছু রিফিন্যান্স করবে। করবে বললেই তো হয় না। টাকাটা তো ব্যাংকগুলোকে ধরিয়ে দিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রচুর ফরেন একচেঞ্জ রিজার্ভ আছে। মুশকিল হচ্ছে, এ রিজার্ভ বিপদের দিনের জন্য। আবার সব টাকা সরকারেরও নয়। আমার মনে হয়, সরকারকে একটা বিষয় পরিষ্কার করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও তা করতে হবে। আজকের খেলাপি ঋণ, আজকের দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ এবং আগামী দিনের সম্ভাব্য খেলাপি ঋণের বোঝা কীভাবে, কে বহন করবে? শত হোক এসব টাকা আমানতকারীদের টাকা। বোঝা যাচ্ছে যে ঋণ এখন স্ট্রেসড লোন হিসেবে গণ্য করতে বলা হয়েছে, তা সহসা ব্যাংকের ঘরে ফিরে আসবে, তার সম্ভাবনা ক্ষীণ। উপরওয়ালা না করুন, বর্তমান অবস্থা থেকে ব্যবসায়ীদের, শিল্পপতিদের মুক্তি পেতে বেশ সময় লাগবে। এসএমই ব্যবসা, পরিবহন ব্যবসা, হোটেল-মোটেল ব্যবসা, ট্যুরিজম ব্যবসা এবং এমন ধরনের যে ব্যবসাগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের সোজা হয়ে দাঁড়াতে অনেক সময় লাগবে। এই দুশ্চিন্তাই ব্যাংকারদের। তখন কী হবে? এখনকার খেলাপি ঋণের জন্যই এত গালাগাল, যখন খেলাপি ঋণ হবে আরো আরো বেশি, তখন কী অবস্থা দাঁড়াবে? তবে কি খেলাপি ঋণ বলে কিছু থাকবে না? সংজ্ঞা পরিবর্তন করে সব ঠিকঠাক করা হবে? এসব প্রশ্নের জবাব আমার কাছে নেই। আপাতত এটুকু বুঝি ব্যাংকারদের প্রভাব-প্রতিপত্তির ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করতে দেয়া উচিত। ঊর্ধ্বচাপ, পার্শ্বচাপ থেকে তাদের মুক্ত করুন। সম্ভাব্য খেলাপি ঋণের কথা অগ্রিম ভেবে রাখুন। কর্মচারী-কর্মকর্তাদের চাকরির নিশ্চয়তা দিন, যাতে তারা শান্তিতে কাজ করতে পারেন। ব্যাংকের আমানত বাড়ানোর ব্যবস্থা করুন। মধ্যবিত্তের সঞ্চয় বাড়ানোর ব্যবস্থা করুন, যাতে তারা ব্যাংকে টাকা রাখতে উদ্বুদ্ধ হয়। সরকারের প্রণোদনার টাকা যাতে সব প্রভাবশালী ঋণদাতার পকেটে না যায়, তা নিশ্চিত করুন। অফিসাররা যাতে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল, অ্যাসেসমেন্ট নিশ্চিত করতে পারেন তার নিশ্চয়তা দরকার। কারণ গ্রাহকরা ১০০ টাকা দরকার হলে ২০০ টাকা চান। এটা বন্ধ করতে হবে। কোলেটারেল যাতে ব্যাংক ঠিকমতো নিতে পারে। এক্সিম ব্যাংকের মতো অবস্থা করে কেউ যেন ঋণ না নিতে পারে। এসএমই খাতের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। তাদের সর্বনাশ সবচেয়ে বেশি হয়েছে। যদি এসব আমরা করতে পারি তাহলে খেলাপি ঋণের অতিরিক্ত বোঝা থেকে মুক্ত থাকতে পারব। নতুবা অনাদায়ী ঋণের টাকাকে ‘কস্ট অব ডেভেলপমেন্ট’ হিসেবে দেখার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। শত হোক আমরা বাজার অর্থনীতি অনুসরণ করছি। এখানে নিম গাছের কাছে আম্রফল চেয়ে কোনো লাভ হবে না।
ড. আর এম দেবনাথ: অর্থনীতি বিশ্লেষক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক