আমি সুন্দর, কেন ত্বক উজ্জ্বল করতে চাইব?

বণিক বার্তা ডেস্ক

মাত্র একটি শব্দ ড্যারেন স্যামির জন্য ফিরিয়ে আনল কষ্টদায়ক ও অস্বস্তিকর এক স্মৃতি: কালু। 

আফ্রিকান-আমেরিকান জর্জ ফ্লয়েড পুলিশের নির্যাতনে নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে নেটফ্লিক্সে সম্প্রতি প্রকাশিত এক শো দেখছিলেন স্যামি, যাতে তিনি শুনছিলেন, কৌতুক অভিনেতা হাসান মিনহাজ ‘কালু’ শব্দটির ব্যাখ্যা করছেন, উপমহাদেশে যা একটি বর্ণবাদী গালি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

ব্যস, এটুকুই স্যামিকে ফিরিয়ে নিল ২০১৩ ও ২০১৪ সালে, যখন তিনি সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে আইপিএল খেলেছেন। বিশেষ করে, ওই সময় তাকে ও শ্রীলংকান ক্রিকেটার থিসারা পেরেরাকে ‘কালু’ নামে ডাকা হতো। দুজনেরই গায়ের রঙ কালো। 

এ ব্যাপারে থিসারা পেরেরা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। ডাকনামটি এতই বেশি ব্যবহৃত হচ্ছিল যে স্যামি নিজেই নিজের ক্ষেত্রে এটি ব্যবহার করতেন। তার ধারণা ছিল, কালু নামের অর্থ- তেজি ঘোড়া। 

ওই সময় স্যামি ও তার সতীর্থরা আইপিএল প্লে-অফে উঠেছিলেন। স্যামির মতে, তাদের সাফল্যের নেপথ্যে ছিল ঐক্য, সতীর্থদের মধ্যে অন্তরঙ্গতা ও পরস্পরের প্রতি আস্থা এবং লড়াকু মানসিকতা।

২০২০ সালে এসে আবারো স্মরণে এল হায়দরাবাদ। আসলে কালু শব্দটি কী অর্থে ব্যবহৃত হতো, তা ঘুরে ফিরছে তার মনে। ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা ভিডিওতে তিনি সেই সতীর্থদের খুঁজছেন যারা তাকে ওই ডাকনামে সম্বোধন করতে, তিনি তাদের সঙ্গে শব্দটি নিয়ে কথা বলতে চান। স্যামি জানান, একজন সতীর্থ অবশ্য তাকে ভাইয়ের মতো ভালোবাসতেন। যাই হোক, শব্দটি উপযুক্ত ছিল না এবং এটি আর ব্যবহৃত হওয়া উচিত নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। তার কথায়, ‘এটি এমনই এক সময় এলো যখন বর্ণবাদ ও অবিচার ও প্রথাগত বর্ণবাদ নিয়ে সবাই জাগ্রত।’

স্যামির সামাজিক মাধ্যম অ্যাকাউন্ট থেকে দেখা যায়, অনেক মানুষই এই ডাকনামকে সমর্থন করছেন এবং তারা ডাকছেনও। তাদের যুক্তি, এটি মোটেও বর্ণবাদী শব্দ নয় এবং শুধুই একটি ডাকনাম। 

যাই হোক, স্যামি বলছেন, চলমান ব্যবহারই বলছে এখনো বড় একটি অংশের (দক্ষিণ এশিয়া) সংস্কৃতিতে শিক্ষার প্রয়োজন। তার কথায়, ‘এ বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা দেয়া ও কথা বলা গুরুত্বপূর্ণ, যা সংস্কৃতির মধ্যে সচেতনতা নিয়ে আসবে।’

২০১৪ সালে হায়দরাবাদে স্যামির সতীর্থ হিসেবে খেলা পারভেজ রসুল বললেন, স্যামির ক্ষেত্রে এই শব্দটি ব্যবহৃত হলে তা আসলেই ‘দুঃখজনক’। তিনি বলেন, ‘কেউ যদি স্যামির ক্ষেত্রে এই শব্দ ব্যবহার করে, তা দুঃখজনক। আমি দলের অংশ ছিলাম, তার নেতৃত্ব খেলতে ভীষণ উপভোগ করেছি। তিনি অত্যন্ত আমুদে একজন মানুষ। আমার সামনে অবশ্য এমন কথোপকথন হয়নি। কিন্তু কেউ যদি মানহানিকর শব্দটি তার ক্ষেত্রে ব্যবহার করে তবে তা দুঃখজনক।’

১৯৫০ সালে সরকারিভাবে ভারতে বর্ণপ্রথা রহিত করা হলেও সামাজিকভাবে এখনো প্রকটভাবে এটি বিদ্যমান। কোন জাতে জন্ম নেয়, সেটি ভারতে একজনের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়-সমাজের কোথায় তার স্থান হবে, কী কাজ করবে এবং কাকে সে বিয়ে করবে। একেবারে নিচু স্তরের মানুষদের বলা হয় ‘অচ্ছুৎ’।

ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি কিংবা অন্যান্য রং ফর্সা করার ক্রিমের বিজ্ঞাপন করায় বলিউডের অনেক তারকা সমালোচনার মুখে পড়েছেন। হিন্দুস্তান ইউনিলিভার ঘোষণা দিয়েছে, ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি’ থেকে তারা ফেয়ার শব্দটি সরিয়ে নেবে। তারা স্বীকার করে নিয়েছে, অতীতে প্রচারণার সময় তারা ব্যবহার করেছে-ত্বক ফর্সা ও উজ্জ্বল হলে কী সুবিধা মেলে। এ নিয়ে স্যামি, ‘কোথাও যদি এটা প্রচার করা হয়, তুমি যত উজ্জ্বল, ততই সুন্দর, সেখানে নিশ্চয়ই পদ্ধতিতে একটা সমস্যা আছে। আমার মতো দেখতে মানুষদের নিয়ে কী বলবেন? তারা কি সুন্দর নয়? কারণ আমার বিশ্বাস, আমি সুন্দর। তবে কেন সুন্দর হওয়ার জন্য ত্বক ফর্সা ও উজ্জ্বল করতে চাইব আমি। এটা ভুল। এটা কঠিন বিষয়, কিন্তু এ নিয়ে মানুষকে শিক্ষা দিতে হবে।’

ক্রিকেটে সাদা-কালো ভেদাভেদ নিয়েও কথা বললেন স্যামি। বিশ্বের খুব কম দেশেই কালো, এশিয়ান ও সংখ্যালঘু জাতির কোচ রয়েছে। স্যামির মতে, খেলাটির উন্নয়নে এ জায়গাটিতে সংস্কার আনতে হবে। তার কথায়, ‘বিশ্বব্যাপী ক্রিকেটে কতজন কৃষ্ণাঙ্গ কোচ দেখেছেন? আপনি কি কখনো অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড কিংবা নিউজিল্যান্ডে অন্য বর্ণের কোচ দেখেছেন? তারা ভালো কিনা, সেটা দেখানোর সুযোগ না দিলে আপনি কীভাবে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করবেন। আমরাও ভালো, তা প্রমাণের সুযোগ দিন আমাদের।’

ওয়েস্ট ইন্ডিজের টি২০ বিশ্বকাপজয়ী দলের অধিনায়ক আরো বলেন, ‘দেখুন, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, দক্ষিণ আফ্রিকা কিংবা পাকিস্তানে আমরা একজন শ্বেতাঙ্গ কোচকে বরণ করে নেই। আমাদের জন্য গোটা বিশ্বকে মেনে নেয়া কেন এতটা সহজ এবং আমাদের কতিপয়কে মেনে নেয়া কেন অন্যদের জন্য এত কঠিন?’

সূত্র: সিএনএন

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন