এন্ড্রু কিশোর আর নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক

জনপ্রিয় প্লেব্যাক শিল্পী এন্ড্রু কিশোর আর নেই। আজ সোমবার সন্ধ্যার দিকে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বণিক বার্তাকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন এই শিল্পীর ঘনিষ্ঠজন মোমিন বিশ্বাস। তিনি বলেন, দাদা আর নেই। আজ সন্ধ্যা ৭টার দিকে তিনি মারা গেছেন। 

ব্লাড ক‌্যান্সারের সঙ্গে দীর্ঘ ১০ মাস ধরে লড়াই করছিলেন আটবার জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত এ কণ্ঠশিল্পী। সোমবার সকাল থেকে তার শারীরিক অবস্থার মারাত্মক অবনতি হতে থাকে। তাকে অক্সিজেন দিয়ে আইসিইউতে রাখা হয়। কিন্তু সন্ধ্যার দিকে মারা যান তিনি।

রাজশাহীতে বোন ডা. শিখা বিশ্বাসের ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন ছিলেন এন্ড্রু কিশোর।

আশির দশকে বাংলাদেশের সংগীত জগতে নতুন এক ধারার পথিকৃৎ সংগীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোর দীর্ঘদিনের চিকিৎসা শেষে করোনার এই সংকটের মধ্যেই গত ১১ জুন রাতে একটি বিশেষ ফ্লাইটে সিঙ্গাপুর থেকে দেশে আসেন। এরপর থেকে তিনি জন্মস্থান রাজশাহীতে বোনের বাসাতে থেকেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিচ্ছিলেন।  

গতকাল রোববার (৫ জুলাই) বিকালে হঠাৎ করেই এন্ড্রু কিশোরের শারীরিক অবস্থার বেশ অবনতি হয়। চারদিকে তার মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়ে। বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়েন এই শিল্পীর পরিবারের লোকজন। এন্ড্রু কিশোরের পরিবারের এক সদস্য তখন জানান, তার অবস্থা সংকটজনক।

আজ শিল্পীর স্ত্রী লিপিকা এন্ড্রু ফেসবুক পোস্টে বলেন, জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে সিঙ্গাপুরের চিকিৎসক জানালেন, তার শরীরে লিম্ফোমা ক্যানসার ফিরে এসেছে। এরপর তিনি আর সিঙ্গাপুর থাকতে চাননি। চিকিৎসকদের বলেন, তাকে যেন বাংলাদেশে ফিরে আসার অনুমতি দেয়া হয়। তিনি জানান, দেশের মাটিতেই মৃত্যুবরণ করতে চান তিনি। 

গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর শরীরে নানা ধরনের জটিলতা নিয়ে অসুস্থ অবস্থায় উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে দেশ ছেড়েছিলেন এই সংগীতশিল্পী। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর গত ১৮ সেপ্টেম্বর তাঁর শরীরে নন-হজকিন লিম্ফোমা নামক ব্লাড ক্যানসার ধরা পড়ে। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক লিম সুন থাইয়ের অধীনে তার চিকিৎসা শুরু হয়। সেখানে কয়েক মাস একনাগাড়ে তার চিকিৎসা চলে। 

এন্ড্রু কিশোরের অসুস্থ হওয়ার পর ব্যয়বহুল এই চিকিৎসার খরচ জোগাতে বিক্রি করে দেয়া হয় রাজশাহী শহরে তার কেনা ফ্ল্যাটটি। চিকিৎসায় সহায়তার হাত বাড়ান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। শিল্পীর পরিবারের পাশাপাশি সংগীতশিল্পী, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এবং প্রবাসীরা এগিয়ে এসেছেন।

এন্ড্রু কিশোরের জন্ম রাজশাহীতে। সেখানেই তার শৈশব-কৈশোর কেটেছে। এন্ড্রু কিশোর প্রাথমিকভাবে সংগীতের পাঠ শুরু করেন রাজশাহীর আবদুল আজিজ বাচ্চুর কাছে। এরপর চলে আসেন  রাজধানীতে।

এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি রবীন্দ্রসংগীত, লোকগান, নজরুলসংগীত, আধুনিক গান  ও দেশাত্মবোধক গানে রেডিওর তালিকাভুক্ত শিল্পী হন এন্ড্রু কিশোর।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন এন্ড্রু কিশোরের জনপ্রিয়তা রাজশাহীর বাইরে ছড়িয়ে পড়ে৷ ১৯৭৭ সালের দিকে ঢাকা থেকে সিনেমার প্লেব্যাক গাইবার ডাক পড়ে৷ তখনকার বিখ্যাত সুরকার আলম খানের সংগীত পরিচালনায় মেইল ট্রেন নামের একটি চলচ্চিত্রে ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’ গান দিয়ে তার সিনেমার প্লেব্যাক গায়কের জীবন শুরু৷ এরপর পরিচালক বাদল রহমানের ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ নামের শিশুতোষ চলচ্চিত্রে ‘ধুম ধারাক্কা' গানটি রেকর্ড হয়৷ এর মাঝে আরো কিছু গান৷

১৯৭৯ সালে এ জে মিন্টু পরিচলিত ‘প্রতীজ্ঞা’ চলচ্চিত্রের ‘এক চোর যায় চলে’ গানটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। এরপরই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাবস্থাপনা বিষয়ে পড়াশুনা শেষ করে ১৯৮০ সালের শুরুতে এন্ড্রু গান গাইবার জন্য ঢাকাতে স্থায়ী হন। আর চলতে থাকে তার সংগীত সাধনা।

‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘ভালোবেসে গেলাম শুধু’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্য খানে’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান', ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা’, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’, ‘পড়ে না চোখের পলক’, ‘ওগো বিদেশিনী’, ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’, ‘আমি চিরকাল প্রেমের কাঙাল’সহ আরও বেশ কিছু জনপ্রিয় গান গেয়েছেন এই শিল্পী। 

এন্ড্রু কিশোর সংগীতজীবনের স্বীকৃতি হিসেবে আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। এ ছাড়াও পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে। তাঁরা অস্ট্রেলিয়া থাকেন। মেয়ে মিনিম এন্ড্রু সংজ্ঞা সিডনিতে গ্রাফিকস ডিজাইন ও ছেলে জে এন্ড্রু সপ্তক মেলবোর্নে ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে পড়াশোনা করছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন