বঙ্গোপসাগরে আবারো সক্রিয় মানব পাচারকারী চক্র

তাসনিম মহসিন

আবারো সক্রিয় হয়ে উঠেছে বঙ্গোপসাগরভিত্তিক মানব পাচারকারী চক্র। চলতি বছর বঙ্গোপসাগরের উপকূল দিয়ে এক হাজারের বেশি মানুষ মানব পাচারের শিকার হিসেবে শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে শুধু জুনেই ৬৬৯ জনের পাচার হওয়ার হিসাব পাওয়া গিয়েছে বলে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের (ইউএনএইচসিআর) তথ্যে উঠে এসেছে। পাচারকৃতদের সবাই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীভুক্ত, যাদের অনেকেরই যাত্রা হয়েছিল বাংলাদেশ থেকে।

সম্প্রতি ইউএনএইচসিআর ইন্দোনেশিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত মাসে দেশটির কোস্টগার্ড মানব পাচারের শিকার ৯৯ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে। তারা সবাই নৌকায় সাগর পাড়ি দিয়ে ইন্দোনেশিয়া পৌঁছেছে। তাদের ৯৭ জনই আগে বাংলাদেশের উদ্বাস্তু শিবিরে ইউএনএইচসিআরের মাধ্যমে নিবন্ধিত হয়েছিল।

তবে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে যায়নি বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী . কে আব্দুল মোমেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ইউএনএইচসিআর ইন্দোনেশিয়ার তথ্য নিয়ে আমাদের সন্দেহ রয়েছে। বাংলাদেশকে সবাই একটা ডিপো মনে করে। যেখানেই রোহিঙ্গা থাকে, সবাইকেই বাংলাদেশে ঠেলে দিতে চায়। আর অবস্থা সৃষ্টির জন্য অনেকেই একসঙ্গে কাজ করছে। সুতরাং তারা যা বলে, সব ঠিক না। মানুষগুলো বাংলাদেশ থেকে যায়নি।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে যেসব রোহিঙ্গা রয়েছে, তাদের তালিকা বাংলাদেশে রয়েছে। আমাদের তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে। আর রোহিঙ্গারা মূলত মিয়ানমারের, এটাই সত্য। তাদের বিষয়ে আমাদের কোনো দায়িত্ব নেই, কোনো দায়বদ্ধতাও নেই। যেটুকু দায়বদ্ধতা আমাদের রয়েছে, সে দায়বদ্ধতা সারা পৃথিবীরও রয়েছে। আর ইন্দোনেশিয়া তাদের আশ্রয় দিয়েছে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা হিসেবে।

গত মাসের শুরুতে মালয়েশিয়ার উপকূলে ২৭০ থাইল্যান্ডের উপকূলে ৩০০ জনের মতো রোহিঙ্গাকে সাগরে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। তারা দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে নৌকাতেই অবস্থান করছিল। এর মধ্যে মালয়েশিয়ার উপকূলে রোহিঙ্গাদের বহনকারী নৌকা শুরুতে ঢুকতে দেয়া হয়নি। অবস্থায় জনাপঞ্চাশেক রোহিঙ্গা সাগরে ঝাঁপ দিয়ে মালয়েশিয়ার মাটিতে গিয়ে উঠলেও শেষ পর্যন্ত তারা পার পায়নি। স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হতে হয় তাদের। এসব রোহিঙ্গাকে গ্রহণের জন্য মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে বাংলাদেশের ওপর চাপ দেয়া হলেও তাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে ঢাকা।

পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন গতকাল এক অনুষ্ঠানে দেশে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু আগমনের ফলে সৃষ্ট ঝুঁকি নিয়ে বলেন, কক্সবাজার বা ক্যাম্প এলাকা খুবই ছোট জায়গা। সেই ছোট জায়গায় সব মিলিয়ে ১১ লাখের মতো মানুষ এসেছে। ফলে এখানে পাহাড়ে যে গাছপালা ছিল, সেগুলো কেটে ফেলা হলো। পাহাড়গুলো কেটে ফেলা হলো। বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ ক্যাম্প এটি। এখানে এত ছোট জায়গায় এতগুলো মানুষ থাকার কারণে নিরাপত্তাজনিত একটি ঝুঁকি থেকেই যায়। বিশেষ করে মানব পাচারের সমস্যা আমরা দেখছি। বিভিন্ন সময়ে এরা মানব পাচারের শিকার হয়ে বিভিন্ন দিকে পাড়ি জমাচ্ছে। যেমন সম্প্রতি দেখেছি যে অনেকে নৌকায় করে এখান থেকে, হয়তো কেউ কেউ মিয়ানমার থেকেও যুক্ত হয়ে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ডে পাড়ি জমাচ্ছে। তারা এক ধরনের বিপদগ্রস্ত হচ্ছে। এখানে শিশু পাচার হতে পারে, তরুণ-নারী পাচার হতে পারে। এখানে মাদক পাচার হতে পারে। এখানে ছোটখাটো আগ্নেয়াস্ত্র পাচার হতে পারে। আর এখানে অনেক তরুণ রয়েছে, ফলে রেডিক্যালাইজেশনের ঝুঁকিও রয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কূটনীতিকরা বলছেন, জুনে উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গাদের বেশির ভাগই যাত্রা করেছিল ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু বিশ্বজুড়ে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেয়ায় লকডাউন সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপের ফলে রোহিঙ্গারা তাদের গন্তব্যে পৌঁছতে পারেনি। নৌকায় থাকতে হয়েছে দীর্ঘদিন। অতীতে থাইল্যান্ডে মানব পাচারের ঘটনার মতো এবারো যদি মানব পাচারকারী চক্র সফলভাবে রোহিঙ্গাদের নিয়ে তীরে পৌঁছাতে পারত, তাহলে তারা আরো গ্রাহক জোগাড় করতো। এখন পর্যন্ত কতজন পাচারকারী চক্রের শিকার হয়েছে, তা সঠিক করে বলা মুশকিল। তবে চলতি বছরে এক হাজারের বেশি মানুষ বঙ্গোপসাগরে নৌকায় শনাক্ত করা গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় বসবাসরত উদ্বাস্তুদের বড় একটি অংশ বয়সে তরুণ। উদ্বাস্তু জীবনে তারা নিজেদের কোনো ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে না। শুরুতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার সময় তারা ছিল ক্ষুধার্তঅসহায় ভীত অবস্থায়। কিন্তু এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। শিবিরের ভেতরের জীবনকে তারা আটকাবস্থা হিসেবেই বিবেচনা করছে। কারণে রোহিঙ্গাদের নিয়ে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকির দিক থেকে জঙ্গিবাদ, মানব পাচার মাদকপাচারই সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। এসব শিবিরে অবস্থানরত রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রলোভনে পড়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।

জানা গিয়েছে, স্থানীয় পাচারকারী চক্রের সহায়তায় শিবিরের উদ্বাস্তু রোহিঙ্গারা সাগর পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করছে। এজন্য তাদের মাথাপিছু অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে - লাখ টাকা করে। অর্থ জোগাড় করতে গিয়ে তারা জড়িয়ে পড়ছে নানা ধরনের অপরাধে। তাদের কেন্দ্র করেই গড়ে উঠছে মিয়ানমারের সীমান্ত দিয়ে আসা ইয়াবা বিক্রি, শিবিরের নারী শিশু পাচারসহ অস্ত্র চোরাচালানকারীদের চক্র। মূলত অবৈধ মাদক অস্ত্র ব্যবসার মাধ্যমে অর্থ জোগাড় করে তারা সাগরপাড়ি দিতে নৌকায় উঠে পড়ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন