আলোকপাত

ওয়ার্ক ফ্রম হোম: নতুন বাস্তবতা

শওকত হোসেন

পৃথিবীতে কভিড-১৯-এর লক্ষণ ধরার পর অর্ধবৎসর পার হয়েছে। কিন্তু আমাদের মনে হয় যেন অর্ধযুগ কেটে গেছে। বিমান চলাচল বন্ধ, বিদেশ ভ্রমণ নিষিদ্ধ বা নিয়ন্ত্রিত। দোকানপাট সীমিত আকারে চলছে। কলকারখানা বন্ধ। যানবাহন সীমিত। হোটেল, রেস্টুরেন্ট, সেলুন, বিউটি পার্লার বন্ধ। খেলা, সিনেমা হল বন্ধ। বিয়ে, জন্মদিন, ধর্মীয় উৎসব পালন বন্ধ বা সীমিত। সবখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার তাগিদ।

কিন্তু জীবন থেমে থাকে না। হাসপাতাল খোলা রাখতে হয়; বরং এখন আরো বেশি প্রয়োজনীয় প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। মুদি দোকান, সবজি, মাছ-মাংসসহ খাবার, ওষুধ বিক্রয় সরবরাহ চাহিদা বজায় আছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী, বর্জ্য ব্যবস্থাপক, বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ বন্ধ করার উপায় নেই। কৃষক মাঠে ফসল ফলিয়ে যাচ্ছেন। ব্যাংক চালু আছে নতুবা অর্থনীতির চাকা অচল হয়ে যাবে। বাজার চাহিদা মেটাতে কিছু কারখানায় উৎপাদন চালু আছে। পণ্য পরিবহন চালু আছে ভোক্তার দুয়ারে পণ্য পৌঁছে দেয়ার সুবিধার্থে।

বাংলাদেশে জুন থেকে অফিস খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকারি অফিস খুলেছে। সীমিত আকারে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে। খুলেছে অনেক বেসরকারি অফিসও। অনেকের ব্যবসা বন্ধ হওয়ার উপক্রম। কর্মী ছাঁটাই করেছে বা করছে। অনেকের কাজ আছে কিন্তু অফিস খোলেনি। এখনো হোম অফিস করছে। তবে মার্চের মাঝামাঝি থেকে মে পর্যন্ত যারা কাজ করেছে, সবাই হোম অফিস মুডেই করেছে।

বিশ্বব্যাপী পরিবর্তন এসেছে কাজের ধরনে। টুইটার ঘোষণা করেছে, তাদের কর্মীরা চিরজীবন ঘর থেকে কাজ করতে পারবে। গুগল জানিয়েছে, তারা ২০২১ সাল পর্যন্তঘর থেকে কাজঅনুসরণ করবে। ফেসবুক জুলাইয়ে খুলবে। সপিফাই ২০২০ সালে অফিস চালু করবে না। হোম অফিসের ধারণা করোনাপূর্বেও ছিল। অনেক কাজ বাসায় বসে করা যায়। অনেক প্রতিষ্ঠান কাজ (সফটওয়্যার প্রোগ্রামার, গবেষক, কনটেন্ট রাইটার) পরিস্থিতি (অসুস্থ, সন্তানসম্ভবা বা নবজাত শিশুর মা) অনুযায়ী হোম অফিস অনুমোদন দিত।

কভিডের জন্য বাধ্য হয়ে অনেক অফিসওয়ার্ক ফ্রম হোমপদ্ধতি শুরু করেছে। এর অনেক সুবিধা আছে, যেগুলো সুযোগে উন্মোচন হয়েছে বা হবে। যেমন যাতায়তের জন্য কমপক্ষে (আসা-যাওয়ায় আধা ঘণ্টা করে) ঘণ্টা থেকে ( ঘণ্টা করে) ঘণ্টা পর্যন্ত সময় ব্যয় হতো। একজন কর্মীর জন্য এটা সম্পূর্ণ নস্ফিলা সময়। কেউ সময়ের জন্য পারিশ্রমিক দিত না কিংবা কোনো অর্থকরী বা ফলদায়ক কাজেও ব্যয় হতো না। অনেক দেশে লোকজন যাত্রার সময়টা বই পড়ে কাটায়। আমাদের দেশে বই পড়ার অভ্যাস কম বলে সেটাও হয় না। বেঁচে যাওয়া সময়টা পরিবারকে দিতে পারলে একজন কর্মীর পরিবার কর্মজীবনের সমন্বয় ঘটবে। পরিবারের প্রয়োজনে অনেক দক্ষ কর্মী, বিশেষ করে নারীরা চাকরি ছেড়ে দেন। ওয়ার্ক ফ্রম হোম সুবিধা থাকলে তারাও কর্মক্ষেত্রে থাকতে বা ফিরতে পারবেন। চাকরিদাতার দিক থেকে ভাবলে, কিছু কর্মী বাসা থেকে কাজ করলে অফিসের জায়গা কম লাগবে। ফলে ভাড়া ব্যয় কম হবে দুটি কারণে, জায়গা কম লাগবে। দ্বিতীয়ত, সব বা অনেক প্রতিষ্ঠান বাসা থেকে কাজ চালু করলে বাণিজ্যিক পরিসরের চাহিদা কমে যাবে। ফলে ভাড়ার হার কমবে। ঢাকায় বাণিজ্যিক ভাড়ার হার এমনিতেই অস্বাভাবিকভাবে বেশি। 

করোনাকালে দৈবাৎ প্রয়োগের ফলে অনেক বা কিছু কাজ যে বাসা থেকে নিখুঁতভাবে করা যায়, নিয়োগকর্তা সেটা উপলব্ধি করতে পারবেন। করোনা চলে গেলেও সেই ধারাটা বজায় থাকবে। বাসা থেকে কাজ ফলপ্রসূ করার জন্য নিচের কিছু জিনিস মাথায় রাখতে হবে:

নীতিমালা: ‘বাসা থেকে কাজ’-এর জন্য একটা নীতিমালা তৈরি করতে হবে। কী ধরনের কাজ বাসা থেকে করা যাবে, কে অনুমোদন দেবে, কীভাবে অনুমোদন পেতে হবে ব্যাপারগুলো ব্যক্ত করতে হবে। কর্মী কী করবেন, কীভাবে করবেন, কাজের হিসাব কীভাবে বুঝিয়ে দেবেন, উপস্থিতি কীভাবে গণনা করা হবে, কাজ কীভাবে মনিটরিং করা হবে, সেগুলো স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। কর্মীর কাছে অফিসের চাহিদা ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে।  

শুরু এবং শেষের সীমারেখা: অফিস শুরু এবং শেষের সময় স্পষ্ট করে দিতে হবে। অনেক অফিস ফ্লেস্কিবল অফিস সময় অনুসরণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে কর্মঘণ্টা কর্মসময়ের সীমারেখা নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। যেমন সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা। এই সীমারেখার মধ্যে যে কেউ ঘণ্টা কাজ করবেন। কেউ ৯টা-৫টা আবার কেউ ১০টা-৬টা বেছে নিতে পারেন। কোন কর্মী কোন সময় স্লট বেছে নিতে চান, তা আগেভাগে স্পষ্ট করে নিতে হবে। অনেক তত্ত্বাবধায়ক করোনাকালে যেকোনো সময় মিটিং ডেকে বসেন। হয়তো ভাবেন, বাসায় তো আছে, অসুবিধা কী? এটা ঠিক না। কর্মী একসময় ভাবতে থাকবেন, সারা দিনই তো কাজ করছি। পরিবারের অন্য সদস্যরাও তার ওপর বিরক্ত হবে। বলে বসতে পারে, তুমি তো সারা দিনই অফিস করছ! বাসায় থেকে কী লাভ হলো? কোনো জরুরি কিছু সামনে চলে এলেই কর্মীর সময়ে (অফিস সময়ের বাইরে) তাকে ডাকা যেতে পারে। নতুবা ব্যাপারটা পরের দিনের জন্য তুলে রাখা উচিত।

প্রযুক্তিগত সহায়তা: বাড়ি থেকে কাজ মানে প্রযুক্তির ওপর নির্ভরতা। কর্মীর বাড়িতে পর্যাপ্ত সুবিধা আছে কিনা দেখতে হবে। কর্মী পাবলিক ওয়াই-ফাই ব্যবহার করলে ডাটা সিকিউরিটি ব্যাহত হতে পারে। অফিসের আইটি বিভাগের কর্মী বাসায় গিয়ে সব ঠিক করে দিতে পারেন। সভার জন্য জুম, গুগল হ্যাং আউট, মাইক্রোসফট মিট, স্ল্যাক, স্কাইপি, Nextiva ইত্যাদি সফটওয়্যার পাওয়া যায়। রিমোট কাজে তিনটি জিনিস প্রয়োজন: কাজ বুঝিয়ে দেয়া, মনিটরিং করা, যোগাযোগ করা। এসব কাজের জন্য বিভিন্ন সফটওয়্যার যেমন Trello, desk time, OKR, Hubstaff, Monday, Assembly ইত্যাদি পাওয়া যায়।

ডাটা সিকিউরিটি: কর্মী অনেক গোপন বা দরকারি তথ্য নিয়ে কাজ করতে পারেন। যেমন গ্রাহকের তথ্য, কোম্পানির হিসাব, কৌশলগত পরিকল্পনা ইত্যাদি। কোনো কর্মীর কাছ থেকে এসব তথ্য-উপাত্ত হ্যাক হয়ে যেতে পারে, যা কোম্পানির ব্যবসা বা সুনাম হানিকর। VPN সংযোগের মাধ্যমে ডাটার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। কর্মী যে ল্যাপটপ বা কম্পিউটারে অফিসের কাজ করবেন, তা যেন ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহূত না হয়।

যোগাযোগ: কর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা প্রয়োজন। অফিসে কর্মীরা শুধু কাজই করতেন না, আড্ডা দিতেন, চা বা কফি খেতে যেতেন, দুপুরে লাঞ্চ টেবিলে একে অন্যের সুখ-দুঃখের ঘটনা শেয়ার করতে পারতেন, খুনসুটি করে বিনোদন পেতেন। সারা দিন বাসায় থেকে কর্মীদের একঘেয়েমি চলে আসতে পারে। গ্রুপ চ্যাট বা আড্ডার মাধ্যমে কাজের বাইরেও সামাজিক মেলামেশার সুযোগ দেয়া উচিত।

মনিটরিং: ওয়ার্ক ফ্রম হোমের একটি বড় সুবিধা কর্মীর ওপর আস্থা স্থাপন। অনেক কর্মী, যারা স্বতঃপ্রণোদিতভাবে কাজ করেন, তাদের জন্য এটি আকাঙ্ক্ষিত তৃপ্তিদায়ক। প্রতিষ্ঠানকে বড় করতে ধরনের কর্মীর অবদান বিশাল। ২৫-৩০ শতাংশ কর্মী স্বতঃপ্রণোদিত হলে প্রতিষ্ঠানটি তরতর করে এগিয়ে যাবে। যদি প্রণোদনা মূল্যায়ন পদ্ধতি সঠিক হয়, আরো ২৫-৩০ শতাংশ স্বতঃপ্রণোদিতদের অনুসরণ করবে। বাকি ৩০-৪০ শতাংশ গড়পড়তা হলেও প্রতিষ্ঠান এগিয়ে যাবে। ইট-কাঠের অফিসে সুপারভাইজার দ্বিতীয় তৃতীয় গ্রুপকে রুমে ডেকে বা নিজে হাঁটতে হাঁটতে এসে তাদের কাজকর্ম দেখতে পারেন। হোম অফিসে সেটা সম্ভব নয়। অনেক সফটওয়্যার পাওয়া যায়, যেটা কর্মী কতক্ষণ কম্পিউটারে বসে আছেন, তা মনিটর করে। ক্যামেরার মাধ্যমে কর্মীর ছবি নেয় অথবা জিপিএসের মাধ্যমে কর্মীর অবস্থান নির্ণয় করা যায়। কিন্তু এভাবে গত্বাঁধা বা রুটিন কাজগুলো মনিটর করা যায়। উঁচু স্তরের কাজগুলোর জন্য কি পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটরের (কেপিআই) ওপর নির্ভর করতে হবে। সুপারভাইজর আর কর্মীর মধ্যে কেপিআই বিষয়ে আগেই সমঝোতা হতে হবে। অহেতুক বা বাড়াবাড়ি রকমের মনিটরিং অনেক ক্ষেত্রে কর্মীর জন্য বিরক্তি বা নিরুৎসাহের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। 

পর্যালোচনা: ওয়ার্ক ফ্রম হোম নতুন ধারণা বিধায় ত্রুটিমুক্ত কোনো পদ্ধতি এখনো গড়ে ওঠেনি। অবশ্য কোনো পদ্ধতিই শতভাগ ত্রুটিমুক্ত নয়। তাছাড়া প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সংস্কৃতি, কাজের ধরন, কর্মীর মনমানসিকতার ওপরে পদ্ধতিটি বেছে নিতে হবে। পদ্ধতিটি ভালো না খারাপ কর্মী নিয়োগকর্তাই ভালো বলতে পারবেন। প্রাথমিক পর্যায়ে ঘন ঘন পর্যালোচনার মাধ্যমে ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো সংশোধন করতে হবে।

ওয়ার্ক ফ্রম একটি নতুন কর্ম পদ্ধতি, নবজীবনধারা। আমাদের সম্পদের (বাণিজ্যিক পরিসর, অফিস ডেকোরেশন) অনেক সাশ্রয় হবে। রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম কমে যাবে। তেল বা গ্যাসের ব্যয় কমে যাবে। স্বভাবতই দূষণ কমবে। কর্মীদের জীবনে জ্যামের সময়টা বোনাস হিসেবে যোগ হবে। যারা অফিস সময়ে গণপরিবহনে গলদ্ঘর্ম হয়ে যাতায়াত করেন, তারা বিশাল যন্ত্রণা বিড়ম্বনা থেকে বাঁচবেন। ওয়ার্ক ফ্রম হোমের খারাপ দিক বা বিচ্যুতিও আছে। তা কাটিয়ে ভালো দিকগুলো গ্রহণ করলে আমরা জাতীয়ভাবে লাভবান হব। আমাদের এটার পূর্ণ সুযোগ নেয়া উচিত।

 

শওকত হোসেন: পরিচালক, লাইট ক্যাসল পার্টনার

সাধারণ সম্পাদক, ভিসিপিআব

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন