করোনার মৃত্যুঝুঁকি ও আড়ালে থাকা কিছু কথা

ড. মো. হাসিনুর রহমান খান

সাজেক ইসলাম একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। প্রায় পাঁচ বছর হলো অবসরে গেছেন। জীবনসঙ্গিনীর মৃত্যুর পর একমাত্র ছেলের সঙ্গে একত্রে বসবাস করেছেন তিন বছর ধরে। ছেলের বউ, এক নাতিসহ পরিবারের সদস্যসংখ্যা এখন চার। ছেলে বেসরকারি ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা। প্রায় প্রতিদিনই এই করোনার মহামারীতে অফিসে যেতে হয়। সাজেক ইসলাম করোনাপূর্ব সময়টা কাটাতেন মূলত পত্রিকা পড়ে এবং টেলিভিশন দেখে। তিনি এখন পত্রিকাও পড়েন না, খুব একটা টেলিভিশনও দেখেন না। করোনার শুরুর সময়টায়ও নিয়মিত পত্রিকা টেলিভিশন দেখতেন। এখন সময় কাটে মূলত ঘুমিয়ে এবং নাতির সঙ্গে খেলাধুলা করে। কেমন জানি একটা বিষণ্ন ভারাক্রান্ত মন তাকে তাড়িয়ে বেড়ায় প্রতিনিয়ত। বাবার এই পরিবর্তন লক্ষ করে ছেলে জিজ্ঞেস করলেই বাবা উত্তরে বলেন, করোনায় বয়স্ক লোকেরা যে হারে মৃত্যুবরণ করছে তাতে আমার, ডায়াবেটিস রোগীর ওপারের যাত্রা আর কেউ থামাতে পারবে না। বাবার কথায় ছেলের চোখে জল এসে গেল। ছেলে বুঝলেন বাবা প্রতিদিন টেলিভিশনে স্বাস্থ্য বুলেটিন দেখতেন এবং এই তথ্যগুলো পেতেন। প্রতীকী অর্থে এই গল্পটি বলা হলেও শহরের অধিকাংশ বয়স্ক ব্যক্তি ধরনের আশঙ্কার মধ্যে রয়েছেন। তবে গ্রামের বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে ধরনের আশঙ্কা অনেকটাই কম! আমাদের দেশে ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, অ্যাজমা, হাঁপানি, ধূমপান কিডনি সমস্যাসহ অনেক রোগ রয়েছে, যেগুলোর অধিকাংশই করোনায় মৃত্যুঝুঁকি বাড়াতে সাহায্য করে, যেটি আমরা প্রতিনিয়ত শুনছি। ধরনের ব্যাপারগুলো নিয়ে বয়স্ক ব্যক্তিরা এক ধরনের অমূলক অনাকাঙ্ক্ষিত অতিমৃত্যু আশঙ্কায় ভুগছেন; যেটি কারো কাম্য নয়। হ্যাঁ অগত্যা অতিমৃত্যু আশঙ্কার কথাই বলছি, ব্যাপারটা পরিষ্কার করে বলি।

রোগতত্ত্ব, জনস্বাস্থ্য অথবা পরিসংখ্যান নিয়ে আমরা যারা কাজ করি, সাধারণত মৃত্যুঝুঁকি বলতে বুঝি প্রতি একশ আক্রান্ত রোগীর মধ্যে কতজন মারা যায়! শতকরায় প্রকাশিত এই হারটাকে রোগতত্ত্বের ভাষায় কেস ফেটালিটি রিস্ক (সিএফআর) বলা হয়! করোনা রোগের ক্ষেত্রে যেটি আমাদের দেশে মুহূর্তে দশমিক ২৬ শতাংশ এবং সারা বিশ্বে দশমিক শতাংশ। এই মৃত্যুঝুঁকির ব্যাখ্যাটি আমরা এখন অনেকেই ভালোভাবে জানি! এই মৃত্যুর হার শূন্যের কোটায় থাকলে আমরা করোনাভাইরাসকে কেউ আর ভয় করতাম না। জুন মাস ধরে প্রতিদিন গড়ে ৪০ জন মৃত্যুর সংখ্যা আমরা পেয়েছি। আর বয়সভিত্তিক করোনার মোট মৃত্যুসংখ্যার বিন্যাসে বলা হচ্ছে, ৪৩ দশমিক শতাংশ হলেন ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তি, ২৯ শতাংশ হলেন ৫১-৬০ বয়সের ব্যক্তি, ১৪ দশমিক শতাংশ হলেন ৪১-৫০ বয়সের ব্যক্তি, দশমিক শতাংশ হলেন ৩১-৪০ বয়সের ব্যক্তি, দশমিক শতাংশ হলেন ২১-৩০ বয়সের ব্যক্তি, দশমিক শতাংশ হলো ১১-২০ বয়সের ব্যক্তি এবং দশমিক শতাংশ হলেন অনূর্ধ্ব এগারো বয়সের শিশুরা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই তথ্যগুলোতে কোনো ভুল নেই। কিন্তু ভুল হচ্ছে এই তথ্যগুলোর সঠিক ব্যাখ্যার জায়গায় প্রয়োজনীয় পরিসংখ্যান তুলে না ধরায়।

তথ্যগুলো প্রকাশ করার পর পর প্রতিনিয়ত বলা হচ্ছে মৃত্যুঝুঁকিতে বেশি রয়েছেন বয়স্করা। মৃত্যুঝুঁকি বলতে এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ মনে করছে উল্লেখিত মৃত্যুবিন্যাসকে এবং ফলে বেশি মৃত্যুঝুঁকির শঙ্কায় ভুগছেন সাজেক ইসলামের মতো বয়স্ক মানুষ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কখনই উল্লেখিত বয়সভিত্তিক প্রকৃত মৃত্যুঝুঁকি বা সিএফআর উপস্থাপন করেনি বা কোনো ওয়েবসাইটেও তা প্রকাশ করা হয়নি। একইভাবে বলা হচ্ছে, মৃত্যুর ৭৭ শতাংশ হলেন পুরুষ এবং পুরুষদের মধ্যে মৃত্যুঝুঁকি বেশি। মৃত্যুঝুঁকি বলতে এক্ষেত্রে পুরুষেরাও মনে করছেন উল্লেখিত মৃত্যুবিন্যাসকে। মৃত্যুবিন্যাস এবং মৃত্যুঝুঁকি কখনই এক হতে পারে না। আমাদের অজ্ঞতার কারণেই এই দুটো বিষয়কে আমরা এক করে ফেলেছি, যার দায় প্রকৃতপক্ষে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এড়াতে পারে না। কেননা মৃত্যুঝুঁকি কথাটি বারবার উল্লেখ করা হলেও সিএফআর উল্লেখ করা হয় না। ফলে সাধারণ মানুষের পক্ষে দুটোকে গুলিয়ে ফেলা সহজ হচ্ছে। পরিসংখ্যান বিষয়ের ঝুঁকিরর সম্যক ধারণা না থাকাও এর অন্যতম আরেকটা কারণ হতে পারে।    

মৃত্যুর ঝুঁকি নির্ধারণে হর লবের ব্যবহার হয় এবং লবে আক্রান্ত সংখ্যা ব্যবহার করা হয়। অন্যথায় মৃত্যুর বিন্যাস বের করার ক্ষেত্রে রকম হর লবের ব্যবহার নেই। বয়স লিঙ্গভিত্তিক মৃত্যুর বিন্যাসের পাশাপাশি আক্রান্তের বিন্যাসও দেয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত স্বাস্থ্য বুলেটিনে। আর দুটো বিন্যাসকে ব্যবহার করে সহজেই প্রকৃত মৃত্যুঝুঁকি বা সিএফআর বের করা যায়। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পক্ষ থেকেও ধরনের মৃত্যুঝুঁকির পরিসংখ্যান প্রকাশ করা  হচ্ছে না, যেটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। সর্বশেষ তথ্য ব্যবহার করে যেটি জানা যায়, তাতে বয়স লিঙ্গভিত্তিক মৃত্যুঝুঁকি বা সিএফআর নিম্নরূপ। ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মধ্যে দশমিক শতাংশ, ৫১-৬০ বয়সের ব্যক্তিদের মধ্যে দশমিক শতাংশ, ৪১-৫০ বয়সের ব্যক্তিদের মধ্যে দশমিক শতাংশ, ৩১-৪০ বয়সের ব্যক্তিদের মধ্যে দশমিক ৩৫ শতাংশ, ২১-৩০ বয়সের ব্যক্তিদের মধ্যে দশমিক ১৬ শতাংশ, ১১-২০ বয়সের ব্যক্তিদের মধ্যে দশমিক ২০ শতাংশ এবং অনূর্ধ্ব এগারো বয়সের শিশুদের মধ্যে দশমিক ২৬ শতাংশ। যেটি পুরুষদের মধ্যে দশমিক শতাংশ এবং মহিলাদের মধ্যে শতাংশ।

তার মানে, মৃত্যুঝুঁকি সবচেয়ে বেশি ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মধ্যে, যেটি প্রতি ১০০ জনে জনের মতো এবং সবচেয়ে কম ২১-৩০ বয়সের ব্যক্তিদের মধ্যে যেটি প্রতি ১০০ জনে দশমিক ১৬ জনের মতো বা প্রতি ২০০০ জনের মধ্যে মাত্র তিনজন।  এছাড়া উল্লেখযোগ্য হারে ৫১-৬০ বয়সের ব্যক্তিদের মধ্যে (প্রতি ১০০০- ৩৩ জন) এবং ৪১-৫০ বয়সের ব্যক্তিদের মধ্যে (প্রতি ১০০০- ১১ জন) মৃত্যুঝুঁকি পরিলক্ষিত হচ্ছে। তুলনামূলক বিচারে, ২১-৩০ বয়সের ব্যক্তিদের চেয়ে অনূর্ধ্ব ১১ বয়সের শিশুরা ৬০ শতাংশ বেশি হারে মৃত্যুবরণ করছে, ১১-২০ বয়সের ব্যক্তিরা ২০ শতাংশ বেশি হারে মৃত্যুবরণ করছে, ৩১-৪০ বয়সের ব্যক্তিরা দ্বিগুণ বেশি হারে মৃত্যুবরণ করছে, ৪১-৫০ বয়সের ব্যক্তিরা দশমিক গুণ বেশি হারে মৃত্যুবরণ করছে, ৫১-৬০ বয়সের ব্যক্তিরা ২০ গুণ বেশি হারে মৃত্যুবরণ করছে এবং ষাটোর্ধ্ব বয়সের ব্যক্তিরা সর্বোচ্চ ৫০ গুণ বেশি হারে মৃত্যুবরণ করছে। অন্যদিকে লিঙ্গভিত্তিক বিবেচনায় পুরুষরা মহিলাদের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি হারে মৃত্যুবরণ করছে। করোনায় আক্রান্ত হলে মৃত্যুর সম্ভাবনার বয়স লিঙ্গভিত্তিক সঠিক এই তথ্যগুলো আমাদের জানা একান্ত প্রয়োজন এবং সংশ্লিষ্ট মহলের প্রচার করাও একান্ত প্রয়োজন। মৃত্যুর বিন্যাসের ওপর জোর না দিয়ে মৃত্যুঝুঁকির এই তথ্যগুলো প্রতিদিন প্রকাশ করা হলে সাধারণ জনগণের মধ্যে অহেতুক অতিমৃত্যু আশঙ্কার যে ভূত চেপে বসেছে সেখান থেকে অনেকটাই রক্ষা পেতে পারতেন।

শিশুদের মধ্যে রোগ প্রতিরোধের সক্ষমতা কম থাকায় শিশুরাও মারা যাচ্ছে। অন্যদিকে বয়স্কদের মধ্যেও রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা কম থাকার পাশাপাশি অন্যান্য রোগ থাকার কারণে বেশি হারে মারা যাচ্ছেন। কিছুটা বায়োলজিক্যাল কারণে এবং কিছুটা দৈনন্দিন আচরণগত বৈশিষ্ট্যের কারণে মহিলাদের গড় আয়ুষ্কাল রোগ প্রতিরোধের সক্ষমতা পুরুষদের তুলনায় সাধারণত বেশি থাকে, ফলে মহিলাদের মধ্যে মৃত্যুঝুঁকি কম পরিলক্ষিত হচ্ছে। উল্লেখ্য, সর্বশেষ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে মহিলাদের আয়ুষ্কাল ৭৪ দশমিক এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে সেটা ৭১ দশমিক বছর। অন্যান্য রোগ নিয়ে বয়স্ক লোকেরা যারা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে তারা কি সবাই মৃত্যুবরণ করছে? নিশ্চয়ই নয়। এখানে অন্যান্য রোগে আক্রান্ত বয়স্ক ব্যক্তিদের রোগভিত্তিক করোনায় প্রকৃত মৃত্যুঝুঁকি বা সিএফআর বের করা দরকার। তাহলে ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, ক্যান্সার, অ্যাজমাসহ অন্যান্য রোগীরা করোনায় আক্রান্ত হলে তাদের মৃত্যুর ঝুঁকির মাত্রা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করতেন এবং কম আতঙ্কগ্রস্ত হতেন। করোনা যুদ্ধের সামনের সারির সব যোদ্ধাকে বিশেষ করে ডাক্তার, নার্স, অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ সাংবাদিকদের ক্ষেত্রেও প্রকৃত মৃত্যুঝুঁকি জানা অত্যন্ত দরকার। যেটির প্রকৃত চিত্র আমরা কেউ জানি না, মাঝে মাঝে মোট ডাক্তারদের মৃত্যুর সংখ্যাটা জানা যায় মাত্র। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনায় মোট মৃত্যুর প্রায়   শতাংশই  হলেন ডাক্তাররা। ধারণা করা হচ্ছে, এসব সম্মুখ সারির যোদ্ধার আক্রান্তের হার এবং মৃত্যুর হার দুটোই বেশি, বৈশ্বিক হারের সঙ্গে তুলনা করলে।

একইভাবে অন্যান্য পেশা-শ্রেণীর লোকদের মধ্যেও প্রকৃত মৃত্যুঝুঁকি বের করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারী, সরকারি বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, ছাত্র, শিক্ষক, প্রকৌশলী, রিকশাচালক, ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী, দোকানদার, ফল ব্যবসায়ী, মাছ ব্যবসায়ী, ড্রাইভার, নাপিত, সবজিবিক্রেতা, বস্তিবাসী, শহর গ্রামবাসী, জেলা, উপজেলা, বিভাগসহ অন্যান্য শ্রেণী এলাকার আক্রান্ত লোকদের মধ্যে মৃত্যুঝুঁকির স্পষ্ট ধারণা থাকলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও সেভাবে স্বাস্থ্যবিধিগুলো প্রণয়ন করতে পারতেন এবং প্রচার করতে পারতেন। করোনা মহামারীর শুরু থেকে কেন্দ্রীয় ডেটাবেজ সিস্টেমের মাধ্যমে প্রতিটি আক্রান্ত রোগীর এসব তথ্য সংগ্রহ সংরক্ষণ করে রাখতে পারলে উপরোক্ত শ্রেণী-পেশা এলাকার আক্রান্ত মানুষদের মধ্যে সঠিক মৃত্যুঝুঁকি কেবল বের করা সম্ভব হতো। এছাড়া দ্রুত অন্যান্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যেমন লাল, হলুদ, সবুজ এলাকা চিহ্নিতকরণ, বিভিন্ন শ্রেণী-পেশা এলাকার মধ্যে বিদ্যমান সংক্রমণের বিস্তারের মাত্রা জানা যেত এবং যার ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশা এলাকায় কী পরিমাণ টেস্ট করতে হবে, আইসোলেশন কোয়ারেন্টিনে নিতে হবে সে ব্যাপারে সম্যক ধারণা পাওয়া যেত। যেগুলো সমষ্টিগতভাবে করোনা মহামারীর বিস্তার রোধের অন্যতম উপায় হিসেবে অনন্য ভূমিকা পালন করতে পারত। পরিসংখ্যানবিদ কিংবা ডেটা সায়েন্টিস্টদের সহযোগিতায় ডেটাবেজের তথ্যগুলোকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় উপকারী ফলাফল বের করা সম্ভব হতো। সঠিক তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ বিশ্লেষণে বাংলাদেশের সক্ষমতাও প্রকাশ পেত। সর্বোপরি শত বছর পর পর যে মহামারী আসে তার সুষ্ঠু মোকাবেলায় এটি একটি সম্পদ হিসেবে ভবিষ্যৎ জেনারেশনের কাছে রেখে দেয়া সম্ভব হতো।

 

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ফলিত পরিসংখ্যান,

আইএসআরটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন