কোম্পানি উদ্যোক্তাদের জানুন, তারপর শেয়ার কিনুন

শফিকুল ইসলাম

‘ম্যান বিহাইন্ড দ্য মেশিন’ বলে একটা কথা আছে যা কেউই অস্বীকার করতে পারে না। রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে শুরু করে যে কোন সংগঠন, এমনকি একটি পরিবার চালানোর গুনমান মূলত নির্ভর করে তা যারা পরিচালনা করছে তাদের উপর। তাদের দক্ষতা, সততা আর আন্তরিকতার উপরই নির্ভর করবে অগ্রগতি কিংবা অবনতি। এটি যে কোন কোম্পানির জন্য আরো বেশী সত্য। কোন কোম্পানি কোন এক সময় কেউ না কেউ গঠন করেছিলেন যাদেরকে উদ্যোক্তা বলে চিহ্নিত করা হয়। সেই উদ্যোক্তারা মানুষ হিসাবে কেমন, তাদের মানসিকতা, সততা, একাগ্রতা, কর্মনিষ্ঠার মান কেমন সে বিষয়গুলোই মূলত ঠিক করে দেয় সে কোম্পানি সময়ের বিবর্তনে সামনে এগিয়ে যাবে, না ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে।

এটা সত্য যে পাবলিকলি লিস্টেড সব কোম্পানিকে নানা ধরনের শর্তাদি বাধ্যতামূলকভাবে প্রতিপালন করতে হয়। তার মধ্যে আছে নিয়মিত আর্থিক প্রতিবেদন (বার্ষিক, অর্ধবার্ষিক ও ত্রৈমাসিক) প্রকাশ করা। সেখানে কোম্পানির ব্যবসার নানা তথ্য যেমন, সেলস, যাবতীয় খরচ, লাভ-লোকসান ইত্যাদির উল্লেখ থাকে। কিন্ত যাদের কর্মকান্ডের ভিত্তিতে সেসব তথ্যের আকার প্রকার নির্ভর করে, যাদের দক্ষতা বা অদক্ষতা, সততা কিংবা অসততার উপর ভর করে কোম্পানির ভাল-মন্দ ফলাফলের চিত্র ফুটে উঠে সেসব লোকদের নিজের ছবি কতটুকু ফুটে ওঠে সেখানে? সম্ভবত খুব একটা ফোটে না। কোম্পানি পরিচালক আর এমপ্লয়িদেরকে সম্মিলিতভাবে বলা যেতে পারে ম্যানেজমেন্ট টিম। অধিকাংশ কোম্পানির বার্ষিক প্রতিবেদনে পরিচালকদের সাধারণ পরিচিতি সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। কিন্ত অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেখানে তাদের সম্বন্ধে ভালো ভালো কথাই লেখা হয় বা বাড়িয়ে বলা হয়, যাকে বলে ‘sugar coated’। কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ ম্যানেজিং ডিরেক্টর কিংবা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এর সহায়তায় দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যাদের নিয়োজিত করলো তা কি ক্রাইটেরিয়া অবলম্বন করে করলো, সঠিক লোক বাছাই করে সঠিক জায়গায় তাদের বসিয়ে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলো কিনা সেসব ছোট ছোট বিষয়গুলোই দিনশেষে নির্ধারণ করে দেয় কোম্পানির আর্থিক ফলাফল। দুঃখজনকভাবে বলতে হয় যে, আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে টপ ম্যানেজমেন্ট, যারা মূলত দৈনন্দিনভাবে সকল কার্যক্রম চালায়, তাদের ট্রাক রেকর্ড জানার ব্যবস্থা থাকে না। তারা আগে কোথায় কোথায় কাজ করেছেন, বর্তমান কোম্পানিতে কোন পদে কতদিন কাজ করছে, কোম্পানির উৎপাদন, উদ্ভাবন, সম্পদ ব্যবস্থাপনা, কোয়ালিটি কন্ট্রোল, মার্কেটিং, হিউমান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট, ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে তাঁদের ব্যক্তিগত অবদান আর দায়িত্ব কর্তব্য কি সেসব তথ্য বিস্তারিতভাবে জানার কোন সুযোগ নেই। উন্নত বিশ্বে পাবলিকলি লিষ্টেড কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাসহ টপ ম্যানেজমেন্ট কর্মকর্তাদেরকে নিয়মিত সংবাদ সম্মেলন করে কোম্পানি পরিচালনা সম্পর্কিত নানা প্রশ্নের উত্তর সাংবাদিক ও বিশ্লেষকদেরকে দিতে হয়। এতে ম্যানেজমেন্টের সবলতা কিংবা দুর্বলতার অনেকটাই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে ধরা পড়ে। আমাদের দেশে সে ব্যবস্থার প্রচলন নেই। তাইতো তথ্যগত শুন্যতা বা ভ্যাকুম এর সুযোগ নিয়ে এদেশে একশ্রেণীর মার্কেট প্লেয়াররা বাজারে গুজব ছড়ানোর মাধ্যমে বিশেষ বিশেষ শেয়ারের দাম বাড়িয়ে বা কমিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের নিঃস্ব করতে সক্ষম হয়।

যে কোন কোম্পানির উৎপাদন, খরচ, আয়-ব্যয়, মুনাফা সংক্রান্ত তথ্যাদি হলো পরিমাণগত (Quantitative); আর উদ্যোক্তাসহ টপ ম্যানেজমেন্ট কর্মকর্তাদের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, সততা, আন্তরিকতার মতো বিষয়গুলো হলো মানগত (Qualitative)। মানগত বিষয়ের মূল্যায়ন জটিল ও সাবজেকটিভ ধরনের। ফলে একই অবস্থাকে নানাজন নানাভাবে মূল্যায়ন করে। সে কারণেই বোধ করি ম্যানেজমেন্ট কোয়ালিটি সম্পর্কিত বিশদ তথ্য কোম্পানির বার্ষিক প্রতিবেদনে দেয়ার বাধ্যবাধকতা থাকে না। অথচ কোম্পানি পরিচালনায় দায়িত্বরত ম্যানেজমেন্ট হলো মূল চালিকাশক্তি। তাদের কর্মকান্ডের দ্বারাই নির্ধারিত হবে কোম্পানির লাভ-লোকসান।

কোম্পানির সাফল্য ব্যর্থতায় ম্যানেজমেন্টের গুরুত্ব অপরিসীম হওয়া সত্বেও তার গুনগতমাণ কিরুপ তা সাধারন বিনিয়োগকারীরা কিভাবে বুঝবে? অথচ ম্যানেজমেন্টের গুনগতমাণ সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা না গেলে বিনিয়োগ সিদ্ধান্তেও ভূল হতে পারে। সেক্ষেত্রে সাধারন ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরাই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। কারণ বড় বিনিয়োগকারীরা তাঁদের অবস্থানগত সুবিধা ও নিজস্ব রিসার্চ টিমের সাহায্যে কোম্পানি ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কে অনেক কিছুই অবগত হয়ে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। যত চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের। 

নিজ সঞ্চয় ও বিনিয়োগ যখন ঝুঁকির মুখে তখন ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে যা কিছু তথ্য পাওয়া যায় তার উপর ভর করে যতটা সম্ভব সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে প্রকৃত তথ্য পাওয়ার কাজটি কিছুটা কঠিন হলেও একেবারে অসম্ভব নয়। যেহেতু সরাসরি ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কে সাধারন বিনিয়োগকারীদের জানার তেমন সু্যোগ নেই তাই পরোক্ষ পদ্ধতি অবলম্বন করে সেসব তথ্যগত ঘাটতি কিছুটা হলেও লাঘব করা সম্ভব। নিম্নের পয়েন্টগুলো বিবেচনায় নিয়ে সাধারণ বুদ্ধি খাটালেই কোন কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় ধারণা পাওয়া যেতে পারে-

(১) ফাউন্ডারদের বর্তমান অবস্থান: প্রথমেই প্রশ্ন করতে হবে যে কোম্পানি যারা একসময় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সে ফাউন্ডার তথা উদ্যোক্তারা কি এখনো কোম্পানির ম্যানেজমেন্টে আছেন? যদি না থাকেন তবে সেটা একটা রেড সিগন্যাল। বিশেষ একটা স্বপ্ন আর লক্ষ্য নিয়েই তারা একসময় কোম্পানিটি গড়ে তুলেছিলেন। তাই তারা চাইবেন না সেটা ধীরে ধীরে ধ্বংসপ্রাপ্ত হোক। আর তাদের গৃহীত স্ট্র্যাটেজি অন্য কোন টিমের পক্ষে উপলব্ধি ও বাস্তবায়ন সম্ভব নাও হতে পারে। ভাল কোম্পানির বার্ষিক প্রতিবেদনে কোম্পানি গঠনের শুরু থেকে অদ্যাবধি সব বড় ঘটনা তথা Milestones সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়, যা থেকে ফাউন্ডারদের বর্তমান অবস্থান বা Role সম্বন্ধে অবগত হওয়ার সুযোগ থাকে। 

(২) শেয়ারহোল্ডিং পজিশন: কোম্পানির মালিকানায় ফাউন্ডার বা উদ্যোক্তাগনের শেয়ারহোল্ডিং অবস্থানও অনেক কিছুই ইংগিত দিয়ে যায়। সেটা একটা নিদিষ্ট সীমার নীচে থাকলেই বুঝে নিতে হবে যে উদ্যোক্তাদের সদিচ্ছায় ঘাটতি রয়েছে। মনে রাখতে হবে যে একটি পাবলিকলি লিষ্টেড কোম্পানিকে ঠিকভাবে পরিচালনা করে লাভজনক অবস্থায় নিয়ে যাওয়া এবং মার্কেট শেয়ার ধরে রাখা সহজ কাজ নয়। তার জন্য দরকার হয় নিরলস পরিশ্রম, মেধা খাটানো আর কাজের সমন্বয়। তাই উদ্যোক্তারা কেন সেটা করবেন না যদি কোম্পানির শেয়ারের বৃহৎ অংশ তাদের মালিকানায় থাকে। যথেষ্ট আর্থিক ও অন্যান্য ইনসেন্টিভ না থাকলে উদ্যোক্তারা তাদের মেধা আর সামর্থ্যের পুরোটুকু দিবেন না সে বাস্তবতা বিনিয়োগকারীদের মাথায় রাখতে হবে। কোন কোম্পানিতে স্পন্সর শেয়ারহোল্ডিং খুব কম হলে ধরে নিতে হবে যে অসৎ উদ্দেশ্যে উদ্যোক্তারা সে প্রতিষ্টানটিকে লাভজনক করছে না অথবা কোম্পানির উন্নতিতে তাদের সামর্থ্যের সবটুকু দিচ্ছেন না। কোন কোম্পানির উদ্যোক্তাদের শেয়ারহোল্ডিং ৩০ শতাংশের কম হলে কেন কম তা পর্যালোচনার অবকাশ রাখে। আর শেয়ারহোল্ডিং কম হওয়ার যুক্তিসংগত কোন কারণ না পাওয়া গেলে সেখানে বিনিয়োগ না করাই ভাল। যেসব কোম্পানিতে উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডিং খুব কম তাদের ঘোষিত লভ্যাংশ ও রেভিনিউ তথা নিট আয় বৃদ্ধির হারের দিকে খেয়াল করলেই তা বুঝা যাবে। উদাহরণ হিসাবে দু’টি কোম্পানির উল্লেখ করবো। আইটি সেক্টরের ইনটেক কোম্পানির স্পন্সর শেয়ারহোল্ডিং ৪ শতাংশের নীচে। দীর্ঘদিন ধরে কোম্পানিটি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভূক্ত। তারা ২০০৪ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত শুধুই স্টক ডিভিডেন্ড দিয়েছে, কখনোই শেয়ারহোল্ডারদের জন্য নগদ বা ক্যাশ ডিভিডেন্ড দেয়নি। আবার ফুড অ্যান্ড এলাইড সেক্টরের ফুওয়াং ফুডসের স্পন্সর শেয়ারহোল্ডিং মাত্র ৮ দশমিক ৬২ শতাংশ। এ কোম্পানিটিও দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত। তারা ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত বিভিন্ন হারে শুধুই স্টক ডিভিডেন্ড দিয়েছে; শুধুমাত্র ২০১৯ সালে মাত্র ২ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়েছে। আরো মজার বিষয় হলো ২০১৯ এ প্রদত্ত ক্যাশ ডিভিডেন্ড ঘোষণার সাথে কোম্পানিতে স্পন্সর শেয়ারহোল্ডিংয়ের হার বৃদ্ধির সম্পর্ক আছে বলেও অনেকে অভিযোগ করে। উল্লেখ্য, ডিএসই ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী ৩০ জুন ২০১৯ তারিখে উক্ত কোম্পানিতে স্পন্সর শেয়ারহোল্ডিং যেখানে ছিল মাত্র ৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ, তা বর্তমান বছরের ৩১ জানুয়ারিতে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৬২ শতাংশ।

(৩) নিট আয় ও সম্পদ অনুপাত: কোম্পানি পরিচালনায় নানা বিষয়ে দৈনন্দিন ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন, সীমিত সম্পদ বন্টন, জনবল নিয়োগ ও তা কাজে লাগানো, ইনভেন্টরী ম্যানেজমেন্ট পরিচালনা, নানাবিধ খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখা, মার্কেটিং কৌশল প্রণয়ন ইত্যাদি সব কর্মকান্ডের ফলাফল মূলত নির্ভর করে টপ ম্যানেজমেন্টের সততা, দক্ষতা আর কর্মত্ৎপরতার উপর। সে দক্ষতার প্রমাণ মিলে মোট সম্পদ ব্যবহার করে শেষ পর্যন্ত কিরুপ নিট আয় অর্জন করতে পারলো তার উপর। মনে রাখতে হবে যে শেয়ারহোল্ডারদের ইক্যুইটি ছাড়াও কোম্পানি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে তা কোম্পানির লাভের উদ্দেশ্যে খাটায়। ফলে নিট আয় ও মোট সম্পদের মধ্যকার অনুপাত বেশী হওয়ার অর্থই হলো ম্যানেজমেন্ট দক্ষ; বিশেষ করে সে অনুপাত যদি নিজ সেক্টরের প্রতিযোগী অন্যান্য কোম্পানির চেয়ে বেশী হয়। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে নীট আয় ও সম্পদের অনুপাত সেক্টরভেদে ভিন্ন হয়, এমনকি একই সেক্টরে সবসময় তা একরকম থাকেও না। সেটা মাথায় রেখেই কোন বিশেষ সেক্টরে কোন কোম্পানির নিট আয় ও সম্পদ অনুপাত হা্রকে ভাল কিংবা মন্দ হিসাবে বিবেচনা করতে হবে। বিবেচ্য কোম্পানি যদি ব্যাংক খাতের হয় তবে দেখা দরকার যে অন্যান্য ব্যাংকের তুলনায় সে হার বেশী না কম।

(৪) নিট আয় ও রেভিনিউ অনুপাত: কোন কোম্পানির দক্ষতা কেমন তা বুঝা যায় রেভিনিউ বা বিক্রির কত শতাংশ শেষ পর্যন্ত নিট আয় হিসাবে কোম্পানিতে জমা হচ্ছে। রেভিনিউ আয় থেকে কাঁচামাল খরচ, প্রশাসনিক ব্যয়, লোনের সুদ, সরকারকে দেয় ট্যাক্সসহ আনুসংগিক সব খরচ বাদ দেওয়ার পর যা থাকে সেটাই নিট আয়। প্রশাসনিক ব্যয়, ডিস্ট্রিবিউশন ব্যয় যদি বেশী হয়, কাঁচামাল সংগ্রহের সুত্র ও প্রক্রিয়া যদি সঠিক না হয়, যদি অনিয়ন্ত্রিত ব্যাংক ঋণের কারণে অতিরিক্ত সুদ বহন করতে হয়, যদি বকেয়া অর্থ আদৌ আদায় করা সম্ভব না হয় তবে নিট আয়ে তা প্রতিফলিত হবে। বিশেষ করে একই সেক্টরের প্রতিযোগী অন্যান্য কোম্পানির তুলনায় যদি সে অনুপাত কম হয় তবে বুঝতে হবে কোম্পানির টপ ম্যানেজমেন্ট অদক্ষ। আবার একই কোম্পানির নিট আয় ও রেভিনিউ অনুপাত সময়ের সাথে সাথে বিগত বছরগুলোর তুলনায় বাড়ছে না কমছে তা দেখেও কোম্পানির উন্নতি কিংবা অবনতি বুঝা যাবে। আর আর্থিক অবস্থার উন্নয়নই ম্যানেজমেন্ট কোয়ালিটির সবচেয়ে বড় নির্ণায়ক।  

(৫) রিপোর্ট টু শেয়ারহোল্ডারস: সব কোম্পানিকে আবশ্যিকভাবে বার্ষিক প্রতিবেদনে শেয়ারহোল্ডারদের জন্য বিশেষ রিপোর্ট সংযুক্ত করতে হয়। সেখানে প্রথমে চেয়ারম্যানের রিপোর্ট এবং তারপর ম্যানেজিং ডিরেক্টর বা সিইও এর রিপোর্ট থাকে। সেখানে দেশের সার্বিক আর্থ-রাজনৈতিক এবং কোম্পানির বিগত বছরের ব্যবসার ফলাফল তুলে ধরা হয়। কিছু কোম্পানি বিস্তারিত তথ্যাদি উল্লেখ করে, আবার কেউ খুবই সংক্ষিপ্তভাবে দায়সারা গোঁছের তথ্যাদি দেয়। একটি ভাল কোম্পানির প্রতিবেদনে বিগত দিনে ব্যবসা পরিচালনায় কোম্পানিকে যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী হতে হয়েছে তার বর্ণনা এবং তার সমাধান হয়েছে কিনা সেটাও উল্লেখ থাকা কাম্য। সেইসাথে আগামী দিনের পরিকল্পনা সম্পর্কেও আলোকপাত বাঞ্চনীয়। যদি তা করা হয় তবে সাধারন বিনিয়োগকারীগন ম্যানেজমেন্ট কোয়ালিটি সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারনা পেতে পারেন। তবে বাস্তবতা হচ্ছে যে আমাদের দেশের অধিকাংশ কোম্পানির বার্ষিক প্রতিবেদনে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার সুনির্দিষ্ট প্রক্ষেপণ থাকে না। বিগত সময়ের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কিত তথ্যাদিও এড়িয়ে যাওয়া হয়। হয়তো ম্যানেজমেন্ট মনে করে যে প্রতিবেদনে সেসবের উল্লেখ করা হলে বিনিয়োগকারীরা কোম্পানির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে খারাপ ধারনা করবে এবং তাদের হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে দিবে। কিন্ত অনেকক্ষেত্রেই সে ধারনা ঠিক নয়। বাস্তব সত্যকে স্বচ্ছতার সাথে উপস্থাপন করা হলে ম্যানেজমেন্টের সততা প্রকাশ পায় যা বিনিয়োগকারীরা ভাল্ভাবেই নিয়ে থাকে। যাহোক, ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির কোন কোন তথ্য রিপোর্ট টু শেয়ারহোল্ডারস অংশে দিচ্ছে এবং কতটা স্বচ্ছতার সাথে তা উপস্থাপন করছে তা বিনিয়োগকারীদের খেয়াল করা দরকার। মনোযোগ সহকারে সে রিপোর্ট বিশ্লেষণ করলেই ধারণা করা যাবে কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট কোয়ালিটি কেমন।

(৬) ডিভিডেন্ড ধরন: কোম্পানি স্টক না ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিচ্ছে সেটা দেখেও উদ্যোক্তা তথা টপ ম্যানেজমেন্টের মানসিকতা বুঝা যায়। যদি দেখা যায় যে বছরের পর বছর শুধু স্টক ডিভিডেন্ড দেয়া হচ্ছে, তবে তা ভাল লক্ষণ নয়। স্পন্সর শেয়ারহোল্ডিংয়ের ন্যুনতম হার বলতে যেয়ে ইতিমধ্যে দু’টি বিশেষ কোম্পানির ডিভিডেন্ড ধরণ সম্পর্কে ধারণা প্রদান করা হয়েছে। শেয়ার গুরু বলে বিশ্বখ্যাত ওয়ারেন বাফেট কখনো সেসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন নাই যারা শেয়ারহোল্ডার ভ্যালু বাড়ানোর দিকে নজর না দিয়ে কোম্পানির মূনাফা পকেটস্থ করতে পছন্দ করেন। বিনিয়োগকারী কোন কোম্পানির শেয়ার কিনে বছরের পর বছর কোন নগদ হাতে পেলো না এবং  তার পরিবর্তে স্টক ডিভিডেন্ড নামক কাগজ তার একাউন্টে জমা হলো তেমন অবস্থা নিশ্চয়ই শেয়ারহোল্ডারের ভ্যালু বাড়ায় না। তাই সাধারন বিনিয়োগকারীদেরকে সেটা বুঝতে হবে এবং সে অনুযায়ী বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

উপরে বর্ণিত প্রক্রিয়া ছাড়াও উদ্যোক্তাদের বিষয়ে সংবাদপ্ত্রে বিভিন্ন সময় রিপোর্ট প্রকাশসহ আরো নানা উপায়ে কোম্পানি ম্যানেজমেন্ট কোয়ালিটি সম্পর্কে অনুমান করা যায়। সংবাদপ্ত্রের সব রিপোর্টই যে গ্রহণযোগ্য তা অবশ্য মনে করার কারণ নেই। অনেক ভূঁইফোড় সংবাদপত্র বা অসৎ সাংবাদিক অসাধু উদ্দেশ্যে কারো বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর অসত্য রিপোর্ট ছাপতে পারে। বিনিয়োগকারীদেরকে নিজ প্রচেষ্টায় তার মূল্যায়ন করতে হবে। মোট কথা সচেতন থাকলে নানাবিধ সীমাবদ্ধতা সত্বেও বাংলাদেশের স্টক মার্কেটে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট কোয়ালিটি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি জানা যায় এবং তার যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা শেয়ার মার্কেটে টিকে থাকার সক্ষমতা অর্জন করতে পারেন। 

লেখক: অতিরিক্ত সচিব (পিআরএল)
[email protected]


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন