ডালজাতীয় শস্য

উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না চাহিদার এক-তৃতীয়াংশও

সাইদ শাহীন

প্রতিনিয়ত চাহিদা বাড়লেও দেশে ডাল আবাদে ব্যবহূত জমির পরিমাণ কমছে নিয়মিতভাবে। কৃষকদের মধ্যেও এসব শস্যের আবাদ চাহিদা এখন কমতির দিকে। কারণে বর্তমানে চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ পরিমাণে ডাল উৎপাদন করতে পারছে না বাংলাদেশ।

কৃষি খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের ডাল উৎপাদনকারী এলাকাগুলোর উৎপাদন পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আসছে। এসব এলাকার বিশেষায়িত ডালগুলো এখন কৃষকের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে কম। এর পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিও এক ধরনের ভূমিকা রাখছে। আবহাওয়া তাপমাত্রার পরিবর্তনের কারণে শস্যগুলো আবাদে লাভজনক ফলন পাচ্ছেন না কৃষক। কারণে তাদের আবাদ পছন্দে গুরুত্ব হারাচ্ছে এসব শস্য।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুষম খাদ্য চাহিদা মেটাতে মাথাপিছু দৈনিক ডাল প্রয়োজন ৫০-৬০ গ্রাম। সে হিসেবে দেশে বর্তমানে ডালের বার্ষিক চাহিদা ৩০-৩৫ লাখ টন। কিন্তু দেশে আবাদকৃত আট ডালমসুর, ছোলা, মুগ, মাষকলাই, খেসারি, মটর, অড়হর ফ্যালনের মোট বার্ষিক উৎপাদন -১০ লাখ টনের ওপরে ওঠানো যাচ্ছে না বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে।

এর কারণটিও ডিএইর পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট। অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, দেশে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ডাল আবাদ হয়েছিল লাখ ৯৮ হাজার হেক্টর জমিতে। অন্যদিকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা নেমে এসেছে লাখ ৮৫ হাজার হেক্টরে। দুই অর্থবছরের মধ্যে দেশে ডালজাতীয় শস্যের আবাদি জমি কমেছে লাখ ১৩ হাজার হেক্টর বা প্রায় ২২ শতাংশ।

প্রতিনিয়ত চাহিদা বাড়লেও কমে যাচ্ছে ডালজাতীয় শস্যের আবাদি জমি। এতে বেড়ে যাচ্ছে ডাল আমদানি ব্যয়। গত দুই অর্থ বছরের ব্যবধানে দেশে ডালজাতীয় শস্যের আবাদি জমির পরিমাণ কমেছে। গত ১০ অর্থবছরে ডালজাতীয় পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা। গড়ে প্রতি বছর আমদানি ব্যয় প্রায় হাজার ২০০ কোটি টাকা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে যেসব এলাকা ডাল আবাদের জন্য বিখ্যাত ছিল, সেসব এলাকার কৃষিচর্চায় এখন বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। চাষীরা এখন ডালের বদলে আলু, বোরো ধান ভুট্টা আবাদে ঝুঁকে পড়ছেন বেশি। প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না ডালজাতীয় শস্য। এক সময় বরিশাল, ভোলা বরগুনায় মুগডাল আবাদ হতো প্রচুর। আমন মৌসুমে ধান কর্তনের পর পড়ে থাকা জমিতে মুগডাল আবাদ করতেন কৃষকরা। কিন্তু তিন জেলায় এখন আর আগের মতো আবাদ হচ্ছে না মুগডাল। ফরিদপুর, পাবনাসহ পদ্মা অববাহিকার জেলাগুলোয় ছোলার আবাদ হতো প্রচুর। সেখানেও কৃষিপণ্যটির আবাদ এখন অনেকটাই কমে গিয়েছে। এছাড়া ডাল আবাদ অনেকটাই আবহাওয়া পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল। তাপমাত্রা বৃষ্ট্পািতের পরিবর্তন প্রতিকূল আবহাওয়ায় এর আবাদ মারাত্মক বাধাগ্রস্ত হয়। কারণ ডাল সাধারণত পরিবর্তিত আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সক্ষম নয়। গত কয়েক দশকে দ্রুত আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে কিছু এলাকায় শস্যটির আবাদ ব্যাপক বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

মাঠ পর্যায়ে ফসলের উন্নত জাত প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে দেশে ডাল উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করছেন সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ডালজাতীয় শস্যকে টিকিয়ে রাখতে হলে অন্যান্য ফসলের স্বল্পমেয়াদি জাত উদ্ভাবনে জোর দিতে হবে। এছাড়া কৃষকদের উন্নত চাষাবাদের কৌশল শেখাতে প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন।

কৃষকরা যাতে তাদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান, সেদিকেও সরকারকে নজর দিতে হবে। দেশের প্রক্রিয়াজাতকারী কোম্পানিগুলো কিছু পরিমাণে ডাল সংগ্রহ করে। মূল্য সংযোজনে জোর দিতে হলে সেটি আরো বাড়াতে হবে। উদ্ভাবিত উন্নত জাতের বীজ কৃষক পর্যায়ে দ্রুত সম্প্রসারণ করতে হবে। তাহলেই ডালের আবাদ বাড়িয়ে আমদানিনির্ভরতা কমানো সম্ভব হবে।

চাহিদার তুলনায় উৎপাদন না বাড়ায় দেশে এখন ডালের আমদানি ব্যয় বেড়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশে ডাল আমদানিতে ব্যয় হয়েছিল হাজার ৪২২ কোটি টাকা। এক দশকের মাথায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা প্রায় হাজার কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে হাজার ৪৫৭ কোটি টাকায়। অন্যদিকে গত অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) বাবদ ব্যয় হয়েছে হাজার ১১৬ কোটি টাকা।

বিষয়ে বাংলাদেশ ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজী সফি মাহমুদ বণিক বার্তাকে বলেন, দেশে ডালজাতীয় পণ্যের চাহিদা বাড়লেও সে হারে উৎপাদন বাড়ছে না। ফলে আমরা আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ছি। স্থানীয় উৎপাদন দিয়ে চাহিদার সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে বিধায় প্রতি বছর সাড়ে হাজার কোটি টাকার বেশি মূল্যের ডাল আমদানি করতে হচ্ছে। দেশে উৎপাদন হলে বাজারে ডালের সরবরাহ সঠিকভাবে রাখা সম্ভব হতো। আমদানিনির্ভরতার কারণে মাঝেমধ্যেই ডালের দামেও অস্থিতিশীলতা দেখা যায়। তাই দেশে উৎপাদন বাড়ানোর দিকে নজর দেয়া হলে ভোক্তাদের সঠিক দাম মানের ডাল সরবরাহ করা সম্ভব হবে।

জানা গিয়েছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে আট ধরনের ডালের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ লাখ ১৪ হাজার টন। সময় ফসলগুলোর আবাদি জমির মোট প্রাক্কলিত পরিমাণ লাখ ২০ হাজার হেক্টর।

জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞ পুলের সদস্য ডিএইর সাবেক মহাপরিচালক কৃষিবিদ হামিদুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ডালজাতীয় শস্যের আবাদ বাড়ানোর উপায় হলো, বোরো আমন মৌসুমে আরো উচ্চফলনশীল জাতের ব্যবহার বাড়িয়ে সময়টা কমিয়ে আনা। এতে কয়েক লাখ হেক্টর জমি বেরিয়ে আসবে। তখন আবাদ এলাকা বাড়ানো সম্ভব হবে। সরকার বর্তমানে আমদানিনির্ভর শস্যটির উৎপাদন বাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে কাজ করছে। এজন্য কৃষককে স্বল্প সুদে ঋণ দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি মূল্য সংযোজনের জন্য কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কৃষকদের যোগসূত্র তৈরি করা হচ্ছে। তাদের মধ্যে উদ্ভাবিত নতুন বিভিন্ন জাতের সম্প্রসারণও করা হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণ কর্মীরা ডালজাতীয় শস্য আবাদে কৃষকদের উৎসাহ পরামর্শ দিয়ে আসছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন