বেনাপোল-পেট্রাপোল স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ-ভারতের আমদানি-রফতানি বন্ধ

দ্রুত সমস্যা সমাধানে কূটনৈতিক পর্যায়ে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হোক

দীর্ঘ ১০০ দিন পার হয়ে গেলেও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ রফতানি পণ্য না নেয়ায় বুধবার ( জুলাই) সকাল থেকে বেনাপোল-পেট্রাপোল বন্দর দিয়ে রফতানিকারকরা এক হয়ে বন্ধ করে দিয়েছেন আমদানি বাণিজ্য কার্যক্রম। ১০০ দিন পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশ থেকে কোনো পণ্য চালান ভারতে রফতানি হয়নি, অথচ ৭৭ দিনের মাথায় ভারতীয় পণ্য বাংলাদেশে আসা শুরু হয়। করোনা সংক্রমণের শঙ্কায় নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে ভারতীয়রা বাংলাদেশ থেকে কোনো রফতানি পণ্য গ্রহণ করছেন না। ফলে আমদানি কার্যক্রম স্বাভাবিক থাকলেও ব্যাহত হচ্ছে রফতানি। বাড়ছে বাণিজ্য ঘাটতি। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন রফতানিকারকরা। বৈদেশিক আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ। দেশে স্থলপথে যে রফতানি হয়, তার ৭০ শতাংশ হয় বেনাপোল বন্দর দিয়ে। প্রতি বছর বন্দর দিয়ে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা মূল্যের নয় হাজার টন বাংলাদেশী পণ্য ভারতে রফতানি হয়। ফলে বন্দর দিয়ে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে হাজার কোটি টাকা।

প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক না থাকলে সমৃদ্ধি কখনই স্থায়ী টেকসই হয় না’—একথা ব্যক্তির ক্ষেত্রে যেমন সত্যি, তেমনি রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। একই অঞ্চলে অবস্থিত রাষ্ট্রগুলো যদি পরস্পরকে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে না আসে, তাহলে সেই দেশগুলো কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় অর্থনৈতিক সামাজিক উন্নতি করতে পারে না। তাই প্রতিটি দেশই চেষ্টা করে কীভাবে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক সৃষ্টি এবং বজায় রাখা যায়। কিন্তু এই সুসম্পর্ক সৃষ্টি বজায় রাখার ব্যাপারটি খুবই জটিল। চাইলেই সুসম্পর্ক সৃষ্টি করা সম্ভব হয় না। কোনো দেশ, বিশেষ করে বড় প্রতিবেশী দেশ যদি আন্তরিকতা প্রদর্শন না করে তাহলে এই দ্বিপক্ষীয় সুসম্পর্ক কোনোভাবেই স্থাপিত হয় না। বিশ্বব্যাংক গ্লাস হাফ ফুল, প্রমিজ অব রিজিওনাল ট্রেড ইন সাউথ এশিয়াশীর্ষক এক প্রতিবেদনে এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃবাণিজ্য বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়েছে। প্রকাশিত প্রতিবেদনে আন্তঃবাণিজ্যের স্বল্পতার কারণে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্তঃবাণিজ্যের স্বল্পতার কারণে দেশটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সম্পর্কের ইতিবাচক অঙ্গীকার থাকা সত্ত্বেও শুল্ক অশুল্ক বাধা এবং কার্যকর উদ্যোগের অভাবে দেশটি বাণিজ্য ক্ষেত্রে বিপুল সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারছে না। ডুয়িং বিজনেস সহজীকরণ করা গেলে বিদ্যমান অবস্থাতেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য দেড় গুণ বাড়ানো সম্ভব। এজন্য দেশ দুটির মধ্যে বিদ্যমান যোগাযোগ অবকাঠামো আরো উন্নত করতে হবে। কার্যকর বাণিজ্য সহায়ক পরিবেশ না থাকার কারণে প্রতি বছর বিপুল বাণিজ্য ক্ষতির শিকার হচ্ছে উভয় দেশ। 

একটি অঞ্চল বা দেশ যদি তাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্ভাবনাকে পুরোমাত্রায় কাজে লাগাতে চায়, তাহলে অবশ্যই আন্তঃবাণিজ্যের হার বাড়াতে হবে। কিন্তু নানা বাধার সৃষ্টি করে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্নিত করছে অনেকে। বর্তমানে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যের প্রধান অন্তরায় হলো বন্দরগুলো বন্ধ; এগুলো খোলা রাখার ব্যবস্থা করে পুরোপুরি কার্যকর করতে হবে। লোড-আনলোড শেড, গুদামজাত ইত্যাদির মতো অবকাঠামোগত সুবিধা বাড়াতে হবে। পণ্য রফতানির চালান দ্রুত নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ দেয়াও জরুরি। পাশাপাশি বিমানবন্দরগুলোর মতো স্থলবন্দরের কার্যক্রম ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা দরকার। বর্তমানে ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যের সবচেয়ে বড় বাধা হলো স্থলবন্দরগুলো বন্ধ রাখা। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে সরকারসহ সব পক্ষকে জানানো হয়েছে। এরই মধ্যে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার স্থলবন্দর খুলে দেয়ার জন্য রাজ্য সরকারগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু রাজ্য সরকারের নিজস্ব পলিসির কারণে বন্দরগুলো খুলে দেয়া হচ্ছে না। বন্দরগুলো দ্রুত খুলে দেয়ার জন্য আমাদের সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। ভারতের হাইকমিশনারসহ ওই দেশের কেন্দ্রীয় রাজ্য সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের পররাষ্ট্র বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে এখনই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবির) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রায় ১০ শতাংশ এককভাবে ভারতের সঙ্গে হয়, যা মোটেই কম নয়। এটি বাধাগ্রস্ত হলে শিল্প-কারখানা চালু রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার আমদানি-রফতানির অনুমতি দিলেও রাজ্য সরকারের একক সিদ্ধান্তের কারণে রফতানি কার্যক্রম স্বাভাবিক হচ্ছে না। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে ভারতের রাজ্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি না করলে এর সুরাহা হবে না। তিন মাসেরও বেশি দিন ধরে রফতানি বন্ধ। পণ্যের রফতানি অর্ডার আসছে। কিন্তু পাঠানো যাচ্ছে না। রফতানির জন্য তৈরি করা কোটি কোটি টাকা মূল্যের পণ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকায় বড় ক্ষতির মুখে পড়েছেন দেশের ব্যবসায়ীরা। স্থলবন্দরগুলোয় আমদানি-রফতানিতে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। দুই দেশের কূটনৈতিক পর্যায়ে সমস্যা সমাধানে দ্রুত উদ্যোগ না নেয়া হলে ব্যবসা-বাণিজ্য আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন