বিজ্ঞতায় অসাধারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকার

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন

আমাদের শ্রদ্ধেয় প্রয়াত আল্লাহ মালিক কাজেমী একজন অসাধারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকার ছিলেন। বিভিন্ন জটিল বিষয় যেমন রিয়েল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট, মুদ্রানীতি, মুদ্রা সরবরাহ, মুদ্রা ব্যবস্থাপনা, সাধারণভাবে তফসিলি ব্যাংক ইত্যাদি বিষয়ে বড় ধরনের তার কর্মক্ষমতা ছিল। আমার পরিষ্কার মনে আছে, ১৯৯৮ সালে অন্য কয়েকজনকে ডিঙিয়ে তাকে নির্বাহী পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হলে সবাই ভেবেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভেতর থেকে তিনিই হবেন প্রথম গভর্নর। নিজে গভর্নর হননি বটে, কিন্তু তিনি পাঁচজন গভর্নর, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ব্যাংকিং ব্যবস্থা, মুদ্রানীতি, বিনিময় নীতি প্রভৃতির পক্ষে এমনভাবে সাহায্য করেছেন যে তার সহায়তা ছাড়া এসব কাজ হয়তো সহজ হতো না। খুবই সাদামাটা, অথচ তিনি ছিলেন বিশাল হূদয়ের মানুষ। তার সততা ছিল একেবারেই প্রবাদতুল্য।

সামামাটা লোক হলেও কাজেমীকে সবাই কদর করতেন, সম্মান করতেন। বর্তমান গভর্নর তাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকিংয়ে কিংবদন্তি হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, তিনি একটা প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি নন। সবই তার জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু সবচেয়ে যেটি প্রযোজ্য তা হলো, তার জ্ঞান ছিল অসীম; তার বিচক্ষণতা ছিল প্রশংসনীয়। কিন্তু তার কোনো রকম ভণিতা ছিল না। যেকোনো বিষয়ে তার সঙ্গে পরামর্শ করতে গেলে তিনি সময় নিতেন। এজন্য নিতেন যে উত্তরটা হয়তো তার জানাই ছিল, কিন্তু গভর্নর যেন মনে করেন খুব কঠিন প্রশ্ন; যার জন্য কাজেমীর মতো লোককেও উত্তর খুুঁজে জানাতে হচ্ছে। তিনি ২২ বছর আমার সহকর্মী ছিলেন, আমার সহযোগী ছিলেন, আমার বন্ধু ছিলেন। তার কাছ থেকে অনেক পেয়েছি। তাকে তেমন কিছু দিতে পারিনি। তবে প্রার্থনা যে মহান আল্লাহ তাআলা যেন তাকে বেহেশত নসিব করেন।

কাজেমী যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অনাচারের বিরুদ্ধে খুব মিষ্ট অথচ দৃঢ়ভাবে প্রতিবাদ করে গেছেন। তিনি প্রতিবাদ করা এজন্য শিখিয়েছেন যে আমরা যেন সংশোধন করে বিপর্যয় থেকে ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে উত্তরণ ঘটিয়ে আমাদের দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে জোরালোভাবে কাজে লাগাতে পারি। 

মনে আছে আমার পূর্বসূরি গভর্নর লুত্ফর রহমান ঋণখেলাপিদের একটি তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন। আমরা সেটিকে বিস্তৃত করেছিলাম। আমরা ঘোষণা দিয়েছি, ঋণখেলাপি সামাজিক সন্ত্রাসী বৈ আর কিছুই নয়। তিনি এটা দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেছিলেন। আমরা ৫৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলাম। মামলায় আমরা জিতেছিলাম।  তিনি সার্বক্ষণিকভাবে এটা নিয়ে পড়েছিলেন, উৎসাহ দিয়ে গেছেন। আরেকটি বিষয় আমার মনে আছে, আওয়ামী লীগ হেরে গেছে নির্বাচনে। বিএনপি তখনো মন্ত্রিসভা গঠন করেনি। আমার মেয়াদ তখন ৫১ দিন বাকি আছে। মোটামুটিভাবে শ্রদ্ধা-ভালোবাসা নিয়েই আছি। কিন্তু হঠাৎ নিচের দিকে কিছু পদোন্নতিকে কেন্দ্র করে গভর্নরের অফিস ঘেরাও হয়েছিল। কাজেমী রুহুল আমিন (আরো একজন শ্রেষ্ঠ কেন্দ্রীয় ব্যাংকার) দুজনই আমার অফিসের সামনে এসে শুয়ে পড়েছিলেন। তারা আমাকে রক্ষা এবং আন্দোলনকারীদের নিবৃত্ত করতে বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন।

আরেকটি স্মৃতির কথা উল্লেখ করব। কাজেমী হঠাৎ অসুস্থ হওয়ার খবর পেয়ে খুব তাড়াতাড়ি তার বাড়িতে গিয়েছিলাম। মিসেস কাজেমীর সঙ্গে আলাপ করে বুঝতে পেরেছি যে আর্থিক সংগতি একটু কম। কিন্তু আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সাহায্য পেতে একটু কুণ্ঠাবোধ করছেন। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে চিকিৎসা করে দুদিন পর তাকে দিল্লি পাঠিয়েছিলাম আরো ভালো চিকিৎসার জন্য। আমার সময়ে তিনি নিজেকেও উন্নয়ন করছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকার হিসেবে। মাত্রই নির্বাহী পরিচালক। তখন মাত্র ছয়জন নির্বাহী পরিচালক ছিলেন। এখন কিন্তু ৩২ জন। ব্যক্তিগতভাবে আমি তার কাছে ঋণী। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনেক জটিল দুরূহ বিষয় আমি তার কাছ থেকে শিখেছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রাপ্রবাহ, মুদ্রানীতি, রিয়েল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট, বিনিময় হার, ফিসক্যাল পলিসির মধ্যে যে একটা সমন্বয়-সংঘাত আছে, এসব বিষয়ে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। কারণ আমি ব্যাংকার ছিলাম না; মূলত ছিলাম আমলা। কিন্তু কাজেমী আমাকে এসব বিষয় এমনভাবে শিখিয়েছেন, মনে হয়নি আমার কোনো অধীনস্থর কাছ থেকে শিখছি। মনে হয়েছে ওস্তাদের কাছ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং শিখছি। তাকে অন্তরের অন্তঃস্তল থেকে গভীর শ্রদ্ধা জানাই।

 

. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন