শুক্রবারে বিয়ে করেছিলেন যাতে ছুটি নিতে না হয়

মো. আবুল কাশেম

মিঠু ছিল তার ডাকনাম। একই সঙ্গে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগদান করেছিলাম। ফলে ব্যাংকে কাজের সূত্র ছাড়াও ব্যক্তিগত পারিবারিকভাবে ঘনিষ্ঠ ছিলাম আমরা। কোনো রকম ছুটি না নিয়ে এক শুক্রবার কাজেমী বিয়ে করেন। সস্ত্রীক আমি আর দুজন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সে বিয়েতে যোগদান করি। কোনো রকম বাহুল্য, জাঁকজমক ছিল না তাতে।

কাজেমী অত্যন্ত যুক্তিবাদী সাহসী ছিলেন। আমাদের একজন নির্বাহী পরিচালক সোনালী ব্যাংকের এমডি হিসেবে ডেপুটেশনে যান। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকে ইনসেনটিভ বোনাসের আবেদন করেন। তত্কালীন গভর্নর নূরুল ইসলাম বিষয়টি পরীক্ষা করার জন্য তখনকার পার্সোনাল ডিপার্টমেন্টে পাঠান। কাজেমী তখন রেগুলেশন শাখায় এডি (এন্ট্রি পদ)

তখন বিধান ছিল ৩০ জুনের আগে কমপক্ষে ছয় মাস ব্যাংকে কাজ করলে ইনসেনটিভ বোনাস প্রাপ্য হবে। একজন এডির নোট প্রস্তাব গভর্নরের অনুমোদন লাভ করল কোনো রকম পরিবর্তন ছাড়াই। আমিও তখন পার্সোনাল কাজ করি। বললাম, আপনি করেছেন কী? ইডির বোনাস কেটে দিলেন আপনি! তিনি বলেন, আমি কিছুই করিনি, দেখুন নূ করেছে। গভর্নর নূরুল ইসলামনূ অনুস্বাক্ষরে প্রস্তাব অনুমোদন করেন। এখনকার কোনো এডির এমন সাহস নেই। যুক্তি প্রদানের যোগ্যতাও হয়তো নেই।

টাকা-পয়সা, ঘরবাড়ি, অর্থসম্পদের প্রতি কখনো লোভ ছিল না তার। কনসালট্যান্ট হিসেবে যোগদানের সময় জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কত সম্মানী চান? জবাব দেন, ৫০ হাজার টাকা। গভর্নর বলেন, অ্যাকাউন্টস কিংবা অডিটের চুক্তিবদ্ধ জিএম পদমর্যাদার কর্মকর্তারাই তো - লাখ টাকা পান। কাজেমী বলেন, গরিব মানুষ আমি, এতেই চলবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গৃহনির্মাণ ঋণ নিয়ে সবাই বাড়ি করেছেন, বাস করছেন, ভাড়া পাচ্ছেন; অথচ তিনি কোনো ঋণই নেননি।

প্রথমবারের মতো ডিজিএমদের বাড়িতে টিঅ্যান্ডটি টেলিফোন দেয়া হয়। কিন্তু কাজেমী তা পাননি। সবার আগে গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের বাসায় দেয়ার বিধান ছিল। কিন্তু ফরেন এক্সচেঞ্জের ডিজিএম হয়েও তিনি বঞ্চিত ছিলেন। নিয়ে তার কোনো ক্ষোভ ছিল না। বিষয়টি নিয়ে তখন দৈনিক রূপালীতে খবরও ছাপা হয়েছিল।

নিজে কঠোর শৃঙ্খলাপরায়ণ এবং ব্যাংকের প্রতি কমিটেড ছিলেন, তবে কেউ প্রশাসনিক শৃঙ্খলা অর্থাৎ চার্জশিটে খেয়ে পরামর্শ চাইলে সাহায্য করতেন। সিলেট অফিসে কাজ করার সময় একজন সিবিএ নেতাকে পরামর্শ দিয়ে সুরক্ষা করেন, চাকরি বাঁচানটেররম্যানেজারের হাত থেকে। আরেকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন এফএসআরপি পরামর্শক ফরেস্ট কুকসন, তার চাকরি প্রায় যায় যায়। কাজেমীর রিপোর্টে তিনি সেবার চাকরি বাঁচান।

অনুষ্ঠান, বক্তৃতা, বিদায় অনুষ্ঠান, বরণসভা পছন্দ করতেন না। যুক্তরাজ্যের ব্যাংগরে মাস্টার্স পড়তে যাওয়ার আগে বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ এক বিদায়সভার আয়োজন করলে তিনি তা এড়িয়ে যান। ডেপুটি গভর্নর পদ থেকে অবসর নেয়ার দিন তিনি অফিসেই আসেননি সকালে; পরে গভর্নরের ব্যক্তিগত ফোনে আসেন নির্বাহী কমিটির সভার কোরাম হবে না বলে।

সততার প্রকৃষ্টতম উদাহরণ ছিলেন কাজেমী। রাজশাহী অফিস থেকে জিএম পদে পদোন্নতি পেয়ে বাসে চড়ে রংপুর যোগদান করেন এবং সেমতে ভ্রমণবিল করেন। রংপুর অফিস তখন ভয়ে কম্পমান, প্রথম শ্রেণীর প্রাধিকার-প্রাপ্যতা অনুযায়ী কেউ বিল করতে পারবে না; কারণ জিএম নিজে তা করেননি। পরে ভয়ে ভয়ে একজন কর্মকর্তা তার কাছে তা বললে তিনি বলেন, আমারটা আমি করেছি, আপনাদেরটা আপনারা করবেন।

যুক্তরাজ্য থেকে মাস্টার্স করে ফিরে আসার দিন ভাবিসহ আমরা বিমানবন্দর গিয়েছিলাম অভ্যর্থনা জানাতে। আমরা বাইরে থেকে দেখছি তিনি এই কাউন্টার থেকে ওই কাউন্টারে যাচ্ছেন; বেরোচ্ছেন না। পরে জিজ্ঞাসার জবাবে বলেন, আমার কাছে করযোগ্য একটা জিনিস ছিল। তা দিতে দেরি হয়। কর দিতে হয় হাজার ৭০০ টাকা, অবশ্য ৫০০ টাকা নগদে তাদের দিলেই সমস্যা চুকে যেত। কিন্তু আমি তা করব না!

কাজেমী খুবই কৌশলী ছিলেন। ব্যাংকের কোনো বদনাম হোক, একদম চাইতেন না। সিলেট অফিসে কাজ করার সময় (আমিও তখন সেখানে কাজ করি) এক গোয়েন্দা সংস্থা যায় একটি তদন্তে: ম্যানেজারের অফিসকক্ষে সরকারপ্রধানের ছবি টানানো নেই! তিনি গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের চা-বিস্কুটে আপ্যায়নে ব্যস্ত রেখে ওয়াশরুমে যাওয়ার নাম করে বের হয়ে যান। উপরতলায় সোজা ম্যানেজারের রুমে গিয়ে প্রেসিডেন্ট এরশাদের ছবি টানিয়ে সে যাত্রা রক্ষা করেন। নইলে ব্যাংকের দুর্নাম হতে পারত, ব্যক্তিগতভাবে ম্যানেজার চার্জশিট-চাকরিচ্যুত হতে পারতেন।

সৎসাহস ছিল তার। হঠকারিতা নয়। মতিঝিল কোয়ার্টারে ব্যাংকের অনুদানে পরিচালিত স্কুলের ছুটির তালিকা থেকে ইসলাম ধর্মীয় একটি ছুটি কেটে দিতে চেয়েছিলেন সভাপতি মোহাম্মদ রুহুল আমীন। কাজেমী বাধা দেন এই বলে যে তাতে অনর্থক ছাত্র উত্তেজনার সৃষ্টি হবে; সভাপতি পরে বিরত হন।

কাজেমির ব্যক্তিজীবনে এমন একটি ঘটনা ঘটে গেছে অনেকে জানেন না। ইরাক যেদিন কুয়েত দখল করে নেয়, সেদিন একটি রেমিট্যান্স আহরণ মিশনে সোনালী ব্যাংকের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে কুয়েতে ছিলেন। পরদিন দেশই দখল হয়ে যায়, তাদের হোস্ট লাপাত্তা হয়ে যায়, দখলদার বাহিনী হোটেল থেকে তাদের বের করে দেয়। অনেক কষ্টে গাধা-ঘোড়ার পিঠে চড়ে, বাসে, পায়ে হেঁটে হার্টের রোগী সহযাত্রীকে নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দেন। পরে কোনো রকমে বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়ে পরিচয়-পাসপোর্ট দেখিয়ে দেশে ফেরেন দুজন। বেশ অনেকদিন কোনো যোগাযোগ ছিল না ব্যাংক, দেশ বা পরিবারের সঙ্গে। এক দুঃসহ জীবন কেটেছে ভাবীর, পরিবারের তখন। অন্য যে কেউ হলে ব্যাপক প্রচার করতেন ঘটনা।

আমি অনেক ক্ষেত্রে তার ব্যক্তিগত পরামর্শে উপকৃত হয়েছি। দ্বিতীয়বার ডেপুটি গভর্নর হওয়ার আকাঙ্ক্ষা-আবেদনপত্রের খসড়ায় তিনি সুন্দর পয়েন্ট যুক্ত করে দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন সরাসরি তা অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠাতে। আরেকটি তদন্ত প্রতিবেদনের শেষ অংশে গুরুত্বপূর্ণ মত লিপিবদ্ধ করে দিয়েছিলেন। গভর্নরের একটি ছবি-সংবাদ দেখে তিনি খুবই অসন্তুষ্ট হন। ছবি-সংবাদে দেখা যায় গভর্নর একটি লিজিং কোম্পানির সিএসআর খাতের বই গ্রহণ করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক মতিঝিল হাইস্কুলের জন্য ওই বই গ্রহণ করা হয়েছিল।

এক জুনের শেষ দিকে গভর্নরের সঙ্গে কাজেমী জার্মানি সফরে যান। তার বড় মেয়ে তখন জার্মানিতে। গভর্নর দেশে ফিরে আমায় বলেন, ‘দেখেছ কাজেমী ভাইয়ের ব্যাংকের প্রতি কী কমিটমেন্ট! তিনি তার মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাননি, মেয়েটিকে অন্য শহর থেকে ডেকে হোটেলে এনে দেখা করেছেন!’

 

মো. আবুল কাশেম: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন