আল্লাহ মালিক কাজেমী ছিলেন মানবিক এক সত্তা

মুরশিদ কুলী খান

বাংলাদেশ ব্যাংকের উপদেষ্টা আল্লাহ মালিক কাজেমীর প্রয়াণ বড় অসময়ে। মানবিক এক কেন্দ্রীয় ব্যাংকার ছিলেন তিনি। প্রচারবিমুখ মানুষটি সামাজিক অনুষ্ঠানেও যোগ দিতেন খুবই কম। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হয়ে বিদেশ সফরেও তেমন আগ্রহ ছিল না তার। অথচ সেখানে বিদেশ যেতে অন্যদের লাইন লেগে যেত। ২০০০ সালের দিকে দিল্লিতে তার হার্টের অপারেশন করানো হয়। তখন দেশে হার্টের অপারেশন হতো না। অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসার মতো অর্থও ছিল না তার। বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরে তত্কালীন গভর্নর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সহায়তা করেন। অর্থে ভারতে চলে তার চিকিৎসা। খুবই সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি।

আল্লাহ মালিক কাজেমীর সঙ্গে আমার পরিচয় বহু আগে। আমরা একই যুক্তরাজ্যের একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়েছি। তিনি যখন শেষ করে দেশে ফিরছেন, আমি তখন পড়তে যাচ্ছি। একটি স্মৃতি এখন খুবই মনে পড়ছে। তিনি যুক্তরাজ্য ছেড়ে চলে আসার সময় তার টিভিটি আমাকে দিয়ে এসেছিলেন ব্যবহারের জন্য। অর্থনীতির ছাত্র না হয়েও যে পাণ্ডিত্য তিনি দেখিয়েছেন, আর্থিক খাত পরিচালনায় তা অনন্য। 

আল্লাহ মালিক কাজেমী ছিলেন তাত্ত্বিকভাবে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সবচেয়ে ভালো কেন্দ্রীয় ব্যাংকার। কাজেমীকে গভর্নর করা হলে দেশের আর্থিক খাত আরো এগিয়ে যেত নিঃসন্দেহে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতর থেকে পর্যন্ত কোনো গভর্নর নির্বাচিত হননি। অনেক সময় তো অতিবাহিত হলো, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে গভর্নর নির্বাচিত হলে মাঝেমধ্যে ভালো ফল মিলতে পারে।

আল্লাহ মালিক কাজেমী ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগদান করেন। এরপর ২০০২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর পদে থেকে নিয়মিত চাকরি শেষ করেন। ২০০৮ সালে তাকে চুক্তিভিত্তিক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর কয়েক দফায় মেয়াদ বেড়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ওই পদেই বহাল ছিলেন। বৈদেশিক বাজার মুদ্রা ব্যবস্থাপনা, তারল্য ব্যবস্থাপনা, মুদ্রানীতি প্রণয়নসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার বিচরণ ছিল। ব্যাংক খাতের যেকোনো সমস্যা, নতুন নীতি প্রণয়নে তিনি পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংক নয়, বাণিজ্যিক ব্যাংক ব্যবসায়ীরাও তার কাছে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ নিতেন।

২০০৮ সালে তাকে চুক্তিতে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর কয়েক দফা তার মেয়াদ বাড়ানো হয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ওই পদেই ছিলেন আল্লাহ মালিক কাজেমী। বৈদেশিক বাজার মুদ্রা ব্যবস্থাপনা, তারল্য ব্যবস্থাপনা, মুদ্রানীতি প্রণয়নসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার বিচরণ ছিল। ব্যাংক খাতের যেকোনো সমস্যা, নতুন নীতি প্রণয়নে তিনি পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংক নয়, বাণিজ্যিক ব্যাংক ব্যবসায়ীরাও তার কাছে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ নিতেন।

কাজেমীর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত স্মৃতিও রয়েছে। আমার ছেলে যখন হাসপাতালে ভীষণ অসুস্থ, তখন কাজেমী মিসেস কাজেমী ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছেন শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে।

আল্লাহ মালিক কাজেমী ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, বিজ্ঞ সৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংকার। তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রফেশনাল। দেশের ব্যাংকিং অর্থনীতি বিষয়ে তার ছিল অগাধ জ্ঞান। তার ছিল তাত্ত্বিক জ্ঞান। দেশের বৈদেশিক মুদ্রানীতিতে তিনি ছিলেন অনন্য। তার সমকক্ষ আর একজনও দেশে সৃষ্টি হয়নি।  তিনি একাধারে ছিলেন সৎ, বিজ্ঞ, মেধাবী নিরহংকারী। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য কাজেমী সবকিছু উজার করে দিয়েছেন। করোনাকালে দেশের অর্থনীতিতে যে ধাক্কা লেগেছে, তা কাটিয়ে উঠতে তার প্রয়োজন ছিল খুব। কাজেমীর চলে যাওয়া আমাদের জন্য বড় ধরনের ক্ষতি। তার শূন্যতা সবসময় অনুভূত হবে। তবে সময়ে সবচেয়ে বেশি অনুভূত হবে।

 

মুরশিদ কুলী খান: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন