আজ শুরু হতে যাওয়া নতুন অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট পাস হয়েছে জাতীয় সংসদে। গতকাল স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের অধিবেশনে কণ্ঠভোটে এ বাজেট পাস হয়। গতকাল সংসদের অধিবেশন শুরু হয় বেলা ১১টায়। শুরুতেই মঞ্জুরি দাবিতে আলোচনা করার কথা জানান স্পিকার। বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা এসব দাবিতে আলোচনা করেন।
এর আগে গত ১১ জুন সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। অর্থমন্ত্রীর বাজেট পেশের পর এর ওপর স্বল্প সময়ের জন্য আলোচনা হয় সংসদে।
সংসদের বাজেট অধিবেশন সাধারণত দীর্ঘ হয়। অধিবেশনে সম্পূরক বাজেটের ওপর দুই থেকে চারদিন এবং সাধারণ বাজেটের ওপর ১২ থেকে ১৫ দিন আলোচনা হয়। বাজেট নিয়ে ৫০ থেকে শুরু করে ৬৫ ঘণ্টার মতো আলোচনা রেকর্ড রয়েছে। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে এবার বাজেট অধিবেশন ছিল অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে ভিন্ন। এবার সম্পূরক বাজেটের ওপর একদিন আলোচনা করে সেদিনই তা পাস করা হয়। মূল বাজেটের ওপর আলোচনা হয় মাত্র দুদিন। গতকাল পর্যন্ত মোট সাত কার্যদিবস চলে সংসদ। সোমবার পাস হয় অর্থবিল।
জাতীয় সংসদের অধিবেশন নতুন অর্থবছরের বাজেট ব্যয়ের বাইরে সরকারের বিভিন্ন ধরনের সংযুক্ত দায় মিলিয়ে মোট ৭ লাখ ৫৯ হাজার ৬৪২ কোটি ৪৪ লাখ ২১ হাজার টাকার নির্দিষ্টকরণ বিল কণ্ঠভোটে পাস হয়েছে। এর মধ্যে সংসদ সদস্যদের ভোটে গৃহীত অর্থের পরিমাণ ৫ লাখ ২৩ হাজার ৪৪৪ কোটি ২৪ লাখ ৭ হাজার এবং সংযুক্ত তহবিলের ওপর দায় ২ লাখ ৩৬ হাজার ১৯৮ কোটি ২০ লাখ ১৪ হাজার টাকা। সংযুক্ত তহবিলের দায়ের মধ্যে ট্রেজারি বিলের দায় পরিশোধ, হাইকোর্টের বিচারপতি ও মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের বেতনও অন্তর্ভুক্ত।
মঞ্জুরি
দাবি ও
ছাঁটাই প্রস্তাব:
নতুন
অর্থবছরের বাজেটের ওপর সংসদে উত্থাপিত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ খাতের ৫৯টি মঞ্জুরি দাবির বিপরীতে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, বিএনপির সংসদ সদস্যরা ৪২২টি বিভিন্ন ধরনের ছাঁটাই প্রস্তাব আনেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীদের অনুপস্থিতিতে তাদের পক্ষে কয়েকটি দাবি সংসদে তোলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্যে আইন মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের দাবি ও ছাঁটাই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। বিরোধী দলের আলোচনার পর সব প্রস্তাব কণ্ঠভোটে বাতিল হয়ে যায়।
ছাঁটাই প্রস্তাবগুলো দেন জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ, মুজিবুল হক চুন্নু, পীর ফজলুর রহমান, শামীম হায়দার পাটোয়ারী, লিয়াকত হোসেন খোকা, রওশন আরা মান্নান ও বিএনপির হারুনুর রশীদ।
৫ লাখ
৬৮ হাজার
কোটি টাকার
বাজেট: অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব সংসদে উপস্থাপন করেন, যা দেশের মোট জিডিপির ১৭ দশমিক ৯ শতাংশের সমান। তাতেই সায় দিয়েছে জাতীয় সংসদ।
নভেল করোনাভাইরাস সংকটের কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এবারের বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় খুব বেশি না বাড়িয়ে ২ লাখ ১৫ হাজার ৪৩ কোটি টাকা ধরা হয়েছে, যা বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত উন্নয়ন বাজেটের তুলনায় প্রায় ৬ দশমিক ২৭ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা, যা নিয়ম অনুযায়ী আগেই অনুমোদন করা হয়েছে।
এবার পরিচালন ব্যয় (ঋণ, অগ্রিম ও দেনা পরিশোধ, খাদ্য হিসাব ও কাঠামোগত সমন্বয় বাদে) ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৪৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা, যা বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত অনুন্নয়ন বাজেটের চেয়ে প্রায় ১৮ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে ৬৫ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধেই যাবে, যা মোট অনুন্নয়ন ব্যয়ের প্রায় ১৯ শতাংশ।
নতুন অর্থবছরের সম্ভাব্য ব্যয়ের ৬৬ শতাংশ তিনি রাজস্ব খাত থেকে পাবেন। তার প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। এ অংক বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত রাজস্ব আয়ের ৮ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে কর হিসেবে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা আদায় হবে। ফলে এনবিআরের কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। টাকার ওই অংক মোট বাজেটের ৫৮ শতাংশের বেশি।
এবারো সবচেয়ে বেশি কর আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট থেকে, ১ লাখ ২৫ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। এ অংক বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৩ দশমিক ৯৪ শতাংশ বেশি। বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে ভ্যাট থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা ছিল ১ লাখ ২৩ হাজার ৬৭ কোটি টাকা। লক্ষ্য পূরণ না হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে তা ১ লাখ ৯ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। আয়কর ও মুনাফার ওপর কর থেকে ১ লাখ ৩ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা রাজস্ব পাওয়ার আশা করা হয়েছে এবারের বাজেটে। বিদায়ী সংশোধিত বাজেটে এর পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২ হাজার ৮৯৪ কোটি টাকা।
এছাড়া নতুন বাজেটে আমদানি শুল্ক থেকে ৩৭ হাজার ৮০৭ কোটি টাকা, সম্পূরক শুল্ক থেকে ৫৭ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা, রফতানি শুল্ক থেকে ৫৫ কোটি টাকা, আবগারি শুল্ক থেকে ৩ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা এবং অন্যান্য কর ও শুল্ক থেকে ১ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা আদায়ের পরিকল্পনা করেছেন অর্থমন্ত্রী। বৈদেশিক অনুদান থেকে ৪ হাজার ১৩ কোটি টাকা পাওয়া যাবে বলে বাজেট প্রস্তাবে আশা প্রকাশ করেছেন তিনি।
এ বাজেটে আয় ও ব্যয়ের হিসাবে সামগ্রিক ঘাটতি থাকছে প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ৬ শতাংশের মতো। সাধারণত ঘাটতির পরিমাণ ৫ শতাংশের মধ্যে রেখে বাজেট প্রণয়নের চেষ্টা হলেও এবার তা সম্ভব হয়নি।
এ ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা করেছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি আশা করছেন, বিদেশ থেকে ৮০ হাজার ১৭ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৯ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা ঋণ করে ওই ঘাটতি মেটানো যাবে। অভ্যন্তরীণ খাতের মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে ৮৪ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে আরো ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে বাজেটে।
বিদায়ী অর্থবছরের ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হলেও কভিড-১৯ দুর্যোগের মধ্যে তা সংশোধন করে ৫ দশমিক ২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। নতুন বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারলে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৪ শতাংশের মধ্যে রেখেই ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে বলে আশা করছেন অর্থমন্ত্রী।