ভ্যাকসিন, চিকিৎসা ও টেস্টে ভাইরাসের মিউটেশনের প্রভাব

বণিক বার্তা ডেস্ক

নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে গোটা বিশ্ব বিপর্যস্ত আক্রান্ত মৃতের সংখ্যা যেন প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে তবে আশার ব্যাপার হচ্ছে ভাইরাস নির্মূলের কার্যক্রমও বেশ দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে জানুয়ারির শুরুতেই নভেল করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচিত করে দারুণ এক মাইলস্টোন অর্জন করেন বিজ্ঞানীরা এরপর সারা বিশ্বের হাজার হাজার সংক্রমিত রোগীর জিনোম সিকোয়েন্স করে দেখা হয়েছে

জিনোম সিকোয়েন্সের এই বিশাল সংগ্রহ বেশ গুরুত্বপূর্ণ সংস্থান বিশেষ করে করোনাভাইরাসের মিউটেশনের হার অনেক বেশি, যেখানে জিনোম সিকোয়েন্স .০২ শতাংশ পর্যন্ত পরিবর্তিত হতে পারে এটা শুনতে হয়তো কম মনে হতে পারে, কিন্তু মানুষের জিনোম বিবেচনায় নিলে দেখা যায় কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে কেবল .০০১ শতাংশ পর্যন্ত পরিবর্তিত হতে পারে এটা স্পষ্ট যে ভাইরাস আমাদের চেয়ে অনেক দ্রুতগতিতে মিউটেট হতে পারে এবং দ্রুত বিকশিত হতে পারে

বিভিন্ন সময়ে করোনাভাইরাসের এই সিকোয়েন্সিং আমাদের বলতে পারে এটা আসলে কীভাবে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিচ্ছে এবং সে সঙ্গে এটি কোন দিকে যাচ্ছে, তারও একটা ইঙ্গিত দিতে পারে

সম্প্রতি লন্ডন স্কুল অব হাইজিন এবং ট্রপিক্যাল মেডিসিন এক গবেষণায় বিশ্বের হাজার কভিড-১৯- আক্রান্ত রোগীর জিনোম সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ করে দেখা হয়েছে প্রশ্ন হচ্ছে জিনোমের বৈচিত্র্যগুলো আমাদের আসলে কী বলে? ভ্যাকসিন, চিকিৎসা টেস্টিংয়ের ক্ষেত্রেই বা এর প্রয়োগ কেমন হবে? এবং ভবিষ্যতে রোগের ধ্বংসাত্মক অভিমুখ নিয়েই বা এটি আমাদের কী বলে

ভ্যাকসিন

সব ভাইরাল ভ্যাকসিনের মাঝে এমন উপাদান রয়েছে যা কিনা তারা যে ভাইরাস থেকে রক্ষার চেষ্টা করছে তার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ এটা ইমিউন সিস্টেমকে প্রতিক্রিয়া বাড়ানোর জন্য প্ররোচিত করে এবং অ্যান্টিবডি উৎপাদন করে, যা আসল ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত হয় এই করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে ইমিউন সিস্টেম অ্যান্টিবডি উৎপাদন করে, যা স্পাইক প্রোটিনকে লক্ষ্য করে চালিত হয়, ভাইরাসের এই অংশ আমাদের কোষকে আক্রমণ করে

একটি উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে ভাইরাসটি এস্কেপ মিউটেন্টস (যেখানে ভাইরাস নিজেকে এমনভাবে বদলে নেয় যার ফলে ইমিউন সিস্টেম তার কোনো ক্ষতি করতে পারে না) গঠন করে পরিবর্তিত হতে পারে এমনকি ভ্যাকসিন দ্বারা তৈরীকৃত অ্যান্টিবডিগুলোও তার কোনো ক্ষতি করতে পারে না এমনটা আমরা অন্য ভাইরাসের ক্ষেত্রেও দেখেছি, যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা যে কারণে ফ্লু ভ্যাকসিনও প্রতি বছর পরিবর্তিত হয়

সৌভাগ্যবশত, নভেল করোনাভাইরাসের মিউটেশনের হার ইনফ্লুয়েঞ্জার চেয়ে কম গবেষণায় লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন এস জিনের পরিবর্তনগুলো চিহ্নিত করেছিল, এই জিনই স্পাইক তৈরি করেবিভিন্ন ধরনের ভাইরাস স্ট্রেইনের মধ্যে এই জিনের মিউটেশন খুবই বিরল

অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ

কার্যকর চিকিৎসার জন্য যার ওপর মনোযোগ দেয়া হয় তা হলো বিদ্যমান ওষুধ যেমন সাম্প্রতিক সময়ে ডেক্সামিথাসনের সফলতার কথা বলা হয়েছে, যদিও এই ওষুধটি ভাইরাসের হাইপারঅ্যাক্টিভ ইমিউন প্রতিক্রিয়াটিকে বাধা দেয় অন্যান্য প্রতিশ্রুতিশীল ওষুধ যেমন রেমডেসিভির সরাসরি ভাইরাসকে লক্ষ্য করে চালিত হয় রেমডেসিভির বিশেষ করে টার্গেট করে এনজাইমকে, যা প্রতিলিপি তৈরির জন্য ভাইরাসের প্রয়োজন

পূর্ববর্তী গবেষণায় এনজাইম জিনে দুবার মিউটেশন দেখা গেছে, যা রেমডেসিভিরকে প্রতিরোধ করে যদিও লন্ডন স্কুল অব হাইজিন এবং ট্রপিক্যাল মেডিসিনের গবেষণায় মিউটেশনের খুব বেশি উদাহরণ পাওয়া যায়নি তবে ওষুধের বিস্তৃত ব্যবহার ভাইরাসের ওপর চাপ তৈরি করতে পারে তবে পরিবেশগত কারণগুলো এই বিবর্তনে ভূমিকা রাখে তাই এই মিউটেশনগুলো পর্যবেক্ষণ করা গুরুত্বপূর্ণ

টেস্ট

বর্তমান সংক্রমণ নির্ণয়ের জন্য করা টেস্টগুলো ভাইরাস থেকে নির্দিষ্ট জিনের সন্ধান করে এই পরীক্ষাগুলোর সফলতা নির্ভর করে জিনোমের লক্ষ্যবস্তুগুলোর ওপর প্রথম ডায়াগনস্টিক পদ্ধতিটি প্রকাশ করা হয় ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স হওয়ার পর ভাইরাল স্ট্রেইনজুড়ে ভালোভাবে সংরক্ষিত বিবেচিত হওয়ার কারণে একটির বেশি ভাইরাল স্ক্রিনিং সম্পন্ন হয় ভালোভাবে সংরক্ষিত জিনগুলো ভাইরাসের কাজ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং তাই জীবের বিকাশের সঙ্গে এর পরিবর্তনের প্রবণতা দেখা যায় না বেশির ভাগ ডায়াগনস্টিক টেস্টগুলো দুই বা ততোধিক করোনাভাইরাস জিন স্ক্রিন করে থাকে, যেহেতু যে জিন তারা টেস্ট করে তা প্রায়ই পরিবর্তিত হয়

এলএইচটিএমের গবেষকরা সাধারণ ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার জন্য জিনোম স্ক্রিনের অঞ্চলে বিভিন্নতার সন্ধান করেছেন এবং দেখেছেন বেশকিছু মিউটেশনের কারণে ফলস নেগেটিভ আসতে পারে যেখানে একজনের রোগ হয়েছে কিন্তু পরীক্ষা বলছে হয়নি এই মিউটেশন ভৌগোলিকভাবে শক্তিশালী মাত্রায় বিস্তৃত হয়েছে তাই ক্লিনিক্যাল সায়েন্টিস্টদের প্রয়োজন আঞ্চলিকভাবে ছড়িয়ে থাকা স্ট্রেইনগুলোর দিকে লক্ষ রাখা, কারণ এর ফলেই কোন পরীক্ষা করতে হবে তা ঠিক করা যাবে

একইভাবে যখন আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধগুলো শিথিল হবে, তখন বাইরে থেকে আসা রোগীদের ক্ষেত্রে ফলস নেগেটিভ কেসগুলো সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে

বেশি নাকি কম ভয়ংকর?

করোনাভাইরাস এরই মধ্যে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হওয়ার স্থায়িত্ব অর্জন করেছে কিন্তু এটা কি অব্যাহত থাকবে? যদি তা হয়, তবে এই ভাইরাস কি আরো বেশি নাকি কম মরণঘাতী হিসেবে বিকশিত হবে?

অন্যান্য যেকোনো জীবের মিউটেশনের মতো ভাইরাল মিউটেশনও বিবর্তনের সুবিধা লাভ করে থাকে তবে যদি ভাইরাসটি তার হোস্টকেই হত্যা করে বসে তবে সেক্ষেত্রে তার কোনো বিবর্তনীয় সুবিধা নেই বিশেষ করে এটি যখন তার হোস্টকে নতুন কোথাও স্থানান্তরিত হওয়ার আগেই হত্যা করে ফেলে তবে সংক্রমিত ব্যক্তির উপসর্গ যেমন হাঁচি-কাশির মাধ্যমে নতুন হোস্টে সংক্রমিত হতে পারে এবং এক্ষেত্রে এটি বিবর্তনীয় সুবিধাও লাভ করতে পারে তবে কোন মিউটেশনটি ভাইরাসকে টিকে থাকতে সাহায্য করছে তা জানতে গবেষকরা কনভারজেন্ট মিউটেশনকে চিহ্নিত করতে প্রস্তুত (যে মিউটেশন পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ঘটেছিল এবং এলোমেলো হারের চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায় হয় এই মিউটেশন মূলত ভাইরাসকে টিকে থাকতে সাহায্য করে)

যদিও বিজ্ঞানীরা অনেক জিনোম বিশ্লেষণ করেছেন, তার পরও জিনোম-ডিজিজ সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা এখনো চলমান আছে দুর্ভাগ্যজনকভাবে জিনোম সিকোয়েন্সের ডাটাবেজে পক্ষপাত রয়েছে, কারণ গুরুতর অসুস্থ রোগীদের নমুনাকে সিকোয়েন্স করা হয়েছে যার ফলে রোগটি কতটা মারাত্মক তা জানার ক্ষেত্রে অসুবিধা তৈরি হয়েছে অবশ্যই রোগটি অন্যান্য সমস্যা দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে যেমন বয়স কিংবা রোগী কতটা অসুস্থ সেসব তার পরও বৈচিত্র্যসম্পন্ন জনগোষ্ঠীতে মৃদু উপসর্গ এবং উপসর্গবিহীন রোগীদের জিনোমের একটি বৃহৎ ডাটাসেট যতক্ষণ পর্যন্ত তৈরি করা না হবে, ততক্ষণ কনভারজেন্ট মিউটেশন কীভাবে রোগকে তীব্রতর রূপ দিচ্ছে তা জানা কঠিন হবে

স্ক্রলডটইন

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন