যখন মার্চের মাঝামাঝি সময়ে নিউইয়র্ক লকডাউন করা হয় এবং বেশির ভাগ গবেষণা আটকে গিয়েছিল, তখনো মাউন্ট সিনাইয়ের ইকহান স্কুল অব মেডিসিনে ভাইরোলজিস্ট বেনহুন লির ল্যাব চালু ছিল।
এই ল্যাব এবং এর ১০ জন গবেষক অধ্যয়ন করেছেন বিভিন্ন ভাইরাস থেকে সার্স-কোভ-২ নিয়ে, যা কিনা কভিড-১৯-এর জন্য দায়ী।
তবে স্কুল এবং ডে কেয়ার সেন্টারগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে জিলিয়ান কারমাইকেল নামে এক পোস্টডক ও ল্যাবের একমাত্র নারী সদস্য দলের সঙ্গে যোগ দিতে পারেননি।
বিপরীতে তিনি দুই মাস কুইন্সে ৬০০ বর্গফুটের অ্যাপার্টমেন্টে কাটিয়েছেন।
যেখানে তিনি তার ছয় বছরের কন্যা এবং তিন বছরের পুত্রের দেখাশোনা করেছেন।
যদিও বাসায় বসে তিনি কিছু কাজ সম্পন্ন করেছেন এবং তার স্বামীও শিশুদের দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করেছেন।
কিন্তু হার্পভাইরাস সম্পর্কিত তার গবেষণা আটকে যায় এবং ল্যাবে কভিড-১৯ নিয়ে গবেষণায়ও তিনি খুব বেশি অবদান রাখতে পারেননি।
তিনি বলেন, আমি সারা জীবন চেয়েছিলাম ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করতে।
এরপর যখন আমি ল্যাবের বদলে বাসায় বসে থাকলাম, তখন মনে হলো সেই জাহাজটা চলে যাচ্ছে, যেখানে আপনি উঠতে চেয়েছিলেন।
এরপর অবশেষে তিনি ও তার স্বামী সিদ্ধান্ত নিলেন তার স্বামী বাচ্চাদের নিয়ে পরিবারের সঙ্গে থাকার জন্য গ্রীষ্মে চলে যাবেন, ফলে কারমাইকেল গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার অধিক সুযোগ পাবেন।
তিনি বলেন, আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন যে আমার এমন পরিবার যারা আমাকে সাহায্য করছে।
কিন্তু আমি সত্যি জানি না আগস্টের পর আমি কী করব?
কারমাইকেলের অবস্থা সম্ভবত সেসব নারী একাডেমিশিয়ানের সঙ্গে মিলে যায় যারা একই সঙ্গে মায়ের ভূমিকাও পালন করছেন।
সম্প্রতি একটি সিরিজ গবেষণায় দেখা গেছে, উল্লেখযোগ্যভাবে নারী বিজ্ঞানীদের উৎপাদনশীলতা হ্রাস পেয়েছে।
বিশেষ করে যারা ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে আছে।
তবে কভিড-১৯ গবেষকদের ক্ষেত্রে এই লিঙ্গবৈষম্য বেশি চোখে পড়ছে।
এজন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চাইল্ডকেয়ারকে দায়ী করেছেন গবেষকরা।
যেখানে নারীদের বেশি ভূমিকা নিতে হয়।
বিজ্ঞানীরা শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন যে মহামারী বিজ্ঞান গবেষণায় নারীদের বিদ্যমান স্বল্প প্রতিনিধিত্ব করার বিষয়টিকে আরো ত্বরান্বিত করবে এবং নারীদের বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ক্যারিয়ার গড়ার বিষয়টিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির ইনফরমেশন সায়েন্টিস্ট ক্যাসিডি সুগিমোটো বলেন, এটা ধাক্কা লাগার মতো কিছু না।
কিন্তু এ রকম কিছু আমরা আগে থেকেই অনুভব করতে পারছিলাম।
যদি ইনস্টিটিউটগুলো এটাকে গুরুত্বের সঙ্গে না নেয়, আমরা জনগোষ্ঠীর নির্দিষ্ট একটি অংশের দুর্ভোগকে বাড়িয়ে দেব।
মহামারী বিদ্যমান বৈষম্যকে বাড়িয়ে দিচ্ছে
নারীরা গবেষণায় অনেকদিন ধরে অবমূল্যায়িত হয়ে আসছে।
বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এই উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে যে নারী-পুরুষ বৈষম্য আরো বাড়বে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মহামারী শুরুর পর থেকে দ্য ব্রিটিশ জার্নাল ফর দ্য ফিলোসফি অব সায়েন্সে নারীদের পেপার প্রদান করার সংখ্যা খুবই কম।
জার্নালের ডেপুটি এডিটর এলিজাবেথ হ্যানন বলেন, এ রকম অবস্থা আগে কখনো দেখিনি।
ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর পরিবেশবিদ ও জীববিজ্ঞানী মেগান ফ্রেডেরিকসোনসহ অনেক গবেষককে এ ধরনের কাল্পনিক হিসাব উৎসাহিত করেছে এটা দেখার জন্য যে এ ডাটা প্রকাশের জন্য কোনো ট্রেন্ড অনুসরণ হয়েছে কিনা।
এরপর তিনি একাধিক প্রিপ্রিন্ট সার্ভারে গিয়ে গবেষণা চালিয়ে দেখেন এ বছরের মধ্য মার্চ থেকে মধ্য এপ্রিলে আগের বছরের তুলনায় অনেক বেশি প্রিপ্রিন্টস জমা পড়েছে।
তার মতে, সেখানে বেশির ভাগই ছিল কভিড-১৯ মহামারী সম্পর্কিত।
যাই হোক, তার মতে ২০১৯ থেকে ২০২০ সালের মাঝে প্রিপ্রিন্টে পুরুষ সহ-রচয়িতার পরিমাণ যেখানে ৬.৪ শতাংশ বেড়েছে, সেখানে নারী সহ-রচয়িতার পরিমাণ বেড়েছে মাত্র ২.৭ শতাংশ।
১১টি বিভিন্ন ধরনের প্রিপ্রিন্টে গবেষণা চালিয়ে এই প্রবণতা লক্ষ করেছেন সুগিমোটোও।
তিনি ও তার সহকর্মীরা রিয়েল টাইম ট্রেকারও তৈরি করেছেন, যার ফলে যে কেউ সময়ের সঙ্গে এই ট্রেন্ডের বিকাশ লক্ষ করতে পারবে।
এদিকে নিউইয়র্ক টাইমসের এক গবেষণায়ও মহামারীকালীন পরিস্থিতিতে চাইল্ডকেয়ারের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মাঝে বেশ বড় ধরনের বৈষম্যের চিত্র উঠে এসেছে।
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে থাকা নারী গবেষকরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত
কারমাইকেলের মতো কিশানা টেইলর ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার একজন পোস্টডক।
তিনিও এক বছর বয়সী সন্তান নিয়ে বিপাকে পড়েছেন।
কারণ ডে-কেয়ারগুলো বন্ধ থাকায় সেখানেও তিনি পাঠাতে পারছেন না।
যদিও তিনি ও তার স্বামী চেষ্টা করছেন দায়িত্ব ভাগাভাগি করার।
তবে সব মিলিয়ে এ পরিস্থিতিতে তার ইনফ্লুয়েঞ্জার বিকাশ চলতে থাকা পোস্টডক প্রজেক্ট বেশ ক্ষতির মুখে পড়েছে।
পাশাপাশি এটাও অজানা যে এ পরিস্থিতি কবে শেষ হবে।
গত সপ্তাহ থেকে তিনি তার সন্তানকে ডে-কেয়ারে পাঠালেও তাতে স্বস্তি বোধ করতে পারছেন না।
দ্য সায়েন্টিস্ট