বুড়িগঙ্গায় লঞ্চডুবি

৩২ জনের মরদেহ উদ্ধার নিখোঁজ অর্ধশতাধিক

নিজস্ব প্রতিবেদক

মুন্সীগঞ্জ থেকে যাত্রী নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসা এমডি মর্নিং বার্ড নামের একটি লঞ্চ বুড়িগঙ্গা নদীতে ডুবে অন্তত ৩২ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিখোঁজ রয়েছেন আরো অর্ধশতাধিক। গতকাল রাজধানীর শ্যামবাজারের কাছে বুড়িগঙ্গা নদীতে চাঁদপুর থেকে আসা ময়ূর- লঞ্চের ধাক্কায় লঞ্চডুবির ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার পেছনে লঞ্চ মালিকদের কোনো গাফিলতি রয়েছে কিনা তা খুঁজে দেখার ঘোষণা দিয়েছেন নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, চাঁদপুর থেকে ছেড়ে আসা ময়ূর- ভোর সাড়ে ৪টার দিকে লালকুঠি ঘাটে যাত্রী নামিয়ে অন্য ঘাটে গিয়ে বার্থিং করে। পরে আবার যাত্রী তোলার জন্য ব্যাক গিয়ারে চাঁদপুর ঘাটে আসছিল। ওই সময় পেছনে নদীতে থাকা এমভি মর্নিং বার্ডের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। পরে উল্টে গিয়ে লঞ্চটি নদীতে ডুবে যায়।

দুর্ঘটনার পর পরই ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার তত্পরতা শুরু করে। পাশাপাশি নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, নৌ-পুলিশ বিআইডব্লিউটিএর কর্মীরাও সেখানে উদ্ধার অভিযানে অংশ নেন। ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে শ্যামবাজারের কাছে নদীতে চাঁদপুর থেকে আসা ময়ূর- লঞ্চের ধাক্কায় মর্নিং বার্ড লঞ্চটি ডুবে যায়। সময় লঞ্চে শতাধিক যাত্রী ছিলেন। পারে নদী থেকে প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ৩২টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নিখোঁজদের উদ্ধারে বুড়িগঙ্গা নদীতে অভিযান চলমান রয়েছে।

ডুবে যাওয়া লঞ্চটিতে অর্ধশতাধিক যাত্রীর তথ্য পাওয়ার কথা জানান বিআইডব্লিউটিএর পরিবহন পরিদর্শক মো. সেলিম। তিনি জানান, মুন্সীগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা মর্নিং বার্ডে অর্ধশতাধিক যাত্রী ছিল বলে তারা তথ্য পেয়েছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন সাঁতরে তীরে উঠতে পারলেও অনেকেই ভেতরে আটকা পড়ে। তবে ঠিক কতজন নিখোঁজ রয়েছে, তা স্পষ্ট নয়।

এদিকে উদ্ধারকর্মীরা ঘটনাস্থল থেকে ৩০টি মরদেহ উদ্ধার করেন। এছাড়া স্থানীয়রা আরো দুজনকে উদ্ধার করে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন বলে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন সরদার জানান।

উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়া ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা জানান, যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার কাছাকাছি এলাকায় নদীর মাঝখানে ডুবে যাওয়া লঞ্চটি উল্টে রয়েছে। তাই ভেতরে কোনো মরদেহ আছে কিনা তা তল্লাশি করা যায়নি। কথা ছিল তল্লাশি শেষ হলে বিআইডব্লিউটিএর উদ্ধারকারী নৌযান ডুবে যাওয়া লঞ্চটি টেনে তুলে সরিয়ে নেবে। কিন্তু বাবুবাজার ব্রিজের নিচ দিয়ে উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয় আসতে না পারায় তা সম্ভব হয়নি।

এদিকে দুর্ঘটনার পর হাজার হাজার মানুষ ঘাটে এসে ভিড় করে। মর্নিং বার্ডের নিখোঁজ যাত্রীদের খোঁজে ঘাটে আসা স্বজনদের বিলাপ করতে দেখা যায়। ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা যেসব মরদেহ উদ্ধার করেছেন, তাদের মধ্যে যমুনা ব্যাংকের ইসলামপুর শাখার কর্মচারী সুমন তালুকদারকে শনাক্ত করেন তার বড় ভাই নয়ন তালুকদার। তিনি জানান, তাদের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের মীরকাদিমে। প্রতিদিন বাড়ি থেকে এসে পুরান ঢাকার ইসলামপুরে অফিস করতেন সুমন। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে লঞ্চে উঠে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন এক সন্তানের বাবা সুমন। পরে দুর্ঘটনার খবর পেয়ে এবং তার ফোন বন্ধ পেয়ে সদরঘাটে ছুটে আসেন তার ভাই। 

দুর্ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক বলেন, দুই লঞ্চের কর্মীদের অসতর্কতায় দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে তারা মনে করছেন। তবে দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে মনে হয়েছে এটি দুর্ঘটনা নয়, এটি একটি হত্যাকাণ্ড। এক্ষেত্রে লঞ্চ মালিকদের গাফিলতি আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে।

দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়। যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) মো. রফিকুল ইসলাম খানকে আহ্বায়ক এবং বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (নৌ-নিরাপত্তা) মো. রফিকুল ইসলামকে সদস্যসচিব করে গঠিত এই কমিটিকে সাতদিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

এদিকে নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জানিয়েছেন, লঞ্চডুবিতে মারা যাওয়া প্রত্যেকের পরিবারকে দেড় লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। পাশাপাশি মরদেহ দাফনের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রত্যেক পরিবারকে তাত্ক্ষণিকভাবে ১০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে বলে জেলা ত্রাণ পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ হোসেন জানান। বিআইডিব্লিউটিএর পক্ষ থেকেও নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে সহায়তা দেয়া হয়েছে জানিয়ে পরিচালক রফিকুল ইসলাম বলেন, ময়ূর- লঞ্চটি জব্দ করা হয়েছে। বিষয়ে তারা আইনি ব্যবস্থা নেবেন।

দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসি মোহাম্মদ শাহজামান জানান, যে ৩২ জনের মরদেহ মর্গে এসেছে, তাদের সবাইকে শনাক্ত করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তাদের সবার বাড়ি মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায়। এরা হলেন শাহাদাত হোসেন (৪৪), আবু তাহের বেপারী (৫৮), সুমন তালুকদার (৩৫), ময়না বেগম (৩৫), তার মেয়ে মুক্তা আক্তার (১৩), আফজাল শেখ (৪৮), মনিরুজ্জামান মনির (৪২), গোলাপ হোসেন (৫০), সুবর্ণা বেগম (৩৮), তার ছেলে তামিম (১০), আবু সাঈদ (৩৯), সুফিয়া বেগম (৫০), শহিদুল ইসলাম (৬১), মিজানুর রহমান কনক (৩২), সত্য রঞ্জন বণিক (৬৫), শামীম বেপারী (৪৪), বিউটি আক্তার (৩৮), আয়শা বেগম (৩৫), মো. মিল্লাত (৩৫), মো. আমির হোসেন (৫৫), সুমনা আক্তার (৩২), পাপ্পু (৩২), মো. মহিম (১৭), দিদার হোসেন (৪৫), হাফেজা খাতুন (৩৮), হাসিনা রহমান (৩৫), সিফাত (), আলম বেপারী, তালহা (), ইসমাইল শরীফ (৩৫), সাইফুল ইসলাম (৪২) বাসুদেব নাথ (৪৫)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন