শ্রদ্ধাঞ্জলি

অলিভার উইলিয়ামসন প্রথাবিবর্জিত এক অর্থনীতিবিদ

ড. মোহাম্মদ দুলাল মিয়া

অনেকটা নীরবেই চলে গেলেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অলিভার উইলিয়ামসন। গত ২১ মে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে ৮৭ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মার্কিন এই অর্থনীতিবিদ। নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাবে সারা বিশ্ব এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। তদুপরি বর্ণবাদ আন্দোলনে সারা যুক্তরাষ্ট্র টালমাটাল। অবস্থায় উইলিয়ামসনের মৃত্যুর খবরটা অনেকটা আড়ালেই রয়ে যায়। তবে পেশাগত জীবনে সর্বত্রই রয়েছে তার সাফল্যের দ্যুতি। পড়াশোনা করেছেন যেমন বিশ্বের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে, পড়িয়েছেনও সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৯ সালে পেয়েছেন অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার।

১৯৩২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যে জন্ম। এমএইটির স্লোয়ান স্কুল অব ম্যানেজমেন্ট থেকে ১৯৫৫ সালে স্নাতক শেষ করে প্রকল্প প্রকৌশলী হিসেবে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে এবং পরে ওয়াশিংটন ডিসিতেঅ্যান্টি-ট্রাস্টবিভাগে কাজ করেন। অল্প কিছুদিন পরেই আবার লেখাপড়ায় ফিরে আসেন এবং স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে ব্যাবসা প্রশাসনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তার মাত্র তিন বছর পর কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। অধ্যাপনা করেছেন পেনসিলভানিয়া, ইয়েল ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলেতে। লিখেছেন বেশকিছু বই এবং অসংখ্য প্রবন্ধ, যেগুলো অর্থনীতির বিভিন্ন জটিল বিষয়কে ব্যাখ্যা করেছে বাস্তবতার নিরিখে।

বিজ্ঞান ব্যবসা প্রশাসনের ছাত্র হয়েও অর্থনীতির প্রতি তার আগ্রহের প্রধান কারণ ছিল খ্যাতনামা কিছু অধ্যাপকের সংস্পর্শে আসা, যাদের কাজ উইলিয়ামসনকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো ক্যানেথ অ্যারো (১৯৭২ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত) তবে উইলিয়ামসনের একাডেমিক লেখালেখি তার পিএইচডির থিসিস সুপারভাইজার হারবার্ট সাইমন (১৯৭৮ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত) রোনাল্ড কোয়াসের (১৯৯১ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত) কাজের দ্বারাই বেশি প্রভাবিত।

রোনাল্ড কোয়াস মূলত অর্থনীতির একটি নতুন ধারার সূচনা করেছিলেন, তার বিখ্যাতট্রানজেকশন কস্টবালেনদেনের ব্যয়তত্ত্ব প্রবর্তনের মাধ্যমে। এই ট্রানজেকশন কস্ট তত্ত্বকোয়াস থিওরেমহিসেবেও ব্যাপক পরিচিত। তার এই বিখ্যাত তত্ত্বের মাধ্যমে কোয়াস দেখিয়েছেন যে সমাজের অনেক কল্যাণকর কাজ অধরাই থেকে যায় কেবল লেনদেনের উচ্চব্যয়ের কারণে। অথচ মূলধারার অর্থনীতিবিদ যারানয়া ক্ল্যাসিক্যাল অর্থনীতিবিদহিসেবে পরিচিত, তাদের তত্ত্বগুলো ধরে নিয়েছে যেলেনদেন ব্যয়শূন্য বা খুবই নগণ্য। কোয়াস দেখিয়েছেন যে এই অনুমিত শর্ত একেবারেই বাস্তবতা বিবর্জিত।


কোয়াসের তত্ত্বকে একটি সহজ উদাহরণের মাধ্যমে উপস্থাপন করা যায়। আমাদের দেশের ইটভাটাগুলো অনেকটা ফসলি জমির ধারেকাছেই হয়। ধরা যাক, একটি এলাকায় কৃষক ধান চাষ করেন। হঠাৎ একদিন দেখা গেল সেখানে একটি ইটভাটা কাজ শুরু করল। ইটভাটা থেকে যে ধোঁয়া নিঃসরণ হয়, তা ধান উৎপাদন বাধাগ্রস্ত করে এবং প্রতি একরে ধান উৎপাদন হ্রাস পায়। কোয়াসের প্রশ্ন ছিল, সমস্যার সমাধান কী? গতানুগতিক সমাধান হলো, ইটভাটার মালিকের ওপর কর আরোপ করা অথবা ইটভাটা থেকে ধোঁয়া নিঃসরণের ফলে যে পরিমাণ ফসলের ক্ষতি হবে, ইটভাটার মালিক সেই পরিমাণ ক্ষতিপূরণ কৃষকদের দিয়ে দেবেন। ধরা যাক, ইটভাটার কার্যক্রমের মাধ্যমে মোট ১০০ টাকা মুনাফা হয়। আর ফসলের ক্ষতির পরিমাণ ৭০ টাকা। অবস্থায় ইটভাটার মালিক কৃষকদের ৭০ টাকা ক্ষতিপূরণ দিলেও তার নিট মুনাফা থাকবে ৩০ টাকা। আর যদি ফসলের ক্ষতি ১০০ টাকার বেশি হয় (ধরুন ১২০ টাকা), ইটভাটার মালিক তার কার্যক্রম বন্ধ করে দেবেন, কারণ ইটভাটা থেকে অর্জিত মুনাফা (১০০ টাকা) দিয়ে ফসলের ক্ষতিপূরণ দেয়া সম্ভব নয়। উভয় ক্ষেত্রেই সমাজের কল্যাণ অপরিবর্তিত থাকে।

কোয়াসের মতে, এই সহজ সমাধানগুলো বাস্তবে কাজ করবে না, যদিলেনদেনে ব্যয়অনেক বেশি হয়। প্রথমত, ইটভাটার ধোঁয়া নিঃসরণে অনেক কৃষকের ফসল নষ্ট হবে। তাদের সবাইকে খুঁজে বের করতে হবে এবং কী পরিমাণ ফসলের ক্ষতি হবে, সেটা নিরূপণ করতে হবে। অতঃপর, কৃষকদের সঙ্গে দর কষাকষি করে একটা চুক্তি সম্পন্ন করতে হবে। আবার কোনো পক্ষ যদি চুক্তি অমান্য করে, তার সমাধানের পথ বাতলে দিতে হবে। আর এসব কাজ (সবাইকে একত্র করা, ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ, দর কষাকষি করা, চুক্তি প্রণয়ন এবং চুক্তি থেকে বিচ্যুত হলে আইনের মাধ্যমে তার সমাধান) ব্যয়বহুল। ধরা যাক, এসবের মোট ব্যয় ৪০ টাকা। অবস্থায় ইটভাটার মালিককে কাজ বন্ধ করে দিতে হবে, কারণ তার নিট মুনাফা (১০০ টাকা) মোট ব্যয়ের (ক্ষতিপূরণ ৭০ + লেনদেন ব্যয় ৪০ = ১১০ টাকার) চেয়ে কম। এখানে এটাই প্রতীয়মান যে লেনদেনের ব্যয় অনেক লাভজনক প্রকল্পকে লোকসানে পর্যবসিত করতে পারে।

গুরুর এই তত্ত্বকে উইলিয়ামসন অর্থনীতির বিভিন্ন পরিমণ্ডলে প্রয়োগের মাধ্যমে তার ব্যাপকতর ব্যবহার দেখিয়েছেন। মূলত তিনি একটা কঠিন প্রশ্নকে সহজ সাবলীলভাবে উপস্থাপন করেছেন, যেমন কোনো একটা প্রতিষ্ঠানের আয়তন (ধরুন টয়োটা) কেন রকম? অন্য কথায়, কেন টয়োটার আয়তন আরেকটু বড় নয় বা ছোট নয়? অথবা টয়োটার গাড়িতে যে স্টিল ব্যবহার হয়, সেটা টয়োটা নিজে তৈরি করে (খনি থেকে আকরিক লৌহ উৎপাদনের মাধ্যমে), নাকি বাজার থেকে (অন্য কোনো স্বতন্ত্র সরবরাহকারীর কাছ থেকে) কেনে এবং কেন?

প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে উইলিয়ামসন বেরিয়ে এসেছেন অর্থনীতির প্রথাগত গণ্ডি থেকে। নয়া ক্ল্যাসিক্যাল অর্থনীতিবিদরা দেখিয়েছেন যেটয়োটা স্টিল নিজেরা তৈরি করবে নাকি কিনে আনবে’, সেটা সম্পূর্ণ নির্ভর করবে দাম ব্যবস্থার ওপর। অন্য কথায়, পণ্যেরদাম হলো একমাত্র নিয়ামক, যার দ্বারা প্রতিষ্ঠান সহজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সুতরাং বাজারে প্রতিযোগিতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেদাম’-কে ঠিক করে দিলেদাম সম্পদকে দক্ষতার সঙ্গে অর্থনীতির বিভিন্ন সেক্টরে বণ্টন করে দিতে পারবে। আর বাজারের পূর্ণ প্রতিযোগিতা অর্জনে তার যত অন্তরায় আছে, সেগুলো দূর করতে হবে। যেমন একচেটিয়া ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়অ্যান্টি-ট্রাস্টআইনের মাধ্যমে। উইলিয়ামসনঅ্যান্টি-ট্রাস্টবিভাগে তার প্রত্যক্ষ কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন যে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের জন্য নীতি সবসময় সুফল বয়ে আনে না। এর যুক্তি খণ্ডন করেছেন তিনি তার অন্য অধীক্ষক হারবার্ট সাইমনেরবাউন্ডেড ?্যাশনালিটি’ (মানুষের সীমাবদ্ধ যৌক্তিকতা) এবংঅপরচুনিজম’ (সুবিধাবাদ)-এর আলোকে।

যেমন ধরা যাক কয়লানির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী একটি প্রতিষ্ঠানের কথা। খনি থেকে আহরিত কয়লা পরিবহনের জন্য রেল পরিবহন প্রয়োজন। প্রশ্ন হচ্ছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, রেল পরিবহন কয়লা খনির মালিকানা কি একই হবে, নাকি ভিন্ন ভিন্ন? একই মালিকানার অধীনে তিন প্রতিষ্ঠানের আকার এত বড় হবে, যা একচেটিয়া কারবারের সুযোগ তৈরি করবে। কিন্তু যদি ভিন্ন ভিন্ন মালিকানায় হয়, তবে অন্য এক সমস্যার সৃষ্টি হবে। ধরা যাক মালিকানা ভিন্ন এবং কয়লা উৎপাদনকারীর সঙ্গে রেল কোম্পানির চুক্তিভিত্তিক কাজ শুরু হলো। চুক্তিটাই হচ্ছে প্রধান সমস্যা। ভবিষ্যতে এমন অনেক নিয়ামকের উদ্ভব হতে পারে, যা চুক্তিকে প্রভাবিত করবে, কিন্তু মানুষের সীমাবদ্ধ জ্ঞান এবং তথ্যের অপ্রতুলতার কারণে সব নিয়ামক চুক্তিপত্রে এখনই অন্তর্ভুক্ত করা অসম্ভব। সুতরাং এসব নিয়ামকের কীভাবে সমাধান হবে, তা হবে এক বড় উদ্বেগের বিষয়। ধরা যাক ভবিষ্যতে এমন এক পরিস্থিতির উদ্ভব হলো, যার জন্য কয়লা উৎপাদনকারী রেললাইন ব্যবহার করছে না, যার মানে পুরো রেললাইন বেকার হয়ে পড়বে। অথবা কয়লা উৎপাদনকারীসুবিধাবাদীআচরণে প্রবৃত্ত হয়ে রেললাইনকে জিম্মি করে সুবিধা নিতে চাইবে। অবস্থায় ভিন্ন মালিকানায় রেললাইন স্থাপনে কেউ রাজি হবে না। যদিও হয়, পরিবহন খরচ এত বেশি হবে যে কয়লা উৎপাদন লাভজনক হবে না। ফলে একটি লাভজনক কাজ থেকে অর্থনীতি বঞ্চিত হবে। অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য একই মালিকানা, যদিও তা অ্যান্টি-ট্রাস্টের পরিপন্থী, অথবাসম্পর্কযুক্ত চুক্তি’ (রিলেশনাল কন্ট্রাক্ট) সমর্থন করেছেন উইলিয়ামসন।

চুক্তির সমস্যা শুধু যেসম্পদের নির্দিষ্টতা (যেমন উল্লিখিত রেললাইন, যা শুধু নির্দিষ্ট খনি থেকে কয়লা পরিবহনের কাজে ব্যবহূত) ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ তা নয়। উইলিয়ামসনের মতে, চুক্তির পক্ষগুলো নিজেদের সুবিধাই বিবেচনা করবে এবং ভবিষ্যতে যদি কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, যা তাকে সুবিধা দেবে তা অবশ্যই সে গ্রহণ করবে। চুক্তির পক্ষগুলোর সুবিধাবাদী মনোভাব লেনদেনে ব্যয়কে বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে। আর তাই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক চুক্তির ওপর নির্ভর না করে একটা প্রতিষ্ঠানের আওতায় অনেকগুলো কাজ সম্পাদন করলে লেনদেনে ব্যয় পরিহার করা যায়। যেমন টয়োটা অটোমোবাইল তাদের গাড়ির জন্য টায়ার, স্টিল, লাইট ইত্যাদির জন্য আলাদা আলাদা চুক্তি না করে নিজেরা একটা কেন্দ্রীয় গভর্ন্যান্সের আওতায় কাজগুলো সম্পাদন করে।

আবার এই কেন্দ্রীয় গভর্ন্যান্সেরও একটা ব্যয় আছে। যেমন শ্রমিক-কর্মচারীদের তদারক করা, বিভিন্ন ডিভিশনে সম্পদের সুষ্ঠু বিন্যাস ইত্যাদি। প্রতিষ্ঠানের আওতা যত বাড়বে, তদারকি খরচও বাড়বে। যেমন প্রতিষ্ঠান বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্মীদের সুষ্ঠু তদারক করা কঠিন হবে। সুযোগ পেলেই কর্মীরা কাজে ফাঁকি দিতে চাইবে, এতে মাথাপিছু উৎপাদন কমবে। একদিকে বাজারভিত্তিক লেনদেনেলেনদেন ব্যয়’, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক উৎপাদনেতদারকি ব্যয় দুইয়ের সমতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে একটা প্রতিষ্ঠানের সীমারেখা। টয়োটা গাড়িরলাইটটয়োটা নিজেরা উৎপাদন করবে তখনই, যখন নিজস্ব উৎপাদনের তদারকি ব্যয় বাজার থেকে সরবরাহে লেনদেন ব্যয় থেকে কম হবে (উৎপাদন ব্যয় এখানে মুখ্য নয়) এভাবেই কোনো প্রতিষ্ঠান তার কাম্য আয়তনে পৌঁছবে।

গতানুগতিক অর্থনীতির তত্ত্বগুলো লেনদেন ব্যয়কে অনুপস্থিত বা অপ্রাসঙ্গিক ধরে বাজার অর্থনীতির সাম্য অবস্থা নির্ধারণ করেছেন। উইলিয়ামসন দেখিয়েছেন যে এসব মডেল বাস্তবতা বিবর্জিত। বস্তুত, অর্থনৈতিক বিশ্লেষণেরএককহওয়া উচিতলেনদেন ব্যয়’, ‘দামনয়। তার এই মতবাদের বাস্তব প্রয়োগই তার কাজের সার্থকতা। নোবেল পুরস্কার এই সার্থকতার মুকুটে একটি পালক মাত্র।

 

. মোহাম্মদ দুলাল মিয়া: সহযোগী অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান

অর্থনীতি ফিন্যান্স বিভাগ, নিজওয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ওমান

[email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন