২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৭.৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানির লক্ষ্য নির্ধারণ

সংকটকালে রফতানি বাড়াতে বাস্তবসম্মত ও কার্যকর কর্মপরিকল্পনা নেয়া জরুরি

দেশের বিদ্যমান উন্নয়ন শিল্পায়নদর্শন রফতানিমুখী। স্বভাবতই আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির অন্যতম বড় চালিকাশক্তি রফতানি খাত। বর্তমানে দেশের রফতানি খাতে সুদিন যাচ্ছে না। বৈশ্বিক বাধা অভ্যন্তরীণ সমস্যায় এখন রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব দৃশ্যমান। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, গত অর্থবছরের একই সময়ে হাজার ৭৭৫ কোটি লাখ ডলারের বিপরীতে চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মে পর্যন্ত বিশ্ববাজারে হাজার ৯৫ কোটি ৯১ লাখ ৪০ হাজার ডলারের পণ্য রফতানি করেছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ ১১ মাসের হিসাবে রফতানি কমেছে ১৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ। এমন এক নিষ্প্রভ দৃশ্যপটে আগামী অর্থবছর (২০২০-২১) বাংলাদেশ থেকে মোট ৩৭ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ( হাজার ৭৪৪ কোটি) ডলারের পণ্য রফতানির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এটি মোটেই অনর্জনযোগ্য লক্ষ্য নয়। কিন্তু তার জন্য চাই সংশ্লিষ্ট খাতের প্রকৃত চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করে বাস্তবসম্মত কর্মকৌশল গ্রহণ।

বরাবরই আমাদের রফতানি ঝুড়ি পোশাক শিল্পনির্ভর। মোট রফতানি আয়ের প্রায় ৮২ শতাংশই শিল্প থেকে আসে। করোনা মহামারীতে একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল করেছে পশ্চিমা ব্র্যান্ডগুলো। ফলে বিশেষত মার্চ এপ্রিলে পোশাক রফতানিতে নজিরবিহীন পতন ঘটেছে। এখন অবশ্য আবার ক্রয়াদেশ আসতে শুরু করেছে। বিশেষ করে কিছু কারখানা মাস্ক, গ্লাভস গাউন উৎপাদনের ক্রয়াদেশ পেয়েছে। সামনে এটা আরো কিছুটা বাড়তে পারে। কিন্তু তাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটবে না। রফতানির পরিমাণ বাড়াতে হলে অবশ্যই আমাদের পোশাক খাতে পণ্য বৈচিত্র্যকরণ নিশ্চিত করতে হবে। সত্য হলো, পোশাক রফতানিতে বিশ্বে আমাদের অবস্থান দ্বিতীয় হলেও আজও আমরা নিজস্ব কোনো ব্র্যান্ড দাঁড় করাতে পারিনি। ফলে পোশাকের মূল্য নির্ধারণে আমাদের ভূমিকা সীমিত হয়ে পড়েছে। বায়িং হাউজগুলো শ্রমিকের মজুরিসহ বিভিন্ন খরচ জেনে একটা মূল্য নির্ধারণ করে দেয় এবং আমরা তা মেনে নিতে বাধ্য হই। দেশের পোশাকের ব্র্যান্ডিং হলে মূল্য নির্ধারণের সমস্যা অনেকটা কমে যেত। তাই বিষয়টিতে অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া দরকার।

রফতানি খাতকে বৈচিত্র্যময় করতে হলে কয়েকটি পণ্য ঘিরে নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠতে হবে। সুনির্দিষ্টভাবে পোশাক শিল্পের ওপর অতিনির্ভরতা কমিয়ে আনতে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। আর রফতানির জন্য অপ্রচলিত পণ্য খুঁজে বের করার পাশাপাশি রফতানি গন্তব্যের নতুন নতুন দেশ অনুসন্ধান করার দিকটিতে অগ্রাধিকার দেয়া চাই। আশাব্যঞ্জক বিষয় হলো, সার্বিক রফতানিতে নেতিবাচক চিত্র সত্ত্বেও পাট পাটজাত পণ্যের রফতানি বেড়েছে। পাট শিল্পকে সর্বতো পৃষ্ঠপোষকতা জোগাতে হবে। সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএঅফসি) বাংলাদেশের রফতানি বৈচিত্র্যের সম্ভাবনার জায়গা থেকে চামড়া চামড়াজাত পণ্য, প্লাস্টিক পণ্য এবং প্রকৌশল পণ্যকে শনাক্ত করেছে। তিনটি খাত ঘিরে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিতে হবে। নতুন রফতানি গন্তব্য অন্বেষণে বাণিজ্যিক মিশনগুলো প্রায় সময় ব্যর্থ হয়েছে। উল্লিখিত খাতগুলোর বাজার সন্ধানে আমাদের মিশনকে উদ্যোগী হতে হবে। সর্বোপরি, সামগ্রিক নীতি কাঠামোয়ও সংহতি জরুরি। রফতানি বহুমুখীকরণকে একক বা বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে শিল্প নীতি, আমদানি নীতি, আর্থিক নীতি অন্যান্য নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কৌশল সাজাতে হবে। নীতি সহায়তা সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত রফতানি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা মোটেই অসম্ভব নয়।

তবে আমাদের রফতানি সক্ষমতার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের ওপর। নানা অব্যবস্থাপনায় দেশে সংক্রমণ ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে, মৃত্যুর মিছিলও দীর্ঘতর হচ্ছে। ফলে সামনে শিল্প উৎপাদন পুরোদমে চালিয়ে যাওয়া নিয়ে রয়েছে শঙ্কা। অন্যদিকে অনেক দেশই নভেল করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করে জোরকদমে পূর্ণমাত্রায় উৎপাদনে ফিরেছে। এর মধ্যে আমাদের রফতানি প্রতিযোগী দেশগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ভিয়েতনাম শুরুতেই করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছে। বিদেশফেরতদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করে, সবার সংস্পর্শ শনাক্ত করে নভেল করোনাভাইরাসকে কুপোকাত করেছে। ফলে দেশটিতে শিল্প উৎপাদন খুব একটা বাধাগ্রস্ত হয়নি। এর সুফল দেশটি এরই মধ্যে পেতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের রফতানি কমলেও দেশটির যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের বাজারে রফতানি বেড়ে চলছে। একই অবস্থা কেনিয়া কিংবা কম্বোডিয়ারও। দেশ দুটিতেও করোনা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ফলে তাদের রফতানি আয়ও বাড়ছে। বলতে গেলে, বর্তমানে সমপর্যায়ের প্রতিযোগী দেশগুলোও রফতানি প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় আমাদের চেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং রফতানি লক্ষ্য অর্জন করতে হলে আমাদের রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বকে সর্বাগ্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে। চলমান মহামারী নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে বাংলাদেশ পুরো বিশ্ব থেকে যেমন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে, তেমনি দ্রুত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারও সম্ভব হবে না। কাজেই করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকারের বলিষ্ঠ, দৃঢ় কৌশলী উদ্যোগ গ্রহণের বিকল্প নেই।  

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন