আলোকপাত

মহামারীর প্রেক্ষাপটে কেমন হবে কৃষি বিপণন ব্যবস্থাপনা

ড. মো. মোশাররফ উদ্দিন মোল্লা

কভিড-১৯ মহামারী বা নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে আজ বিশ্ববাণিজ্য হুমকির মুখে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার প্রাক্কলন অনুসারে, বছর বিশ্বের পণ্যবাণিজ্য ১৩ থেকে ৩২ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। পরিস্থিতির আশাব্যঞ্জক উন্নতি হলে ১৩ শতাংশ কমবে, তা না হলে ৩২ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে উত্তর আমেরিকা এশিয়ার রফতানি সবচেয়ে বেশি কমবে বলে ধারণা করছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মহাপরিচালক রবার্তো আজেভেদো মনে করেন, বর্তমান অবস্থা ১৯৩০-এর দশকের মহামারী ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের মতো নয়। তার মতে, বিশ্বজুড়ে ব্যাংকগুলোয় যে পুঁজি ঘাটতি আছে তা নয়। অর্থনীতিও মোটামুটি সন্তোষজনক জায়গায় আছে। কিন্তু এই মহামারী অর্থনীতির ইঞ্জিনে তেলের সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। পরিস্থিতিতে অর্থনীতির ইঞ্জিনে তেল সরবরাহ পুনরায় সচল করা গেলে বৈশ্বিক অর্থনীতি দ্রুত আগের জায়গায় ফিরে যাবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পূর্বাভাস অনুযায়ী, বাংলাদেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধি শতাংশ কমে যেতে পারে। বিশ্বে জ্বালানি তেলের চাহিদা মূল্য কমে যাওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে দলে দলে শ্রমিক কর্মহীন হয়ে দেশে ফেরত আসার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। প্রায় ২৯ হাজার শ্রমিক বিভিন্ন দেশ থেকে ফেরত আসার অপেক্ষায় আছেন।

করোনা পরিস্থিতিতে বর্তমান কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন ধারা অব্যাহত রাখতে এবং ভবিষ্যৎ ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব প্রদান করতে কৃষিবান্ধব সরকার কৃষি ব্যবস্থাপনা পুনর্বিন্যাসে তাত্ক্ষণিক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। ধরে নেয়া যাক, করোনাকালীন পরবর্তী সময়ে গৃহীত এসব কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের ফলে দেশের কৃষি উৎপাদন কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। তাই এবার যে বিষয়টি অধিক গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিতে হবে তা হলো, কৃষকের উৎপাদিত ফসলের কাঙ্ক্ষিত বিপণন। এখন পর্যন্ত দেশের কৃষিপণ্য বিপণন ব্যবস্থাটি দক্ষ হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা কৃষকসমাজে টেকসই উৎপাদন ধারাকে ব্যাহত করে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) উভয় সংস্থা মাঠ পর্যায়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদনে সফলতা দেখালেও বাংলাদেশ কৃষি বিপণন অধিদপ্তর (ডিএএম) উৎপাদিত কৃষিপণ্যের দক্ষ বিপণনে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারছে না। যদিও বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে কৃষি মন্ত্রণালয় কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির লক্ষ্যে কয়েকটি নতুন বিপণন কৌশল গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে চলতি বোরো সংগ্রহ মৌসুমে সরকার -যাবৎ সর্বোচ্চ ধান সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা আট লাখ টন নির্ধারণ করেছে। কভিড-১৯ সৃষ্ট বিশেষ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যগত সতর্কতা অবলম্বন করে দ্রুততার সঙ্গে জুনের মধ্যে ৬০ শতাংশ, জুলাইয়ের মধ্যে ৯০ শতাংশ এবং ১৫ আগস্টের মধ্যে ১০০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কাজ করছে। সরকার এবার ২৬ টাকা কেজি করে অর্থাৎ হাজার ৪০ টাকা মণ দরে লাখ টন ধান ক্রয় করবে। লটারির মাধ্যমে ইউনিয়নওয়ারী নির্বাচিত কৃষকদের তালিকা প্রস্তুত করে ধান সংগ্রহ করা হবে। বোরো মৌসুমে কৃষকের অ্যাপ-এর মাধ্যমে ধান সংগ্রহ কার্যক্রমে ২২টি উপজেলাকে প্রাথমিকভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। কৃষকের ধানের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিতে এবং করোনা সময়কালে দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে আট লাখ টন ধান, দশমিক লাখ টন আতপ চাল, ১০ লাখ টন সিদ্ধ চাল এবং ৭৫ হাজার টন গম ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কৃষকের ধান বিক্রয়ে যাতে সুবিধা হয়, এজন্য ইউনিয়ন পর্যায়ে হাজার ২৩২টি আর্দ্রতা মাপক যন্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে। কৃষকরা যাতে ধানের ন্যায্যমূল্য পান, সেজন্য এরই মধ্যে ধান-চাল সংগ্রহ শুরু হয়েছে। চলতি বোরো মৌসুমে ২২ দশমিক ২৫ টন খাদ্যশস্য সংগ্রহ করা হবে, যা গত বছরের তুলনায় দুই লাখ টন বেশি।

সরকার আম লিচুর সঠিক বাজারমূল্য নিশ্চিতকরণে স্থানীয় চাহিদা বৃদ্ধিসহ বিভাগীয় শহরে বিপণনের সহায়ক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সামরিক বেসামরিক অনেক প্রতিষ্ঠানও এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। দেশে এই প্রথম উন্মুক্ত কৃষিপণ্য প্লাটফর্ম ফুড ফর নেশন নামে একটি সরকারি সেবা পোর্টাল চালু হয়েছে। সরাসরি বাণিজ্যিক যোগাযোগের পাশাপাশি কৃষক, ব্যবসায়ী প্রাতিষ্ঠানিক ভোক্তা একই প্লাটফর্মে পণ্যের দাম মান যাচাই করে কৃষিজাতীয় সব ভোগ্যপণ্য ক্রয়-বিক্রয় করতে পারেবেন। আঞ্চলিক কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ বিপণনে সারা দেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যুব সমন্বয়কারীদের মাধ্যমে কৃষকদের পণ্যের সঠিক মূল্যপ্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ, ভোক্তার কাছে মানসম্মত পণ্য সঠিক মূল্যে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সহযোগিতায় দেশে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে সরকারি অর্থের বরাদ্দ ছাড়াই -কমার্স সাইট পাইকারিসেলডটকম চালু হয়েছে। প্রাথমিকভাবে দেশের যে যে জেলায় আম লিচু ভালো উৎপাদিত হয়, সেখানকার যুব উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্ত করে দেশব্যাপী বিপণনের জন্য অন্যান্য জেলার যুব উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে পাইলট ভিত্তিতে চলতি মৌসুমে আম লিচু -কমার্স প্লাটফর্মের মাধ্যমে বিপণন করা হবে। পরবর্তী পর্যায়ে অন্যান্য কৃষিজাত পণ্য প্লাটফর্মের প্রক্রিয়ার সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হবে।

পদক্ষেপগুলোর অধিকাংশই করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলার ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ। কৃষি মন্ত্রণালয় অবশ্য এরই মধ্যে কভিড-১৯ মোকাবেলায় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণে স্বল্প, মধ্যম দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা-২০২০-এর খসড়া তৈরি করেছে, যা প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। তার পরও কৃষি বিপণন ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কিছু সুপারিশ পেশ করা হলো। যেমন () প্রথমেই দেশে ভোগ্য কৃষিপণ্যের বার্ষিক মোট চাহিদা জোগান নিরূপণ করতে হবে; () চাহিদা জোগানের ওপর ভিত্তি করে প্রতিটি কৃষিপণ্যের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণসহ সম্ভাব্য ফার্মগেট (খামার পর্যায়ে) মূল্য ঘোষণা করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ধান গমের ন্যায় প্রতিটি কৃষিপণ্যের উৎপাদন ব্যয়কেও বিবেচনায় নিতে হবে; () একটি শক্তিশালী মূল্য কমিশন গঠনের মাধ্যমে উল্লিখিত কার্যক্রম বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে; () কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মাধ্যমে সম্প্রতি চালুকৃত কৃষকের বাজার-এর আদলে প্রতিটি জেলায় কৃষকের বাজার স্থাপন করা যেতে পারে। এসব বাজারসংলগ্ন একটি করে আধুনিক কৃষিপণ্য সংরক্ষণাগার স্থাপন করতে হবে; () দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব থাকবে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের এবং বৈদেশিক বাজারে রফতানি উপযোগী পণ্য বিপণনের ক্ষেত্রে কৃষকের সহায়তাকারী হিসেবে কাজ করবে হরটেক্স ফাউন্ডেশন; () সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে পচনশীল কৃষিপণ্য বিভাগীয় শহরে বিপণনের লক্ষ্যে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কাভার্ড ভ্যান তথা পরিবহন ব্যবস্থা চালুকরণ; () প্রচলিত মালবাহী বগির পরিবর্তে আন্তঃনগর প্রতিটি ট্রেনের সঙ্গে কমপক্ষে দুটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মালবাহী ওয়াগন সংযুক্ত করে শুধু পচনশীল কৃষিপণ্য পরিবহনের ব্যবস্থাকরণ; () শুধু পচনশীল কৃষিপণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে ট্রাক বা কাভার্ড ভ্যান পিকআপের সব সেতুর জন্য নির্ধারিত টুল হার অর্ধেক হ্রাসকরণ; () পরিবহন সেক্টরে বিশেষ করে পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধে আইনের কঠোর বাস্তবায়ন এবং শ্রমিক কল্যাণ তহবিল নামে প্রতিষ্ঠিত চাঁদাবাজি নিষিদ্ধকরণ; () মৌসুমি ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত ফল ফসলাদি স্থানীয়ভাবে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে সংরক্ষণ বিপণনের লক্ষ্যে নার্সভুক্ত প্রতিষ্ঠানের প্রযুক্তিগুলোর দ্রুত সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ; () বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে বিনিয়োগে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের উৎসাহ প্রদান এবং () সামরিক বাহিনী, বিজিবি, পুলিশসহ যেসব ক্ষেত্রে রেশনিং পদ্ধতি চালু আছে, সেখানে কৃষিপণ্য অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। তাছাড়া সরকারি হাসপাতাল, এতিমখানা, পুনর্বাসন কেন্দ্র জেলখানায় প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় শাকসবজি ফলমূল কৃষকের বাজার থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ক্রয়ের নির্দেশনা দেয়া যেতে পারে।

অন্যদিকে কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাবে বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতির চাকাও থমকে গেছে। বিশ্বব্যাপী কর্মসংস্থান সংকুচিত হওয়ার পাশাপাশি ব্যাপকভাবে বাংলাদেশী শ্রমিক ছাঁটাই হওয়ার কারণে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হবে। জানা গেছে এরই মধ্যে প্রায় ২৯ হাজার বাংলাদেশী দেশে ফেরত আসার জন্য অপেক্ষায় আছে। দেশী অনেক প্রতিষ্ঠানও তাদের কর্মী ছাঁটাই করবে, বিশেষ করে সর্ববৃহৎ খাত গার্মেন্ট থেকে এরই মধ্যে কর্মী ছাঁটাই শুরু হয়েছে। এসব কর্মহীন মানুষের অধিকাংশই গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হবে। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে এদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিই হবে বড় চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে কৃষিসংশ্লিষ্ট -খামার (নন-ফার্ম) কার্যক্রমে যাতে তারা নিয়োজিত হয়ে আয়-উপার্জনের ব্যবস্থা করতে পারে, তার উদ্যোগ নিতে হবে।

পরিশেষে বলা যায়, অধিকাংশ ভোগ্যপণ্য আমদানিনির্ভর বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষক পর্যায়ে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি এবং ভোক্তার কাছে দ্রুততম সময়ে কৃষিপণ্য পৌঁছানোর জন্য মধ্যস্বত্বভোগীদের সিন্ডিকেটমুক্ত দক্ষ বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তোলাও অপরিহার্য। আর এজন্য কৃষি সম্প্রসারণ কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কার্যকরী সমন্বয়ের বিষয়টি সবার আগে প্রাধান্য দিতে হবে। তবেই সরকারের পক্ষে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা সহজতর হবে।

 

. মো. মোশাররফ উদ্দিন মোল্লা: সদস্য পরিচালক

(কৃষি অর্থনীতি গ্রামীণ সমাজ বিজ্ঞান)

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন