শ্রদ্ধাঞ্জলি

আল্লাহ মালিক কাজেমী কেন্দ্রীয় ব্যাংকারের প্রতিকৃতি

মামুন রশীদ

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর চেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট উপদেষ্টা আল্লাহ মালিক কাজেমী গত শুক্রবার প্রথমে হূদরোগ পরে করোনা জটিলতায় মারা গেছেন। আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুন।

আল্লাহ মালিক কাজেমী ছিলেন আমার জীবনে অঞ্চলে দেখা সবচেয়ে মেধাবী কেন্দ্রীয় ব্যাংকার। নিরীক্ষা বা পোর্টফোলিও রিভিউর কাজে আমাকে ভারত, শ্রীলংকামালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, পাকিস্তানসহ অনেক দেশে যেতে হয়েছে, সেই দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গেও দেখা হয়েছে। আমি নিশ্চিত  বলতে পারি, এই ৩৫ বছরের পেশাজীবনে তার মতো মেধাবী লোক খুব কম দেখেছি। মেধাবী, কঠোর মনোবল কিন্তু শিশুর সারল্য। যখনই যেতাম তখনই দেখতাম বিলেতের ইকোনমিস্ট বা কঠিন কোনো বই সামনে নিয়ে বসে আছেন, কোনো অভ্যন্তরীণ রিপোর্ট খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন কিংবা কোনো বিষয়ে নির্বুদ্ধিতার জন্য কাউকে ফোনে ধমকাচ্ছেন। সবকিছুর গভীরে ঢুকে যেতে পারতেন অনায়াসে।

দেশে বিদেশী বিনিয়োগ আনায় তার সহযোগিতার অন্ত ছিল না। যুক্তিযুক্ত মনে হলে ফরেন এক্সচেঞ্জ ম্যানুয়াল বা নির্দিষ্ট গাইডলাইনের বাইরে গিয়েও কাউকে সহায়তা করতে পিছপা হতেন না। চট করে মনে আসছে লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট, একটেল, গ্রামীণফোনের প্রথম প্রজেক্ট হিসাব, সিংগটেলের সিটিসেলে বিনিয়োগ আর ব্র্যাকের প্রথম মাইক্রোক্রেডিট রিসিভেবল সিকিরিউটাইজেশনসহ অনেক অনেক প্রকল্পে বৃত্তের বাইরে গিয়ে তার বিশ্লেষণী ঋজুতা। যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন বিদেশী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত স্থানীয় কর্মকর্তাদের শেয়ার অপশন এবং স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের ট্রানজেকশন বিদেশে অপারেশন হাবে প্রসেস করার বিষয়ে, যদিও তিনি অনেকবার বলেছিলেন বাংলাদেশেও একটি ট্রানজেকশন প্রসেসিং হাব বা ব্যাকবোন ইনফ্রাস্ট্রাকচার গড়ে তোলা উচিত। অনেক সময় তিনি নিচ থেকে আসা নোট কেটে ফেলে নিজে নোট লিখে গভর্নর মহোদয়ের কাছে হেঁটে গিয়ে অনুমোদন নিয়ে আসতেন। উল্টো দিকে যুক্তিসম্মত না হলে তিনি হতেন পাহাড়সমান অটল। আমাদের অনেক বাঘা বিদেশী সিনিয়রও তার কাছে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে হার মেনেছেন আর বলেছেন, দিস জেন্টেলম্যান নউস হিস জব। অর্থাৎ এই ভদ্রলোক তার কাজটি বেশ বোঝেন। প্রায় সবাই জানতেন বাংলাদেশের একজন কাজেমী আছেন। বাংলাদেশে মনিটারি ইকোনমিস্ট বা ক্রস-বর্ডার ট্রানজেকশন রিস্ক অ্যানালিস্ট বলতে একজনই ছিলেনআল্লাহ মালিক কাজেমী।

প্রায়ই কথা হতো। কথা হয়েছিল দুই সপ্তাহ আগেও।

আগে থেকেই তিনি হার্টের রোগী। কিছুটা অনিয়মও করতেন। রোগের ব্যাপারে ছিলেন বেশ খামখেয়ালিপনাও। করোনা সম্পর্কে আমরা অতিসাবধান বলে হাস্যোচ্ছলে কটূক্তিও করেছিলেন। তার মতো মেধাবী লোকের দেশের বড় বেশি প্রয়োজন ছিল।

এখন যখন পেছনে তাকাই দেখি, তিনজন অগ্রজপ্রতিম আমার ব্যাংকিং পেশায় সাফল্যে বিরাট অবদান রেখেছেন। তাদের তিনজনই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তা   ছিলেনআল্লাহ মালিক কাজেমী, নজরুল হুদা জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী। হুদা সিদ্দিকী সাহেব ছিলেন অর্থনীতির ছাত্র। দুজনেই পরবর্তীতে অস্ট্রেলিয়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে অর্থনীতি জনপ্রশাসনে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন। কাজেমী সাহেব পদার্থবিদ্যার ছাত্র হলেও পরবর্তীতে যুক্তরাজ্য থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করেছেন। বিজ্ঞানের যুক্তি আর অর্থনীতির জ্ঞান মিলে তাকে পরিণত করেছিল এক অনন্য ব্যক্তিত্বে। সামষ্টিক অর্থনীতিতে সিদ্দিকী সাহেবের জ্ঞান ছিল সম্মানজনক। ব্যাংকিং খাতের সংস্কার এবং কোনো ক্রান্তিকালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা নির্ধারণে হুদা সাহেব ছিলেন অতুলনীয়। আমি ধীরে ধীরে তাদের চিন্তাশিষ্যে পরিণত হই। অন্য দুজন বকা দেননি, তবে কাজেমী সাহেবের কাছে অনেক অনেক বকাও খেয়েছি। একবার তো সোনালী ব্যাংকের অন্তর্মুখী রেমিট্যান্স ব্যবসা আমরা নিয়ে নেয়ায় আমাকে ডেকে নিয়ে বকা দিয়ে রুম থেকে বের করে দিয়েছিলেন। তবে আজ আমি নিশ্চিত বলতে পারি, আমার জন্য, হয়তোবা সামান্য ব্যতিক্রমী মেধার জন্য তার ছিল বেশ স্নেহ। তিনি প্রায়ই কেন জানি আমাকে পত্রপত্রিকায় বেশি এক্সপোজার না নিতে বলতেন।  

কাজেমী সাহেবের জগতের সব বিষয়ে ছিল নিজস্ব বক্তব্য। মেধা মননে ছিলেন অত্যন্ত যুক্তিশীল। দেশের ব্যক্তি খাতের বিকাশে তিনি ছিলেন অন্তঃপ্রাণ। আবার প্রযুক্তি খাতের বিকাশেও ছিলেন সদাতত্পর। জাপান টোব্যাকো কেন প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ না করে সিগারেট খাতে বিনিয়োগ করল, তাতেও ছিল তার অনেক দুঃখ। বাংলাদেশের সমুদ্রগামী জাহাজ শিল্পকেও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় ছিলেন অত্যন্ত উৎসাহী।

বিকাশমান অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের যে ধরনের হওয়া উচিত, তিনি ছিলেন তা-ই। বাংলাদেশে না জন্মালে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরো অনেক উপরে যেতে পারতেন তিনি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নসহ প্রায় সব নতুন বিষয়ে গভর্নরের জন্য প্রায় গ্যাটিসবার্গ অ্যাড্রেস রচনা করে ফেলতেন ব্যক্তিগত প্রচারবিমুখ এই মানুষ। নিজের উপকার কোনো সময় তার বিবেচ্য ছিল না। তার কাছে গেলে আমার নিজেকে নির্জ্ঞান মনে হতো। মনে পড়ে, তাকে আমার একটি বই উৎসর্গ করেছিলাম। ফোনে যদিও ভয়ে ভয়ে অনুমতি নিয়েছিলাম, তবুও বইটি নিজে না নিয়ে গিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। দুদিন পরেই ফোন পেলাম এক ইংরেজি পত্রিকায় আমার একটি লেখায় কিছুটা সীমাবদ্ধ চিন্তার প্রকাশ নিয়ে। তিনি যেমন বকা দিতেন, তর্ক করতেন, তেমনি স্বস্নেহে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহায়তা করতেন।

তার দুটি মেয়ে আর সম্ভবত একটি ছেলে। ছেলের উদ্যোক্তা হওয়ার উৎসাহে তিনি ভেতরে ভেতরে প্রীত ছিলেন। স্বাধীনচেতা ছোট মেয়েটির প্রতিও ছিল প্রচ্ছন্ন সমর্থন। আর বড় সন্তান তো প্রথম সন্তানই। তবে তাদের নিয়ে, পরিবার নিয়ে কথা বলা খুব অপছন্দ ছিল তার। সব চিন্তা ছিল দেশকে নিয়ে, জটিল নিয়মকানুন বা লাইসেন্সরাজের বিরুদ্ধে, কর্মসংস্থানমুখী বিনিয়োগের পক্ষে। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বা স্টার্টআপ নিয়েও তার ছিল অনেক চিন্তা। নতুন উদ্যোক্তাদের প্রতি তার ছিল অনেক পক্ষপাতিত্ব।

আরো কিছুদিন বেঁচে থাকলে কাজেমী সাহেব দেশের জন্য অনেক কিছু করতে পারতেন। তাই ৭২ বছরে তার মৃত্যু হলো সত্যিকারের অকালমৃত্যু। ওপারে ভালো থাকুন প্রিয়, অনেক প্রিয় আর শ্রদ্ধার কাজেমী স্যার। কোনো দিন দেশ যদি আরো এগিয়ে যায়, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় বা লেনদেন যদি আরো সহজ হয়, বাংলাদেশ যদি বিনিয়োগ গন্তব্য হিসেবে আরো শ্রদ্ধাজনক স্থান লাভ করে, আমরাও বারবার স্মরণ করব আপনাকে। ভবিষ্যতের সব নীতি সংস্কারকের পথপ্রদর্শক হয়ে থাকবেন আপনি। থাকবেন একজন সত্যিকারের কেন্দ্রীয় ব্যাংকারের প্রতিকৃতি হয়ে।

 

মামুন রশীদ: ব্যাংকার অর্থনীতি বিশ্লেষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন