প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে ব্যাংকের অসহযোগিতার অভিযোগ

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি বাড়াতে হবে

করোনা সংকটে সৃষ্ট অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটাতে এবং দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা হিসেবে সরকার ১৯টি ভিন্ন ভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় লাখ কোটি টাকারও বেশি বরাদ্দ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এটি আমাদের জিডিপির প্রায় দশমিক শতাংশ। নিঃসন্দেহে এটি সময়োপযোগী উদ্যোগ। বিশেষজ্ঞরা ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বিশেষ অবদান রাখবে বলে আশা করছেন। প্যাকেজের অধীনে দেয়া ঋণের ক্ষেত্রে সরকার শতাংশ এবং ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান শতাংশ সুদ পরিশোধের কথা। সুদহার লক্ষণীয় কম হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে আলোচ্য প্যাকেজের সুবিধা নিতে ব্যবসায়ী তথা ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিপুল আগ্রহ তৈরি হয়েছে। কিন্তু এর বাস্তবায়ন একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের কৌশল গ্রহণ করছে। তবে এটি এমন এক সময়ে করা হচ্ছে, যখন দেশের ব্যাংক খাত বহু বছরের উচ্চ অনুৎপাদনশীল ঋণ, খেলাপি ঋণ প্রচণ্ড তারল্য সংকটে ঘুরপাক খাচ্ছে। আবার গত এপ্রিল থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সুদ শতাংশ বেঁধে দেয়ায় ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহক ঋণের সুদ থেকে আয় হারিয়েছে ২০ শতাংশ থেকে ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত। এছাড়া আমানতে সুদহার কমে যাওয়া এবং করোনাকালে মানুষ সাংসারিক ব্যয় নির্বাহের জন্য সঞ্চয় ভাঙার কারণে ব্যাংকগুলো আমানত খরায় ভুগছে। সব মিলিয়ে ব্যাংকিং খাতে প্রলম্বিত ব্যাপকতর হচ্ছে তারল্য ঘাটতি। ফলে সরকার চাইলেও ব্যাংকগুলো প্যাকেজ বাস্তবায়নে খুব একটা আগ্রহ প্রকাশ করছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্য ব্যাংকিং খাতের তারল্য বৃদ্ধিতে সঞ্চিতি প্রবিধান শিথিল, রেপো রেট কমানোসহ বিভিন্ন নীতি-পদক্ষেপ নিয়েছে। তাছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় এই অর্থ ব্যাংকগুলোকে দিয়ে দেবে। ব্যাংকগুলোর দায়িত্ব কেবল ক্ষতিগ্রস্ত তালিকাভুক্ত গ্রাহক-উদ্যোক্তাদের পালাক্রমে ঋণ পৌঁছে দেয়া। যার মানে হলো, সব গ্রাহকের ঋণের ঝুঁকি ব্যাংকিং খাতকেই বহন করতে হবে। ব্যাংকগুলোর অনাগ্রহের কারণ মূলত এখানেই নিহিত। ক্ষতিগ্রস্ত যেসব ব্যবসায়ী তথা উদ্যোক্তার সঙ্গে ব্যাংকের সম্পর্ক ভালো, নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করে এসেছেন, তাদের প্রতি ব্যাংকগুলোর মনোভাব ইতিবাচক। সেদিক থেকে তাদের জন্য প্যাকেজভুক্ত ঋণ সুবিধা পেতে সমস্যা হচ্ছে না, হবে না। কিন্তু সমস্যা হলো কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট মাঝারি শিল্পের (সিএমএসএই) প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণপ্রাপ্তি নিয়ে। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর তহবিল খরচ প্রায় শতাংশ। পরিচালনা খরচ প্রশাসনিক ব্যয় আরো শতাংশ। কাজেই ছোট ছোট ঋণ দিয়ে ব্যাংকগুলো খরচ পোষাতে পারবে না বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা। আবার ধরনের ঋণের একটি অংশ প্রত্যন্ত অঞ্চলে দিতে হয়। তাতে খরচ আরো বেশি পড়ে। ফলে কুটির শিল্পের গ্রাহকরা আগ্রহ দেখালেও তেমন সাড়া দিচ্ছে না ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে ক্ষুদ্র মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণপ্রাপ্তি বর্তমানে অনেক বেশি দুষ্কর হয়ে উঠছে। অবস্থায় প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী, বিশেষত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের পাশে না দাঁড়ানো ব্যাংকগুলো থেকে সরকারি আমানত প্রত্যাহারের প্রস্তাব দিয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) প্রস্তাবটি বাস্তবায়ন হলেই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানে ঋণ জোগান বাড়বে তেমনটি নয়। ব্যাংক খাতের বাস্তবিক সক্ষমতা যাচাইপূর্বক প্রয়োজনীয় সহযোগিতা অব্যাহত রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি বাড়াতে হবে, যাতে  এসএমই খাত ঋণ বঞ্চিত না হয়। করোনা সংকটে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এসএমই খাত। বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে খাতে। আবার ছোট ছোট উদ্যোগ হওয়ায় এগুলো ঘুরে দাঁড়ানোও সহজ। এতে সুফল দ্বিবিধ। এক. অর্থনীতির দ্রুত উত্তরণ ঘটে এবং দুই. কর্মসংস্থান বাড়ে। কাজেই এসএমই খাতে মুহূর্তে ঋণপ্রাপ্তি নিশ্চিত করাটা অত্যন্ত জরুরি। বিষয়টি আমলে নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরো সক্রিয় ভূমিকা কাম্য।

ঘোষিত প্রণোদনার অধীনে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি মূলত বাণিজ্যিক। ঋণ ফেরত আসবে তো ঠিক সময়ে। খেলাপি ঋণের দীর্ঘ সংস্কৃতির বাস্তবতায় শঙ্কা মোটেই অমূলক নয়। স্বভাবতই খেলাপিরাও সুযোগে পুনরায় ঋণ নিতে চাইবে। তারা যাতে তা করতে না পারে সেজন্য প্রতিটি ধাপে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি বাড়াতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ব্যাংকগুলোর ঋণঝুঁকি  হ্রাসের একটি সহায়ক নীতি হাতিয়ার হতে পারে ঋণ নিশ্চয়তা কর্মসূচি বা ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম (সিজিএস); যা কোনো তৃতীয় পক্ষ দ্বারা ঋণদাতাদের ঋণ ঝুঁকি প্রশমন করে। কোনো গ্রাহক ঋণখেলাপি হয়ে পড়লে ঋণদাতার ক্ষতির একটি অংশ নির্ধারিত ফির বিপরীতে পুষিয়ে দেয়া হয়। দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বব্যাংকসহ উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো বাংলাদেশে সিজিএস প্রবর্তনের কথা বলে আসছে। ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়াতে সম্প্রতি সিজিএস চালুর উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। -সংক্রান্ত প্রাথমিক রূপরেখা এরই মধ্যে চূড়ান্ত করা হয়েছে। শিগগিরই এটি বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। সিজিএস সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন হলে এটি ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলোর ঋণপ্রাপ্তি এবং প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন অনেকটাই সহজ করবে।

প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের পথে আরেকটি বড় বাধা ব্যাংক ব্যবস্থার প্রতি সরকারের অতিনির্ভরতাশীলতা। সরকার অব্যাহতভাবে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে যাচ্ছে। এতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরেও ব্যাংক থেকে প্রায় ৮৫ হাজার কোটি ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এটি ব্যাংকের তারল্যে আরো চাপ সৃষ্টি করবে। প্রকারান্তরে চাপ প্যাকেজ বাস্তবায়ন আরো কঠিন করে তুলবে। তাই রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। সরকারকে চেষ্টা করতে হবে বৈদেশিক উৎস থেকে কীভাবে অধিক অনুদান কিংবা সহজ শর্তে ঋণ নিশ্চিত করা যায়, যাতে ব্যাংকের ওপর চাপ কমে আসে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন