বিধ্বস্ত সেবা খাতে ব্যাংকের বিনিয়োগ ৬০ হাজার কোটি টাকা

হাছান আদনান

হবিগঞ্জের বাহুবলে দ্য প্যালেস লাক্সারি রিসোর্ট। পাহাড়ের সবুজ উদ্যানে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে রিসোর্ট গড়ে তুলেছেন উদ্যোক্তা আরিফুর রহমান। স্বাভাবিক সময়ে বিদেশী অতিথি, পর্যটক বড় করপোরেটদের আয়োজনে মুখর থাকত দ্য প্যালেস। কিন্তু দেশে করোনার আঘাতের শুরু থেকে রিসোর্টটিতে নেমে এসেছে সুনসান নীরবতা।

রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের বড় বিনিয়োগ আছে দ্য প্যালেসে। পাঁচ তারকা মানের রিসোর্টের বর্তমান পরিস্থিতি কী জানতে চাইলে উদ্যোক্তা আরিফুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, মার্চ থেকেই দ্য প্যালেস পুরোপুরি বন্ধ। রিসোর্টে কর্মরত ছিলেন ৩৭৯ জন কর্মী, যাদের বড় অংশই এখন ছুটিতে। তার পরও ১২০ জন কর্মী দিয়ে দ্য প্যালেসের রক্ষণাবেক্ষণ করতে হচ্ছে। শুরু থেকেই দ্য প্যালেসের কর্মীদের থাকা-খাওয়া ফ্রি ছিল। জানি না ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত রিসোর্ট চালু করা সম্ভব নয়।

দ্য প্যালেসের মতোই সুনসান নীরবতা চলছে রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেললা মেরিডিয়ানে বিমানবন্দরের পাশে গড়ে তোলা হোটেলের অতিথিদের ৯৫ শতাংশই ছিলেন বিদেশী। উড়োজাহাজ ওড়া বন্ধ হওয়ার পর থেকে বন্ধ রয়েছে হোটেলটিও। হোটেলের কর্মীদের বড় অংশকে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। চাকরিচ্যুত করা হয়েছে এমন কর্মীদের সংখ্যাও শতাধিক।

লা মেরিডিয়ানের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে হোটেলটির চেয়ারম্যান আমিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, লা মেরিডিয়ান করা হয়েছে আন্তর্জাতিক অতিথিদের জন্য। ইউরোপ-আমেরিকায় করোনা ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই বিদেশীদের আগমন কমেছে। এরপর দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ। ফলে স্বাভাবিকভাবেই লা মেরিডিয়ানও বন্ধ রয়েছে। এক হাজার অতিথি না হলে হোটেলটি পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তবে আমি সবসময়ই আশাবাদী মানুষ। শিগগিরই দেশে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে এবং অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে বলে আমার বিশ্বাস।

লা মেরিডিয়ানের মতো পরিস্থিতি প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও, র্যাডিসন ব্লু ওয়াটার গার্ডেন, ইন্টারকন্টিনেন্টাল, দ্য ওয়েস্টিনসহ অন্যসব বিলাসবহুল হোটেলেরও। অতিথিশূন্য হোটেলগুলোতে দেশী গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে নানা ছাড় দেয়া হচ্ছে। দুই রাত থাকলে এক রাত ফ্রি এমন প্রস্তাবও দিচ্ছে ইন্টারকন্টিনেন্টালের মতো অভিজাত হোটেল। বন্ধ রয়েছে সমুদ্রসৈকতের শহর কক্সবাজারের নামিদামি সব হোটেলও।

দেশের হোটেল, মোটেল, রিসোর্টসহ সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যাংকের বিনিয়োগ আছে হাজার হাজার কোটি টাকা। হোটেলসহ সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকলে ব্যাংকঋণের কী হবে নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন উদ্যোক্তা ব্যাংকাররা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশের সেবা খাতে ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত বিনিয়োগ প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। সেবা খাত বলতে হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট, হাসপাতাল, ক্লিনিক, এভিয়েশন, ট্রাভেল এজেন্সি, ট্যুরিজমের অন্যসব প্রতিষ্ঠান স্পোর্টস-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিবেচনা করে ব্যাংকগুলো। খাতগুলোতে বিতরণকৃত ঋণকে সেবা খাতের ঋণ উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিপোর্ট করা হয়।

ব্যাংকাররা বলছেন, করোনা তাণ্ডবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোর শীর্ষে আছে সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরতে শুরু করায় দেশের তৈরি পোশাক খাত ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পরও সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে। সব ক্ষতির দায় শেষ পর্যন্ত ব্যাংকের ওপর আসবে।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বিষয়ে বলেন, যেকোনো মহাদুর্যোগে সবার আগে সেবা খাত ভেঙে পড়ে। আবার ঘুরে দাঁড়ায়ও সবার শেষে। মনে প্রশান্তি আর হাতে টাকা না থাকলে কেউ ঘুরতে যাবে না। সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সরকারের নীতি রাজস্ব সহায়তা লাগবে। সারা পৃথিবীতে সরকার এটিই করছে। দেশের সব খাতের বিপর্যয় ব্যাংকের কাঁধে তুলে দিলে ব্যাংকও ডুবে যাবে।

দেশের শীর্ষস্থানীয় পাঁচ তারকা হোটেল ধরা হয় রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টালকে। একসময় বিশ্বখ্যাত শেরাটন ব্র্যান্ড হোটেলটি পরিচালনা করত। তারা দেশ ছাড়ার পর বিপুল সংস্কার চালানো হয় হোটেলটির অবকাঠামোয়। এজন্য ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত হোটেলটি পুরোপুরি বন্ধও ছিল। হোটেলটিতে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের ঋণ আছে প্রায় ৫৫০ কোটি টাকা। পুরোপুরি জমে ওঠার আগেই করোনার ধাক্কায় বিধ্বস্ত হয়েছে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল। সীমিত পরিসরে হোটেলটি চালু থাকলেও অতিথিশূন্যতায় ভুগছে। এজন্য রুমপ্রতি হোটেলটি ১১ হাজার টাকায় ভাড়ার প্রস্তাব করে নিয়মিত গ্রাহকদের মুঠোফোনে বার্তা পাঠাচ্ছে। দুই রাত থাকলে এক রাত ফ্রি অফারও দিচ্ছে অভিজাতদের হোটেলটি।

অতিথিশূন্যতায় আছে আরেক অভিজাত হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও। মাত্র হাজার ৯৯৯ টাকায় দুই বেলার খাবারসহ ২৪ ঘণ্টার জন্য রুম ভাড়ার প্রস্তাব দিয়ে নিয়মিত গ্রাহকদের মুঠোফোনে বার্তা পাঠাচ্ছে হোটেলটি। যদিও স্বাভাবিক সময়ে রুম ভাড়া খাবারের জন্য ২০ হাজার টাকার বেশি গুনতে হতো গ্রাহকদের।

অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শামস-উল-ইসলাম জানান, ইন্টারকন্টিনেন্টালের ঋণ নিয়ে তেমন কোনো ঝুঁকি নেই। তার পরও অতিথি না পেলে হোটেলটি ব্যাংকের ঋণ শোধ কোথা থেকে করবে চিন্তা তো আছেই। করোনার কারণে দেশের সেবা খাতের প্রায় সব ঋণই ঝুঁকিতে আছে। তবে চীনের প্রতি উন্নত বিশ্বের নেতিবাচক মনোভাব, চীন-ভারত যুদ্ধের দামামার সুফল আমরা কিছুটা হলেও পাব। আশা করছি, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে অর্থনীতি পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে খুব বেশি সময় নেবে না।

করোনায় প্রায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে সমুদ্রসৈকতের শহর কক্সবাজারের শত শত হোটেল, মোটেল অভিজাত সব রেস্তোরাঁ। সংক্রমণের হার বেশি হওয়ায় এখনো জেলাটিতে লকডাউন চলছে। কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, তারও কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। পরিস্থিতি নিয়ে পুরোপুরি হতাশ শহরটির পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত সব শ্রেণীর উদ্যোক্তারা।

ঢাকার বাইরে সবচেয়ে বেশি পাঁচ তারকা হোটেল আছে কক্সবাজার শহরে। সৈকতের পাশে হোটেল সি-গাল প্রথম সারির পাঁচ তারকা হোটেলগুলোর একটি। মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকেই পুরোপুরি বন্ধ আছে হোটেলটির কার্যক্রম। বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে হোটেল সি গালের শীর্ষ নির্বাহী শেখ ইমরুল ইসলাম সিদ্দিকী (রুমি) বণিক বার্তাকে বলেন, সরকারি নির্দেশে কক্সবাজারের সব হোটেল-মোটেল বন্ধ আছে। কবে থেকে হোটেল খোলা যাবে, প্রশ্ন করে সরকারি কোনো কর্মকর্তার মুখ থেকে উত্তর পাওয়া যায়নি।

কক্সবাজারের শুধু হোটেলগুলোতে ৪০ হাজারের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিলেন। বর্তমানে তার ১০ ভাগের এক ভাগও নেই। সবাই বেকার হয়ে গেছে। হোটেলগুলোতে গণছাঁটাই চলছে। ব্যাংকঋণেই কক্সবাজারের হোটেলগুলো গড়ে উঠেছে। এখন ব্যাংকঋণের কী হবে, সেটিও ভাবতে হচ্ছে।

কক্সবাজারের মতোই পুরোপুরি বন্ধ দেশের অন্যসব পর্যটন এলাকার হোটেল, মোটেলও। সারা দেশের বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ক্লিনিকগুলো সীমিত পরিসরে চালু থাকলেও বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেই আগের মতো রোগীদের ভিড় নেই। করোনার কারণে অসুস্থ মানুষ হাসপাতাল-ক্লিনিকে যেতেই ভয় পাচ্ছে। এতে চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসায়ও ধস নেমেছে। উড়োজাহাজ উড্ডয়ন প্রায় বন্ধ থাকায় ধস নেমেছে ট্রাভেল এজেন্সি, ট্যুর এজেন্সিগুলোর আয়েও। ফলে করোনায় সেবা খাতের সব প্রতিষ্ঠানেরই ব্যবসায় বড় বিপর্যয় হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিদেশীরা দেশের প্রকৃতি দেখতে আসে না বলে মন্তব্য করেন এনসিসি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ব্যবসায়িক কাজেই বিদেশীরা বাংলাদেশে আসে। ব্যবসা-বাণিজ্য পুরোদমে চালু না হলে বিদেশীরা আসবে না। বিদেশীরা না এলে দেশের পাঁচ তারকা হোটেলগুলোয় স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরবে না। এভিয়েশনসহ সেবা খাতের কর্মীদের বেতন-ভাতাও বেশি। সারা পৃথিবীতে খাতে কর্মী ছাঁটাই বেতন কর্তন চলছে। আমাদের দেশে কর্মী ছাঁটাইকে অমানবিক দৃষ্টিতে দেখা হয়। কারণ বেকারদের জন্য দেশে রাষ্ট্রীয় কোনো সুরক্ষা নেই। দেশের প্রায় সব বড় হোটেল-রিসোর্ট ব্যাংকঋণে গড়ে উঠেছে। পরিস্থিতিতে সেবা খাতকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সুনির্দিষ্ট করে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনার প্রয়োজন হবে।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে হোটেল, রিসোর্টগুলোর ব্যাংকঋণের সুদকে ব্লক হিসেবে স্থানান্তরের দাবি জানান দ্য প্যালেসের চেয়ারম্যান আরিফুর রহমান। তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে ঢাকার হোটেল, রিসোর্টগুলোতে অতিথিরা যাবেন। কিন্তু ঢাকার বাইরে খুব বেশি মানুষ যেতে চাইবে না। এজন্য ব্যাংকঋণের অন্তত দুই বছরের সুদ ব্লক হিসেবে স্থানান্তর করা দরকার। উদ্যোক্তা হিসেবে আমরা মূল ঋণ পরিশোধ করতে থাকব। ব্যবসা পুরোপুরি শুরু হলে সুদসহ পরিশোধ করা যাবে। কিন্তু ঋণের সঙ্গে সুদ যুক্ত হতে থাকলে উদ্যোক্তাদের পথে বসতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাংক উদ্যোক্তা, উভয় শ্রেণীকেই সহযোগিতার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

তবে ঋণের সুদ ব্লক হিসেবে স্থানান্তরের সুযোগ নেই বলে মনে করেন সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বলেন, ঋণের সুদ ব্লক হিসেবে স্থানান্তর করলে ব্যাংক আমানতকারীদের সুদ দেবে কোথা থেকে? টাকা পরিশোধ না করলেও বছর গ্রাহকদের খেলাপি করা যাবে না। আগামী বছরও পরিস্থিতি চলতে থাকবে। কিন্তু তারপর কী হবে? সেটিও ভাবতে হবে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা এখনো রেড জোন আর গ্রিন জোনই ঠিক করতে পারছে না। সেখানে অর্থনীতি কবে ঘুরে দাঁড়াবে, তার ভবিষ্যদ্বাণী করা অর্থহীন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন