উন্নয়নের ভিন্ন পথ

ধনাঢ্যরা দেশ ছেড়ে গেলে বাংলাদেশ কি শুধু গরিবদের জন্যই থাকবে?

ড. আর এম দেবনাথ

বাজেট, উন্নয়ন প্রকল্প, লুটপাট, অর্থ পাচার, ব্যাংক ইত্যাদির ওপর আলোচনা করতে বসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটা ভাষণের কথা মনে পড়ল। দৈনিক বণিক বার্তায় গত বছরের অক্টোবরে খবরটি প্রকাশিত হয়। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উদ্বোধনকালে তিনি বলেন, ‘আমরা চলতি বাজেটে লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছি। দুর্নীতিবাজ উইপোকারা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকালে অর্থ লুটে নিচ্ছে। দেশের উন্নয়নের জন্য জনগণের কষ্টার্জিত প্রতিটি পয়সার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতের জন্য আমাদের ওইসব উইপোকাকে আটক করতে হবে।প্রধানমন্ত্রীর কঠোর হুঁশিয়ারি দেয়ার এক মাস আগে নবনিযুক্ত অর্থমন্ত্রী মুস্তাফা কামাল সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের এক সভায় বলেন, ‘সন্তান-সন্ততি বিদেশে বসবাস করছে এমন পরিবারকে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে।তিনি আরো বলেন, ‘মানি লন্ডারিং সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। সরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ পাচার হচ্ছে কিনা, তা মন্ত্রণালয়কে জানাতে হবে। ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে জামানত ভালো করে পরীক্ষা করে দেখতে হবে। ধরনের অনেক সতর্কতা তিনি দেন ওই সভায়। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন উন্নয়নের টাকা লুটের কথা। আর অর্থমন্ত্রী বলছেন ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাচারের কথা, জামানতের কথা। এবারের বাজেট দেয়ার পর তিনি বলছেন, ‘যারা দেশে টাকা খরচ করতে চায় না, তারা বিদেশে চলে যাক।মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অর্থমন্ত্র্রীর এসব বক্তব্য থেকে একটা বিষয় পরিষ্কারটাকা লুটপাট হচ্ছে, ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকাররা সতর্ক নন এবং টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। এমনিতে এসব মানুষের মুখে মুখে চালু কথা। কিন্তু চালু কথা যখন দেশের এক নম্বর নির্বাহী অর্থমন্ত্রীর মুখ থেকে শোনা যায়, তখন বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। গুরুত্বপূর্ণ বোঝা যায় আরেকটি কারণে। দেখা যাচ্ছে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে অর্থমন্ত্রী টাকা পাচারের প্রধান মাধ্যমআন্ডার ইনভয়েসিংওভার ইনভয়েসিং’-এর ওপরে একটা বড় পদক্ষেপ নিয়েছেন। আন্ডার ইনভয়েসিং ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে পাচারকৃত টাকার ওপর ৫০ শতাংশ কর বসানো হয়েছে। এইটুকু বুঝলাম। কিন্তু যে টাকা পাচার হয়েছে, তার কী হবে তা বোঝা গেল না। তবে অর্থমন্ত্রী মাধ্যমটিকে জোরেশোরে ধরেছেন, এটি একটি ভালো সংবাদ। এতদিন আমরা শুধু শুনেছি হুন্ডির কথা। গত ৪০-৫০ বছর ধরে শুধুই বলা হচ্ছিল হুন্ডি দেশের শত্রু। হুন্ডিওয়ালারা শেষ করে ফেলছে। কিন্তু এতদিন পরে আমাদের হুঁশ ফিরেছে যে হুন্ডি একটি সহযোগী ব্যবস্থা। পাচারের প্রধান ব্যবস্থা আন্ডার ইনভয়েসিং ওভার ইনভয়েসিং। ১০০ টাকার আমদানি পণ্য ১৫০ টাকার ঋণপত্রের মাধ্যমে ৫০ টাকা পাচার করা যায়। এতে সুবিধা হচ্ছে কাজটা হচ্ছে প্রকাশ্যে ব্যাংকের মাধ্যমে। কোনো গোপন বিষয় নয়। সেই পাকিস্তান আমল থেকেই কাজ চলেছে। একশ্রেণীর ব্যবসায়ীদের ক্যাপিটাল বানানোর অন্যতম পন্থা হচ্ছে আন্ডার ইনভয়েসিং ওভার ইনভয়েসিং। এত বড় সত্য কথাটা কেউ এতদিন জোর দিয়ে বলল নাএই হচ্ছে দুঃখ। সব আক্রোশ গেল হুন্ডির ওপর দিয়ে। হুন্ডি দেশের শত্রু, কিন্তু টাকা পাচারের প্রধান মাধ্যম আর নয়। এবার বাজেটে দেখা যাচ্ছে অর্থমন্ত্রী এটাকে ধরেছেন ভালোভাবে। ফলাফল কী হবে তা এখনো অজানা। কারণ এখানে ব্যাংক জড়িত। এখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জড়িত, অডিট কোম্পানিগুলো জড়িত। সরকারের বাণিজ্যিক অডিট জড়িত। আমদানিকারক রফতানিকারক জড়িত। কে ধরবে এবং বলবে যে এটি আন্ডার ইনভয়েসিং বা ওভার ইনভয়েসিং। জড়িত আবার কাস্টমস বিভাগের লোকজন। চাল আমদানি খুব সহজ কথা। চালের দাম কেজিতে বাড়ল, ধরা যাক ৩০ টাকা। কিন্তু এর আমদানি মূল্য যে ৩০ টাকা কে বলবে? চাল তো এক প্রকারের নয়। ডজন ডজন ধরনের চাল আছে। একইভাবে সব পণ্যই বিভিন্ন ধরনের আছে। একেকটার মূল্য একেক রকমের। কতটুকুই-বা ব্যাংকাররা জানেন। খুব বেশি মূল্যায়িত হলে কখনো কখনো বোঝা যায়। আর যদি ব্যাংকাররা চান যে এই আমদানিএলসিরমাধ্যমে আমদানিকারক কিছু টাকা তৈরি করুক, তাহলে তো তা ধরার উপায় নেই। ধরতে পারেন অডিটররা, যারা বাজারের খবর রাখেন, তারা। কার ঠেকা পড়েছে এসব ধরেবিপদেপড়তে। এই যে সমস্যাগুলোর কথা বললাম, এগুলো বাস্তবে দেখা যায়। পথেই বহু নামিদামি ব্যবসায়ী-শিল্পপতিসহ উদীয়মান ব্যবসায়ীরা পর্যন্তক্যাপিটালকরেছেন। ব্যাংকাররা সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন। যে দেশেক্যাপিটালনেই, সেখানে এছাড়া উপায় কী?

মানুষকে ক্যাপিটাল তৈরিতে সাহায্য করা। বস্তুত পথে কারাক্যাপিটালতৈরি করেনি, তা রীতিমতো এক গবেষণার বিষয়। বলাই হয়ে থাকে, এভরি ফার্স্ট ডলার ইজ ডার্টি ডলার। তার অর্থ নতুন পুঁজি বা টাকা ভালো পথে অর্জিত হয় না। এর উৎস খুঁজতে গেলে মহাবিপদ।

আশার কথা, অর্থমন্ত্রী বিষয়টি ধরেছেন, তা বিলম্বে হলেও। রাগ করে বলেছেন, দেশে অর্থ খরচ যারা করে না (অর্থাৎ বিনিয়োগ করে না), তারা বিদেশে চলে যাক। বস্তুত সবাই তো যাচ্ছেই। এর অতি সাম্প্রতিকতম উদাহরণ পেয়েছি দুটো। প্রথমটিএক্সিম ব্যাংকেরঘটনা। সেখান থেকে বড় একজন গ্রাহক ঋণ নিতে চান। টাকা, টাকা নয়। ৫০০ কোটি টাকা। প্রচলিত নিয়মে যত টাকা ঋণ, তার দেড় গুণকোলেটারেলথাকতে হয়। বস্তুত ব্যাংক দেড় গুণ নয়, দ্বিগুণ সম্পত্তিরমর্টগেজচায়। এক্ষেত্রে দেখা গেল মর্টগেজের পরিমাণ দ্বিগুণ কেন, অর্ধেকও নয়। ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী ঋণ দিতে উৎসাহী নন। অতএব, করণীয় কী? প্রধান নির্বাহী তার সহকর্মীকে এক জায়গায় নিয়ে তাদের হত্যার হুমকি দেয়া হয়। ব্যাপারে গুলশান থানায় সে মাসের তারিখে মামলা হয়। আসামিরা পালিয়ে বিদেশে চলে যায়।

এর পরে খবরের কাগজে অনেক স্টোরি প্রকাশিত হয়। সেসবে দেখা যায়, সম্ভাব্য পলাতক ঋণগ্রহীতাদের বিদেশে নানা জায়গায় ব্যবসা-বাণিজ্য আছে, সহায়-সম্পদ আছে। দ্বিতীয় খবরটি জনৈক সংসদ সদস্যের। তাকে নিয়ে কুয়েতে এক বড় কেলেঙ্কারি ঘটে। একটি কাগজের খবরের শিরোনাম হচ্ছে: ‘অর্থ মানব পাচারের অভিযোগ: বহুমুখী অনুসন্ধানের জালে পাপলু।কুয়েত কর্তৃপক্ষ তাকে জেলে পাঠিয়েছে। বলা হচ্ছে, কুয়েতের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে দেশটির কয়েকজন সাবেক বর্তমান সংসদ সদস্যকে ঘুষ দেয়ার কথা স্বীকার করেছেন তিনি (পাপলু) এছাড়া ইউরোপ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে বিপুল অর্থ তিনি পাচার করেছেন। এর প্রমাণ পেয়েছেন কুয়েতের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। দুটো সংবাদ বেশ চাঞ্চল্যকর। দেখা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী কথিত উন্নয়ন প্রকল্পের লুটের টাকা, ব্যাংকের লুটের টাকা, আন্ডার ইনভয়েসিং ওভার ইনভয়েসিংয়ের টাকা এভাবেই পৃথিবীর দেশে দেশে আমাদের একশ্রেণীর ব্যবসায়ী পাচার করছেন। কিছুদিন আগেক্যাসিনোকাণ্ডের ওপর খবর পড়েছি। দেখেছি শত শত কোটি টাকার খেলা। কীভাবে এসব টাকা পাচার হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে একশ্রেণীর বাঙালি ব্যবসায়ী দেশে অর্থসম্পদ করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সমানে পাচার করছেন। বহুদিন আগেই মালয়েশিয়ারসেকেন্ড হোমপ্রকল্পে শত শত বাংলাদেশী বাড়িঘর করেছে। কানাডায়বেগম নগরীবলে একটা শহর আছে, যা বাংলাদেশী প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আস্তানা। এছাড়া দুদিন পর পরই বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কার কোথায় টাকা-পয়সা আছে, তার খবর কাগজে পড়ি। শুনি তদন্ত হচ্ছে। কিন্তু পরে আর খবর পাই না। বস্তুত গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ থেকে যে কত টাকা পাচার হয়েছে, তার প্রকৃত হিসাব পাওয়া কঠিন কাজ। যেকোনো আড্ডায়, ক্লাবে, রেস্টুরেন্টে, বাণিজ্যিক অফিসে, ব্যাংকে আলোচনা করলেই পাওয়া যায় নানা ব্যবসায়ী-শিল্পপতির নাম। কার বাড়িঘর কোথায় কোথায়, কার ব্যবসা কোথায় কোথায়, সব খবর খোলামেলা আলোচনা হয়। এসব লোকের মধ্যে প্রভাবশালী-চাকরিজীবী সামরিক-বেসামরিক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, পেশাজীবী, সাংবাদিক, ব্যাংকার থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ, শিক্ষক সবই আছেন। বস্তুত কোন প্রভাবশালীর ছেলেমেয়ে, স্ত্রী-পুত্র পরিজন বিদেশে বসবাস করে না, বিদেশের নাগরিক নন, গ্রিন কার্ডহোল্ডার নন, তা বলা মুশকিল। এরা কীভাবে টাকা বিদেশে পাচার করলেন? সহজ উত্তর। বিদেশীরা আমাদের মতো মানি লন্ডারিংয়ের ব্যাপারে এত স্পর্শকাতর নয়। তারা ডলার চায়। ডলার বিনিয়োগই তাদের প্রধান কাম্য। কে, কীভাবে ডলার নিয়ে গেল, তা তাদের কাছে বড় বিবেচ্য বিষয় নয়। ডলার দিলে নাগরিকত্ব পাওয়া যায়। ডলার নিয়ে গেলে খোলামেলা ব্যবসা করা যায়। রফতানিকারক সরকারিভাবে কোনো টাকা বিদেশে নিতে পারে, যা দিয়ে ব্যবসা করা বাড়িঘর করা যায়। বিষয়টি এখনওপেন সিক্রেট অবস্থাটা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বিদেশে যাদের ছেলেমেয়ে থাকে, তাদের ঋণ না দিতে। আবার টাকা পাচার করলে কর আদায় করবেন। দেখা যাক ফলাফল কী?

তবে আমার প্রশ্ন অন্যত্র। দেশে যে প্রশংসনীয় উন্নতি-উন্নয়ন হচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। - শতাংশজিডিপিপ্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে। বড় একটা গোষ্ঠী মধ্যবিত্ত হয়েছে। সাধ-স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব নেই। গাড়ি ছাড়া মধ্যবিত্ত নেই বললেই চলে। মাথাপিছু আয় যথেষ্ট বেড়েছে। দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যারাই টাকার মালিক হচ্ছে, যারাই প্রভাবশালী, যারাই একটু লেখাপড়া করছে, যারা জ্ঞানী-বিজ্ঞানী, তারা কেউ বাংলাদেশে থাকতে চান না। যে ছেলে পান্তা ভাত-শুঁটকি খেয়ে মানুষ হয়েছে, সে বিদেশের নাগরিক হয়ে দেশে এসে বলেকী নোংরা এই ঢাকা শহর। দম বন্ধ হয়ে যায়। কেউ কেউ একুশে ফেব্রুয়ারিতে এসে আমাদের কাছে জাতীয়তার পরিচয় দিয়ে যায়।

বড় প্রশ্ন কেন? কেন ধনীরা, প্রভাবশালীরা দেশে থাকতে চায় না? বাজেট, পরিকল্পনা জিডিপি প্রবৃদ্ধি মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ইত্যাদির ফল কী হলো তাহলে? উন্নয়নের ফসল হাতে করে যদি ধনাঢ্য/শিক্ষিত/অবসরপ্রাপ্ত প্রভাবশালীরা দেশ ছেড়ে চলে যায়, তাহলে বাংলাদেশ কি শুধু গরিবদের জন্যই থাকবে?

 

. আর এম দেবনাথ: অর্থনীতি বিশ্লেষক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন