রাশিয়ার সঙ্গে মূল্যযুদ্ধে জড়িয়ে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের সরবরাহ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সৌদি আরব। এর জের ধরে গত এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে হঠাৎ জ্বালানি পণ্যটির রফতানি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়িয়ে দেয় দেশটি। তবে পরের মাসেই যুক্তরাষ্ট্রে পণ্যটির রফতানি কমিয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনে দেশটি। চলতি মাসেও এ ধারা অব্যাহত রয়েছে এবং মাসের শেষার্ধে পণ্যটির রফতানিতে এ নিম্নমুখিতা অব্যাহত থাকলে যুক্তরাষ্ট্রে সৌদি আরবের জ্বালানি তেল রফতানি কমে গত ৩৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে যেতে পারে। সম্প্রতি ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে এ সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে।
ব্লুমবার্গের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি মাসের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সৌদি আরব থেকে যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র একটি জ্বালানি তেলবাহী কার্গো রফতানি হয়েছে। দৈনিক গড় হিসাবে যার পরিমাণ ১ লাখ ৩৩ ব্যারেল। অথচ গত এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রে দৈনিক গড়ে ১৩ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেল রফতানি করেছিল সৌদি আরব। অর্থাৎ এপ্রিলের তুলনায় চলতি মাসে দেশটি থেকে যুক্তরাষ্ট্রে জ্বালানি পণ্যটির রফতানি কমেছে প্রায় এক-দশমাংশ।
পণ্যটির রফতানির এ নিম্নমুখিতা যদি চলতি মাসের বাকি সময়ে টেকসই হয়, তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জুনে সৌদি জ্বালানি তেলের রফতানি কমে গত ৩৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামতে পারে বলে ব্লুমবার্গের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে জ্বালানি তেলের বাজারে যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছিল, তা অনেকটা গুছিয়ে আসতে পারে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষকরা।
জ্বালানি তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে অর্গানাইজেশন অব এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ ও এর মিত্র দেশগুলোর জোট ওপেক প্লাস। চলতি বছরের শুরু থেকেই অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বাজার বিভিন্ন ধরনের বড় ঘটনার সাক্ষি হয়েছে। নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর পণ্যটির বৈশ্বিক চাহিদা অপ্রত্যাশিতভাবে কমতে শুরু করে। সঙ্গে কমতে থাকে দাম। ২০১৭ সালের পর থেকে পণ্যটির বাজার উদ্বৃত্ত সরবরাহে ছিল। এর ওপর চাহিদার হঠাৎ রেকর্ড পতনে উদ্বৃত্ত সরবরাহে পণ্যটির বাজার সয়লাব হয়ে যায়। এ পরিস্থিতিতে পণ্যটির দামে চাঙ্গা ভাব ফেরাতে মার্চের শুরুর দিকে বৈঠকে বসে ওপেক প্লাস জোট। তবে রাশিয়ার আপত্তিতে কোনো ধরনের চুক্তি ছাড়াই বৈঠকটি শেষ হয়।
এর জের ধরে সৌদি আরব ও রাশিয়া পণ্যটির মূল্যযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। একদিকে নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাবে বৈশ্বিক চাহিদায় ধস, অন্যদিকে চলমান মূল্যযুদ্ধ—সব মিলিয়ে গত ২০ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রতি ব্যারেল (প্রায় ১৫৯ লিটার) অপরিশোধিত জ্বালানি তেল মাইনাস ৩৭ দশমিক ৬৩ ডলারে বিক্রি হয়েছিল। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বাজারের যখন এ হাল, তখন পণ্যটির দামে চাঙ্গা ভাব ফেরাতে ফের বৈঠকে বসে ওপেক প্লাস। বৈঠকে ওপেকভুক্ত দেশ, রাশিয়া এবং অন্য সহযোগী দেশগুলো মে ও জুনজুড়ে জ্বালানি পণ্যটির উত্তোলন সক্ষমতার তুলনায় দৈনিক গড়ে ৯৭ লাখ ব্যারেল কমিয়ে আনার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছে, যা পণ্যটির মোট বৈশ্বিক সরবরাহের ১০ শতাংশ। সম্প্রতি চুক্তিটির মেয়াদ আরো এক মাস বাড়ানো হয়েছে।
জ্বালানি পণ্য বাজার বিশ্লেষণকারী কোম্পানি এনার্জি আসপেক্ট লিমিটেডের প্রধান জ্বালানি তেল বিশ্লেষক অস্রিতা সেন বলেন, সৌদি আরব থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের রফতানি এমন সময়ে কমতে শুরু করতে পারে, যখন যুক্তরাষ্ট্রে পণ্যটির পরিশোধন কার্যক্রম বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ উত্তোলন হ্রাসও অব্যাহত রয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পরিশোধনাগারগুলোকে অন্য কোনো দেশ থেকে পণ্যটির আমদানি করতে হতে পারে।
তবে চলতি মাসের বাকি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে সৌদি আরব কী পরিমাণ জ্বালানি তেল রফতানি করবে, সে বিষয়ে এখনো নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি। যদিও নিজেদের পরিচয় গোপন করে রিয়াদের জ্বালানি শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চলতি মাসের শেষার্ধে ও আগামী মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে জ্বালানি তেল রফতানি বৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখছেন না তারা। এতে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্যটির মজুদ কমে গিয়ে দামে ঊর্ধ্বমুখী প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।