খেলাপি হওয়ার পথ বন্ধ তাই বাড়ল দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ

হাছান আদনান

আর্থিক স্বাস্থ্য ভালো দেখাতে বছরের শেষ দুই মাস খেলাপি ঋণ লুকিয়ে ফেলতে ব্যস্ত থাকে ব্যাংকাররা। পুনঃতফসিল অবলোপনের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ লুকানো হয়। যদিও তার স্থায়িত্ব হয় মাত্র তিন মাস। মার্চ এলেই প্রকাশ হয়ে যায় ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের কুৎসিত চেহারা। এক দশক ধরে এমন চিত্রই দেখা গেছে দেশের ব্যাংকিং খাতে। করোনা তাণ্ডবের আশীর্বাদে হঠাৎ করেই ধারায় ছন্দপতন এসেছে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে খেলাপি ঋণ কমেছে। যদিও রেকর্ড পুনঃতফসিল ঋণের বোঝা যুক্ত হওয়ায় দেশের ব্যাংকিং খাতে দুর্দশাগ্রস্ত (স্ট্রেসড) ঋণের হার পরিমাণ উভয়টিই বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, গত জানুয়ারি-মার্চ তিন মাসে খেলাপি ঋণ হাজার ৮২০ কোটি টাকা কমেছে। মার্চ শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। তিন মাস আগে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা ছিল ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ। তারও আগে গত বছরের মার্চে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা। সে হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৮ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা কমেছে।

খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনাকে সফলতা হিসেবেই দেখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। করোনা তাণ্ডবে বিধ্বস্ত উদ্যোক্তাদের সুরক্ষা দিতে চলতি বছরের প্রথম থেকেই ঋণখেলাপি হওয়ার পথ বন্ধ। ব্যাংকঋণ পরিশোধ না করলেও ঋণগ্রহীতারা ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি হওয়ার সুযোগ নেই। তাছাড়া ২০১৯ সালে ৫০ হাজার ১৮৬ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়মিত করা হয়েছে, যা এক বছরে সর্বোচ্চ পরিমাণে পুনঃতফসিলের রেকর্ড। তাই পরিস্থিতির বিচারে খেলাপি ঋণ কমাকে কেবলই কাগজ-কলমে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৮ সাল শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে স্ট্রেসড বা দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ ছিল লাখ ৮৬ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ২০১৯ সালে পুনঃতফসিল করা ৫০ হাজার ১৮৬ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। সে হিসেবে বিদায়ী বছর শেষে শুধু দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় লাখ ৩৭ হাজার ৪৬ কোটি টাকা। ঋণের সঙ্গে অবলোপনকৃত প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকা ঋণ যুক্ত হলে ব্যাংকিং খাতের বিপদগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।

চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ২৪ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা। হিসেবে ব্যাংকঋণের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই বিপদগ্রস্ত। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, মার্চ শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার মাত্র দশমিক শূন্য শতাংশ। আর দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের হিসাব এখনো তৈরি করতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেখানো খেলাপি ঋণের পরিসংখ্যানকে শুধুই সান্ত্বনা মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর . সালেহউদ্দিন আহমেদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে পরিমাণ দেখাচ্ছে, বাস্তবতা তার চেয়ে অনেক বেশি। ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের এক-চতুর্থাংশেরও বেশি বর্তমানে দুর্দশাগ্রস্ত (স্ট্রেসড) পুনঃতফসিল করা ঋণ যদি আবার খেলাপি হয়, তাহলে সে ঋণ পুনঃতফসিল করে কী লাভ? যদিও একই ঋণ বহুবার পুনঃতফসিল করা হচ্ছে। বর্তমানে তো ঋণখেলাপি হওয়ার সুযোগই নেই। তাই খেলাপি ঋণ কমেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন তথ্যই বিভ্রান্তিকর।

ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া গ্রাহকরা কিস্তি পরিশোধ না করলেও খেলাপি করা যাবে না, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমন নির্দেশনা জারি করেছিল গত ১৮ মার্চ। ওই সময় বলা হয়েছিল, জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত কোনো গ্রাহক কিস্তি পরিশোধ না করলেও তার ঋণ মান খারাপ হবে না। তবে কোনো ঋণখেলাপি ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করলে তার ঋণ মান উন্নত করা যাবে। পরে নির্দেশনার মেয়াদ আরো তিন মাস বাড়িয়ে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। পরিস্থিতির বিচারে ঋণখেলাপি না করার নির্দেশনার সময়সীমা আরো তিন মাস বাড়িয়ে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত করতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেটি হলে চলতি বছরে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ার আর কোনো সুযোগ থাকছে না।

ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমাতে পুনঃতফসিলে গণছাড় দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। শতাংশ ডাউন পেমেন্টে এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ১০ বছরে ঋণ পরিশোধের সুযোগ পেয়েছে ঋণখেলাপিরা। ২০১৯ সালের ১৬ মে নীতিমালায় ছাড় দেয়ার পর থেকে বিশেষ বিবেচনায় পুনঃতফসিল হয়েছে ১৮ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে বিদায়ী বছর পুনঃতফসিল হয়েছে ৫০ হাজার ১৮৬ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। এর মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকগুলো পুনঃতফসিল করেছে ৩০ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা। আর রাষ্ট্রায়ত্ত আটটি ব্যাংক ১৯ হাজার ৬০১ কোটি টাকা এবং বিদেশী ব্যাংকগুলো ৩৮ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছে।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, গত বছর ঋণখেলাপিদের বড় ছাড় দেয়ায় রেকর্ড পরিমাণ খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে। তার ধারাবাহিকতা চলতি বছরের জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি পর্যন্তও ছিল। দুই মাসেও কিছু ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে। এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে। তাছাড়া সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি হওয়ার পথও বন্ধ। তার মানে আগামী তিন মাসেও কোনো গ্রাহক ঋণখেলাপি হওয়ার সুযোগ নেই।

তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে গ্রাহকদের ঋণ পরিশোধে ছাড় দেয়া হয়েছে। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো, ভালো ব্যবসা করছেন এমন গ্রাহকরাও ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করা বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন না দিলেও ব্যাংকের টাকা গ্রাহকদের ফেরত দিতেই হবে। আগামী বছর একসঙ্গে এত চাপ উদ্যোক্তারা নিতে পারেন কিনা, সেটিই দেখার বিষয়।

ঋণখেলাপিদের সবচেয়ে বড় নীতি ছাড় দেয়া হয় ২০১৫ সালে। ওই সময় ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ আছে, এমন ব্যবসায়ীদের ঋণ পুনর্গঠন করে দেয়া হয়। এর পর থেকেই দেশের ব্যাংকিং খাতে বাড়তে শুরু করেছে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৪ সালে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার ছিল দশমিক শতাংশ। ওই সময় পুনর্গঠন পুনঃতফসিলকৃত ঋণের হার ছিল দশমিক শতাংশ। দুই শ্রেণীর ঋণ মিলিয়ে ব্যাংকিং খাতে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের হার ছিল ১৩ দশমিক শতাংশ। এর পর থেকেই প্রতি বছর লাফিয়ে লাফিয়ে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমান হার বেড়েছে। মূলত বাছবিচার না করে দেয়া ঋণ খেলাপি হতে শুরু করলে, সে ঋণ পুনঃতফসিলও করা হয়েছে গণহারে। ফলে ২০১৮ সাল শেষে ব্যাংকিং খাতে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক শতাংশ। এর মধ্যে ১০ দশমিক শতাংশ ছিল খেলাপি ঋণ, বাকি ১০ দশমিক শতাংশ ছিল পুনঃতফসিল পুনর্গঠনকৃত ঋণ।

২০১৪ সালে ব্যাংকগুলোর পুনঃতফসিলকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১২ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। এর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের হার বেড়েছে। ২০১৮ সালে ব্যাংকগুলো ২৩ হাজার ২১০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করে। আর বিদায়ী বছরে পুনঃতফসিলকৃত ঋণের পরিমাণ ঠেকেছে ৫০ হাজার ১৮৬ কোটি টাকায়। পুনঃতফসিলকৃত ঋণও দুই-চার মাসের মাথায় খেলাপি হচ্ছে। এতে প্রতিনিয়ত দেশের ব্যাংকিং খাতে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ হার বাড়ছে।

ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনীতির প্রতিটি শাখায়ই বিপর্যয় নামিয়েছে মহামারী করোনাভাইরাস। বিশ্বব্যাপী চালানো তাণ্ডবের অর্থনৈতিক ক্ষত শুকাতে এক দশকও লেগে যেতে পারে বলে পূর্বাভাস দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। করোনা আঘাতের আগে থেকেই খেলাপি ঋণের ভারে বিধ্বস্ত ছিল দেশের ব্যাংকিং খাত। মূলধন ঘাটতি, সঞ্চিতি ঘাটতি, তারল্য সংকটসহ বহুমুখী সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছিল দেশের অর্ধেকের বেশি ব্যাংক। পরিচালনা পর্ষদ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে অনিয়ম-দুর্নীতি ঋণের নামে সম্পদ লুণ্ঠন হয়েছে অনেক ব্যাংকে। এখন করোনা মহামারীতে ব্যাংকগুলোর সংকট কতটা গভীর হবে, তা নিয়েই উদ্বিগ্ন সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ।

অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পরিচালন ব্যয় কমানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। এজন্য উদ্যোগী হয়েছে বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) কর্মীদের বেতন-ভাতা ১৫ শতাংশ কর্তনসহ ব্যয় কমাতে ১৩ দফা সুপারিশ করেছে সংগঠনটি। এরই মধ্যে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন কমিয়েছে অন্তত চারটি ব্যাংক। যদিও খেলাপি ঋণ আদায়ে জোর দিতে দেখা যায়নি বিএবিকে।

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন