এশিয়ায় ধারে বাণিজ্যে খেলাপের পরিমাণ বাড়ছে

বণিক বার্তা ডেস্ক

আমদানিকারকদের কাছ থেকে পাওনা অর্থ আদায় না হওয়ার বা খেলাপি হয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন এশিয়ার ধারে পণ্য সরবরাহকারী রফতানিকারকরা। ধারে রফতানির ক্ষেত্রে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর পণ্য হাতে পাওয়ার পর রফতানি চুক্তি বা চালানে নির্দিষ্ট করা সময়ের মধ্যে রফতানিকারক কোম্পানির পাওনা অর্থ পরিশোধ করে দেয়ার নিয়ম রয়েছে। চলমান মহামারী পরিস্থিতিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এশিয়ার রফতানিকারক কোম্পানিগুলোর পাওনা অর্থ সময়মতো পরিশোধ না করতে পারায় খেলাপি হয়ে পড়ার প্রবণতা বাড়ছে। সাম্প্রতিক এক জরিপে তথ্য উঠে এসেছে। খবর সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট।

চীন, ভারত, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া হংকংয়ের হাজার ৪০০টিরও বেশি কোম্পানির মধ্যে জরিপ চালানো হয়। দেখা গিয়েছে, এসব কোম্পানির ক্রেতাদের কাছে চালানে উল্লিখিত পাওনা অর্থের ৫২ শতাংশই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিশোধ করতে পারেনি আমদানিকারকরা। ২০১৯ সালে হার ছিল ২৯ দশমিক শতাংশ। বাণিজ্যিক পাওনা খেলাপি হয়ে পড়ার হারে বিরাট উল্লম্ফনের পেছনে দায়ী করা হচ্ছে চলমান মহামারীকেই।

বাণিজ্যিক ঋণ বীমা প্রতিষ্ঠান অ্যাট্রাডিউস এশীয় রফতানিকারক কোম্পানিগুলোর মধ্যে জরিপ চালায়, যার ফলাফল প্রকাশ হয়েছেট্রেড প্র্যাকটিস ব্যারোমিটারশীর্ষক প্রতিবেদনে। জরিপের কার্যক্রম শুরু হয় মার্চে। ওই সময় সংক্রমণ পরিস্থিতি চীনে শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছার পাশাপাশি ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রে গতিশীল হয়ে উঠছিল।

অ্যাট্রাডিউসের হংকং তাইওয়ান অঞ্চলে নিযুক্ত মহাব্যবস্থাপক ভিনসেন্ট কুর মতে, মুগও্যন্যমুমু নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণজনিত বিপর্যয়ে এশিয়ার বাণিজ্যিক খাতে যেদেউলিয়াত্বের ঝড়দেখা দিয়েছে, তার সবচেয়ে বাজে দৃশ্যপটটি জরিপের তথ্যে উঠে আসেনি।

তিনি বলেন, উত্তর এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে এরই মধ্যে লকডাউন পদক্ষেপ প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যবসায়িক কার্যক্রমে এখনো এর কোনো প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। কারণ এখনো ব্যবসায়িক ভ্রমণের ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করা রয়েছে। বছরের বাকি সময় নিয়েও এখনো খুব একটা আশাবাদী না আমরা।

দেশভিত্তিক হিসাব অনুযায়ী, রফতানি চালান বাবদ খেলাপি হয়ে পড়া অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধির দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে ভারতীয় কোম্পানিগুলো। দেশটির কোম্পানিগুলোর বাণিজ্যিক ঋণ বাবদ পাওনা অর্থ খেলাপের পরিমাণ বেড়েছে ৬৯ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে তাইওয়ান। দেশটির কোম্পানিগুলোর সময়মতো পরিশোধ না হওয়া পাওনা অর্থের পরিমাণ বেড়েছে ৬৭ শতাংশ। ইন্দোনেশিয়ার কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ৪৭ শতাংশ। অন্যদিকে চীন, তাইওয়ান, ইন্দোনেশিয়া হংকংয়ের কোম্পানিগুলোর সময়মতো পরিশোধ না হওয়া সম্মিলিত গড় পাওনার পরিমাণ বেড়েছে ৫৬ শতাংশ।

চীন   হংকংয়ের কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে হার তুলনামূলক কম, যথাক্রমে ৩১ ৩৭ শতাংশ। রফতানি বাবদ পাওনা অর্থ খেলাপের পরিমাণ বৃদ্ধির হার সবচেয়ে কম বেড়েছে সিঙ্গাপুরভিত্তিক কোম্পানিগুলোর, ২৯ শতাংশ।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) তথ্য অনুযায়ী, বৈশ্বিক বাণিজ্য খাতের ৮০ শতাংশই ঋণ, বীমা বা গ্যারান্টিভিত্তিক অর্থায়নের ওপর নির্ভরশীল। অর্থায়নের ৮০ শতাংশই আসে ব্যাংকিং খাত থেকে। ব্যাংকিং খাতে অর্থায়নের সবচেয়ে বহুল প্রচলিত মাধ্যম হলো লেটার অব ক্রেডিট বা ঋণপত্র।

অন্যদিকে ধারে পণ্য রফতানির ভিত্তি হলো সরবরাহকারী ক্রেতা বা আমদানিকারক রফতানিকারকের মধ্যকার বন্দোবস্ত, যা ওপেন অ্যাকাউন্ট ট্র্যানজেকশন হিসেবে পরিচিত। ধরনের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ক্রেতা পণ্য হাতে পাওয়ার ৩০ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে অর্থ পরিশোধ করে দেয়।

অ্যাট্রাডিউসের চিফ মার্কেট অফিসার অ্যান্ড্রিয়াস টেশ বলেন, বৈশ্বিক অর্থনীতি এখন মন্দার দিকে ধাবমান হওয়ায় খেলাপি ঝুঁকিও এখন বাড়ছে। আমাদের আশঙ্কা ২০২১ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কুঋণ দেউলিয়াত্বের পরিমাণ বাড়তির দিকেই থাকবে।

এর আগে বিশ্বব্যাংকের এক পূর্বাভাসে বলা হয়, চলতি বছর বৈশ্বিক অর্থনীতির সংকোচন হবে দশমিক শতাংশ। সে হিসেবে বলা যায়, মহামারী সংক্রমণ ঠেকাতে গৃহীত শাটডাউন বা ধরনের পদক্ষেপের কারণে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সবচেয়ে মারাত্মক মন্দার দিকে এগিয়ে চলেছে বিশ্ব।

মহামারীর আগে থেকেই কিছুটা পড়তির দিকে ছিল বিশ্ব বাণিজ্য। ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সের ২০১৯ সালের ট্রেড রেজিস্টার রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মোট পরিমাণ আগের বছরের চেয়ে শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ১০ হাজার কোটি ডলারে। এজন্য দায়ী করা হয়েছে ডলারের বিনিময় হার অবলোপন চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধকে।

অন্যদিকে চলমান নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন বাধাগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি ভোক্তা চাহিদাও এখন নিম্নমুখী। ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সের প্রক্ষেপণ বলছে, চলতি বছর বিশ্বব্যাপী মোট বাণিজ্যের পরিমাণ হ্রাস পেতে পারে ১১ থেকে ৩০ শতাংশ।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এশিয়ার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এখন নিজস্ব ক্যাশ ফ্লো বজায় রাখার জন্য সরবরাহকারীদের কাছ থেকে ধারে পণ্য ক্রয়ের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সরবরাহকারীদের পাওনা অর্থ পরিশোধের জন্য ব্যাংকঋণের বদলে নিজস্ব ক্রেতাদের ওপরই নির্ভর করছেন তারা। অর্থাৎ ক্রেতাদের কাছে পণ্য বিক্রির পর সে অর্থ দিয়ে সরবরাহকারীর পাওনা পরিশোধের কৌশল হাতে নিচ্ছেন তারা। এতে করে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পাওনা অর্থ আদায় নিয়ে এক ধরনের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে, যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। অবস্থায় পাওনা অর্থ পরিশোধ না হওয়ার ঝুঁকি থেকে সুরক্ষা নিতে সরবরাহকারী বা রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এখন ট্রেড ক্রেডিট ইন্স্যুরেন্স গ্রহণের প্রবণতা বাড়ছে বলে জানালেন ভিনসেন্ট কু।

আইনি ফার্ম সিমনস অ্যান্ড সিমনসের অংশীদার জলিয়ন এলউড রাসেল বলেন, ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিক অর্থায়নে অস্বীকৃতি জানানোয় এশিয়ার ক্ষুদ্র মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নগদ অর্থের সংকট এবং অর্থ পরিশোধের সক্ষমতার সংকট ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।

তিনি আরো বলেন, তারল্য সংকটের কারণে বিশ্বব্যাপী ব্যাংকগুলো এখন মানের দিকেই নজর দিচ্ছে বেশি। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো অর্থায়নের জন্য ক্ষুদ্র ব্যবসার তুলনায় ভালো আর্থিক অবস্থাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোকেই বেছে নিচ্ছে বেশি। কারণে সামনের দিনগুলোয় এশীয় ক্ষুদ্র মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় ব্যাংক থেকে তারল্য সরবরাহের পরিমাণ আরো কমবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন