করোনাক্রান্তের কয়েকটি দিন...

মো. মাইদুল ইসলাম প্রধান

করোনা পরীক্ষা করার আগে আমার শরীরে অনেক জ্বর ছিল। আগের দুইরাত ঘুমাইনি। ৩১ মে পরীক্ষা করলাম, পরদিন করোনা পজেটিভ এলো। জ্বর অনেক ছিল। কেন যেন মনে হচ্ছিল আমাকে হাসপাতালে যেতে হবে, ভর্তি হতে হবে। সেদিনই দিবাগত রাত ২টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হলাম।

রাত কাটলো না ঘুমিয়েই। আত্মীয়-স্বজন কাউকে বলিনি যে আমি হাসপাতালে ভর্তি। ভেবেছিলাম সবাইকে কষ্ট দেয়ার কাজ কি। এমনিতেই ভালো হয়ে যাবো।

পরদিন বেলা ১২টার দিকে আমার ওপর করোনার প্রথম আঘাত শুরু হল। ছিলাম ওয়াশরুমে। হঠাৎ কিছুটা ঘাম শুরু হলো। মুহূর্তে মনে হচ্ছিল আমি ওয়াশরুম থেকে বিছানা পর্যন্ত হয়তো আর মুভ করতে পারবো না। দ্রুত আমি উঠে দাঁড়ালাম। বিছানার কাছে গিয়ে বিছানায় পড়ে গেলাম। এরপর আমার আর কিছু মনে নেই। জেগে দেখি মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো আছে। পাশে একজন নার্স দাঁড়িয়ে। 

নার্স বললেন, ভয় নাই। আপনার সঙ্গে কেউ আসেনি? আমি বললাম, কেউ জানে না আমি এখানে। উনি বললেন, বাড়িতে ফোন করে লোকজন নিয়ে আসুন। আপনার পাশে সার্বক্ষণিক লোক থাকা লাগবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম সিরিয়াস কিছু কি হয়েছে আমার? বললেন, অক্সিজেন লাগানো দেখছেন না? প্রতি ঘণ্টায় যাচ্ছে ৪-৫ কেজি অক্সিজেন। 

বলা ভালো, আমার অক্সিজেন স্যাচুরেশন এত কমে গিয়েছিল যে, তখন এই অক্সিজেন না হলে মারা যেতে মাত্র ৫ মিনিট সময় লাগতো। এরপর টানা ৪ দিন অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। খুললেই স্যাচুরেশন একেবারে নিচে নেমে আসে। সে যে কি কষ্টের একটা সময়, কাউকে বোঝানো যাবে না! শুধু মুখটা খুলে দ্রুত একটা ডিমের কিছু অংশ জোর করে খেয়ে নিতাম। 

সামান্য পানি খেতে মুখ খুললেও স্যাচুরেশন নিচে নেমে যেত অনেক। কী একটা বিভিষীকাময় সময়গুলো! মনে হচ্ছিল কঠিন সময়গুলো আর ফুরাবে না। শ্বাসকষ্টের পাশাপাশি বুকে ব্যথা যখন শুরু হলো তখন একবার ভাবলাম, এ যাত্রা আর ফেরা হবে না!

করোনার কাছে কত শক্তিশালী মানুষ বিদায় নিচ্ছে, আমিও তাদের একজন। কবরটা এলাকায় যাতে দেয় একবার এটা বলার কথা ভাবলাম। টানা ৫ দিন কোনো উন্নতি নাই। আমি হাল ছেড়েই দিয়েছিলাম। 

ষষ্ঠ দিনে গিয়ে হঠাৎ আমার পালস অক্সিমিটারটা দেখলাম আমার পক্ষে কথা বলা শুরু করে দিল। অক্সিজেন মাস্ক পরলে তখন ৯৭/৯৮ আর মাস্ক খুললে ৯২ তে গিয়ে আর নিচে নামছে না। আমি কি যে খুশি হলাম দেখে। ডাক্তারকে বললাম দেখেন ৯২ এর নিচে নামছে না। ডাক্তার বললেন, ৯২-কে ৯৬-এ নিতে হবে। কিছু ব্যায়াম দিলেন। সেগুলো ঠিকঠাক করে ৯৪/৯৫-তে নিয়ে গেলাম দ্রুতই।

স্যাচুরেশন প্রবলেম যেদিন কমলো ঠিক সেদিন থেকেই শুরু হলো বমি ও লুজ মোশনের মতো বাজে অসুখ। ভয়াবহ ব্যাপার শুরু হলো। কিছুই খেতে পারি না, সঙ্গে সঙ্গে বমি হয়ে যায়। এ এক অন্যরকম লড়াই শুরু হলো। একে তো কোনো কিছুই খেতে পারি না, রুচি বলতে কিছুই নেই, তার ওপর এত এত কঠিন সব সমস্যা। ডাক্তাররা কিছু খুলেও বলে না। মুখের ভাবভঙ্গি দেখে ভেবে নিই কী হতে যাচ্ছে। যাইহোক, এরপর ইনজেকশন, অ্যান্টিবায়োটিক সব বৃদ্ধি পেতে শুরু হলো। ধীরে ধীরে করোনাও তার শক্তি হারাতে থাকলো। এক সময় করোনা আমাকে রেহাই দিয়েই দিল!

এক এক করে ১৩ দিন পর প্রথম টেস্টে নেগেটিভ এলো। বুঝলাম করোনা আর দেহে নাই। মনে তখন অনেক সাহস চলে এলো। বাড়ি চলে এলাম।

কিছু ওষুধ এখনো খাচ্ছি। শরীর অনেক দুর্বল। লিখতে হাত কাঁপছে। 

আশা করছি, আল্লাহপাকের অশেষ কৃপায় খুব দ্রুতই পুরোপুরি ভালো হয়ে যাবো, ইনশাআল্লাহ।

তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন