বাজেট ২০২০-২০২১

বাড়তি টাকা পেলাম, এখন কী করব?

ড. আহমদ মোশ্‌তাক রাজা চৌধুরী

বাজেট নিয়ে এমন আগ্রহ আগে কখনো চোখে পড়েনি। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল মাননীয় অর্থমন্ত্রীর ঘোষণার দিকেকরোনা থেকে পরিত্রাণে সরকার কী করবে। বাজেটে কি বাড়তি টাকার জোগান হবে স্বাস্থ্য খাতের জন্য? শেষ পর্যন্ত ঘোষণা এল। হ্যাঁ, স্বাস্থ্য খাতে কিছু বাড়তি টাকা দেয়া হলো। বাজেট নিয়ে সবাই কখনো একমত হন না এবং সেটাই স্বভাবিক। সবাইকে খুশি করা যায় না। এবারকার বাজেট নিয়েও তা- হয়েছে। একটা মিশ্রিত প্রতিক্রিয়া।

অর্থমন্ত্রীকে এই বাড়তি টাকার জন্য সাধুবাদ জানাই। করোনা সংকট এবং এর পরবর্তী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়তে কীভাবে আমরা বাজেটে বরাদ্দের অর্থ স্মার্টলি ব্যবহার করব, অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় ব্যাপারে তেমন কোনো দিকনির্দেশনা অবশ্য নেই।

কভিড-১৯ প্রতিরোধের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত আরো কয়েকটি সেক্টরের বরাদ্দ বেড়েছে, যেমন কৃষি, শিক্ষা, সেফটিনেট ইত্যাদি। তবে পরিবেশ, বন জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে বরাদ্দ কেন কমেছে, তা বোধগম্য নয়।  এবারকার বাজেটকে যদি বলা হয়স্বাস্থ্যবান্ধব’, তাহলে পরিবেশকে অবহেলা করে বেশিদূর এগোনো যাবে না। আর্সেনিক সমস্যা তো এখন প্রায় বিস্মৃত। এর সঙ্গে পরিবেশ, কৃষি স্বাস্থ্যের যোগাযোগের ব্যাপারটি কে না জানে

এবার আসা যাক স্বাস্থ্য বিষয়ে বরাদ্দের ব্যাপারে। বরাদ্দ বেড়েছে। থোক বরাদ্দও আছে। প্রশ্ন হলো, এই বাড়তি টাকা কোথায় এবং কীভাবে খরচ হবে। জাতি হিসেবে এক চরম সংকটের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি। বলা হয়, প্রতি সংকটেরই একটা ইতিবাচক দিক থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ধ্বংসাবশেষের ওপর তৈরি করল তাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাএকেকটা স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি, যার মাধ্যমে প্রতি নাগরিকের জন্য নিখরচায় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হলো। ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডার গণহত্যার পর গড়া হলো তাদের ইউনিভার্সেল হেলথ কভারেজ বা সবার জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। করোনা আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ত্রুটিগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। তবে আশার কথা হলো, করোনা পরিস্থিতি বাংলাদেশকে তার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে নতুন করে সাজিয়ে তোলার একটি সুযোগও এনে দিয়েছে। সংস্কারকাজের একটা উপাদান হলো বাজেট, যা এই বছর আমরা একটু বাড়তিই পেয়েছি। এই বাড়তি টাকা আমরা কীভাবে স্বাস্থ্য সংস্কারকাজে ব্যবহার করতে পারি? আমাদের এই ব্যাপারে এখনই ফয়সালা করতে হবেআমরা কি সেই আগের নিয়মেই খরচ করব, নাকি সংস্কারকে অগ্রভাগে রেখে আমরা নতুন নতুন চিন্তাভাবনা করব? আমাদের বিশ্বাস সদাশয় সরকার শেষোক্ত পথে পা বাড়াবে। একমাত্র পথে হাঁটলেই আমরাভিশন ২০৪১’-এর দিকে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে পারব। 

গত কিছুদিন থেকে দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সংস্কারের বিভিন্ন ক্ষেত্র নিয়ে যে মতামত দিয়েছেন, তাতে অনেক বিষয়ে তারা একমত পোষণ করেছেন। এগুলোর কয়েকটি নিচে উল্লেখ করছি। 

স্থায়ী জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন গঠন: প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে একটি স্থায়ী স্বাস্থ্য কমিশন গঠনের তাগিদ রয়েছে। উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন এই কমিশনের কাজ হবে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভিশন নির্ণয় এবং তা অর্জন করার কৌশল নির্ধারণ। উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন এই কমিশনের প্রধান হবেন ক্যাবিনেট মন্ত্রীর সমান মর্যাদার একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা, যার প্রতি রয়েছে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের অঙ্গীকার, আগামী দুই-তিন বছরের অর্জনে এই কমিশন নজরদারি করবে। 

স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জবাবদিহিতার নিশ্চিতকরণ: জবাবদিহিতা বাড়ানোর নিমিত্তে অচিরেই একটি জাতীয় স্বাস্থ্য নিরাপত্তা সংস্থা স্থাপন করতে হবে। স্বাস্থ্য বাজেটের সমুদয় অর্থ সংস্থার কাছে থাকবে।  জনসংখ্যার ভিত্তিতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিভিন্ন অঙ্গ যেমন হাসপাতাল, প্রাথমিক পরিচর্যা, বিভিন্ন স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাজেটের বিপরীতে অর্থ প্রদান করবে। সংস্থাটির নিজস্ব অডিট মনিটরিং বিভাগ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিভিন্ন কাজের দেখভাল করবে। সংস্থা স্থাপনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রেপারচেজার প্রভাইডারভূমিকাকে পৃথকীকরণের মাধ্যমে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে। 

ব্যবস্থাপনা সুশাসন: স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বল ব্যবস্থাপনার বিষয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। দুর্বলতা সরকারি বেসরকারি দুই খাতেই সমভাবে উপস্থিত। ব্যবস্থাপনা দুর্বলতার বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে তার একটি টেকসই সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। গ্রামাঞ্চলে ডাক্তারদের অনুপস্থিতি একটি দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা সমস্যা। থাইল্যান্ডসহ অনেক দেশ এটার গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে বের করেছে, যার মধ্যে আছে বিশেষ আর্থিক অন্যান্য প্রণোদনা দেয়া। 

ভবন নির্মাণ স্থগিতকরণ: স্বাস্থ্য বাজেটের এক বিশাল অংশ ব্যয় হয় বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা নির্মাণে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এগুলো হয় খুব অপরিকল্পিতভাবে। তাই আপাতত দুই-তিন বছরের জন্য ভবন নির্মাণ বন্ধ বা স্থগিত করে এই অর্থ স্বাস্থ্য সংস্কারের অন্যান্য কাজে ব্যয় করা যায়।

প্রাথমিক পরিচর্যা নাগরিক অংশগ্রহণে জোর দেয়া: বাংলাদেশে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা সবসময়ই অবহেলিত। কমিউনিটি ক্লিনিক বা ইউনিয়ন/উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্য কার্যক্রমগুলো মানুষের তেমন উপকারে আসছে না। ডাক্তারের অনুপস্থিতি ওষুধের অপ্রতুলতা একটি নিত্যকার সমস্যা, যার কারণে সাধারণ জনগণ এর সুফল ভোগ করতে পারে না।  প্রাথমিক পরিচর্যার কাজগুলো যদি সুচারুরূপে সম্পন্ন হতো, তাহলে করোনার কারণে শহরের হাসপাতালগুলোর ওপর এত চাপ পড়ত না। একইভাবে সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ প্রায় নেই বললেই চলে। করোনার পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যাওয়ার একটি কারণ হলো, আমরা সমাজের বিভিন্ন স্তরের লোকজনকে করোনা মোকাবেলায় উদু্বদ্ধ করতে পারিনি। 

গবেষণা উপাত্ত তৈরিতে দুর্বলতা: স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে নাগরিকের প্রয়োজন মেটাতে প্রাসঙ্গিক গবেষণা এবং প্রয়োজনীয় উপাত্তের কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশে সরকারি পর্যায়ে অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যাদের মূল কাজ গবেষণা উপাত্ত সংগ্রহ। কিন্তু প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই তাদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব সম্পাদন পুরোপুরি করছে না। করোনার দৌরাত্ম্যে দেশ এখন এক মহাসংকটে। এই দুর্যোগে ধরনের প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন ছিল বড় বেশি। 

উপরোক্ত সংস্কার বাস্তবায়নে যেটি সবচেয়ে বেশি জরুরি তা হলো, সরকারের সর্বোচ্চ অঙ্গের রাজনৈতিক অঙ্গীকার। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বা ইউনিভার্সেল হেলথ কভারেজ অর্জনে সরকার জাতীয় আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা জানি, বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে তারা অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। পদ্মা সেতু বিদ্যুৎ উৎপাদন দুটি উদাহরণ মাত্র। একইভাবে একটি সুষম, ন্যায়সংগত এবং সবার জন্য উপযোগী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়তে সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এখনই তা বাস্তবায়নে এগিয়ে যাওয়া উচিত।  কভিড-১৯ আমাদের সেই পথে এগোতে একটি নতুন সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে কীভাবে ধরনের সংস্কার কার্যকর করে রাষ্ট্র নেতারা ইতিহাসে তাদের নাম স্থায়ীভাবে লিখিয়ে নিয়েছেন। মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সময়ে এর চেয়ে সুবর্ণ সুযোগ কোনো রাজনৈতিক নেতা বা গোষ্ঠীর জীবনে কি ফিরে আসতে পারে?

 

. আহমদ মোশ্‌তাক রাজা চৌধুরী

উপদষ্টো প্রতিষ্ঠাতা ডিন

জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ

সাবেক ভাইস চেয়ার, ব্র্যাক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন