কভিড-১৯ বা নভেল করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও গত ২৬ মার্চ থেকে লকডাউন (যা সাধারণ ছুটি হিসেবে বাংলাদেশে পরিচিত) শুরু হয়েছে, যা কয়েক দফায় বেড়ে অবশেষে গত ৩০ মে শেষ হয়। দীর্ঘ লকডাউনের কারণে স্বাভাবিকভাবেই দেশের অর্থনীতি বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। নভেল করোনাভাইরাসের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকে উপার্জনহীন হয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে অনানুষ্ঠানিক খাতে যারা কাজ করেন, যেমন নিম্ন আয়ের, দিনমজুর, খেটে খাওয়া মানুষ, হকার, হোটেল-রেস্তোরাঁ বা বিভিন্ন দোকানে যারা কাজ করেন, তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। লকডাউন চলাকালে অস্ট্রেলিয়ার মনাশ ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ১০ হাজার খানা নিয়ে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ আংশিক বা পুরোপুরি উপার্জনহীন হয়ে পড়েছে এবং প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ মাঝারি থেকে তীব্র খাদ্য সংকটে পড়েছে। একই গবেষণার আওতায় এক মাস সময়ের ব্যবধানে করা আরো এক জরিপে দেখা গেছে যে সময়ের সঙ্গে খাদ্য সংকটের তীব্রতা বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৬ শতাংশ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যার অন্যতম কারণ পোশাক শিল্পে উৎপাদন ব্যাহত হওয়া, উৎপাদন হ্রাস পাওয়া ও বিশ্ববাজারে পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে রফতানি কম হওয়া এবং প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স হ্রাস পাওয়া। লকডাউন-পরবর্তী সময়, যেমন চলতি বছরের শেষ ভাগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রবৃদ্ধির এই হার প্রবৃদ্ধি ঘাটতি ইঙ্গিত করে। অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে লকডাউন চললেও আমাদের দুর্বল প্রস্তুতি, সম্পদের সীমাবদ্ধতা এবং অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের জীবিকার তাগিদে ও বেশকিছু ক্ষেত্রে অসচেতনতার কারণে নভেল করোনাভাইরাসের বিস্তারও যে খুব একটা রোধ করা গেছে, তেমনটা প্রতীয়মান হয় না। অন্তত গত এক মাসে দেশের করোনা পরিস্থিতি সেটাই ইঙ্গিত করে। এ অবস্থায় দেশের থেমে থাকা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আবারো শুরু হয়েছে অফিস-আদালত ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার মধ্য দিয়ে। নভেল করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে বাংলাদেশ কতটা সফল বা ব্যর্থ, তা এ লেখার মূল উদ্দেশ্য নয়; বরং কীভাবে করোনা পরিস্থিতি সামাল দিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের সুস্থতা যতটা পারা যায়, তা নিশ্চিত করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া যায়, সে বিষয়ে কিছু ধারণা দেয়া।
একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের সুস্থতা ও দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে যে বিষয়গুলোয় জোর দেয়া উচিত, তার অন্যতম হলো দৈনিক নভেল করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানো। এ লেখা খসড়া হওয়া পর্যন্ত গত এক সপ্তাহে বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রতি এক মিলিয়নে গড়ে প্রায় ২ হাজার ৫০০ মানুষের নভেল করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষা করা হচ্ছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। বর্তমানে মোট ৫৫টি ল্যাবে নভেল করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেজ পলিমারেজ চেইন রিকশন বা জঞ-চঈজ পদ্ধতিতে নভেল করোনাভাইরাস শনাক্তকরনণ পরীক্ষা করা হচ্ছে, যা সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পরীক্ষা বলে ধরা হয়। বিশ্বের অনেক দেশই দ্রুত নভেল করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের জন্য অন্য কিছু পরীক্ষা পদ্ধতি ব্যবহার করেছে। এমন কিছু পরীক্ষা পদ্ধতি বাংলাদেশেও যাচাই করে দেখা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের করোনাচিত্র সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেতে প্রতি এক মিলিয়ন মানুষের মধ্যে ১০ হাজার জনের পরীক্ষা করা প্রয়োজন। পিসিআর যন্ত্রের ব্র্যান্ডভেদে একসঙ্গে অনেক নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব হলেও আমাদের বর্তমান প্রয়োজন অনুযায়ী তা যথেষ্ট নয়। পরীক্ষার ধরনের কারণেই ফলাফল জানতে বেশ কিছুটা সময় লাগে। আবার পরীক্ষাটি ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে এ পরীক্ষা করে শরীরে নভেল করোনাভাইরাস আছে কিনা, সেটা জেনে নেয়া সবার পক্ষে সম্ভবও হচ্ছে না। সেই সঙ্গে হাল আমলে যোগ হয়েছে পরীক্ষা করার জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করা। সব মিলিয়ে যত দ্রুত, যত বেশিসংখ্যক মানুষের ওপর নভেল করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষা করা প্রয়োজন, তার থেকে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। অথচ এ সময়ে যত বেশিসংখ্যক পরীক্ষা করে যারা নভেল করোনাভাইরাসমুক্ত, তাদেরকে দ্রুত কাজে ফিরিয়ে নিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিরাপদে আবারো শুরু করাটা একটা যৌক্তিক পদক্ষেপ হতে পারে। সীমিত সময় ও সম্পদের মধ্যে দ্রুততম সময়ে অধিকসংখ্যক মানুষের জন্য নভেল করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষা নিশ্চিত করার একটা উপায় হতে পারে দলগত পরীক্ষা বা গ্রুপ টেস্টিং।
কোনো বড় জনগোষ্ঠীর মধ্যে রোগ নির্ণয়ের জন্য গ্রুপ টেস্টিং কোনো নতুন ধারণা নয়। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল ইকোনমির অধ্যাপক রবার্ট ডর্ফম্যানের ১৯৪৩ সালের একটি লেখায় প্রথম গ্রুপ টেস্টিংয়ের ধারণা পাওয়া যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিপুলসংখ্যক মার্কিন সৈন্যের মধ্যে সিফিলিস রোগের অস্তিত্ব খুঁজে বের করতে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। পরবর্তীকালে বিশ্বের নানা দেশে হেপাটাইটিস বি, এভিয়ান নিউমোভাইরাস ও এইচআইভি শনাক্তকরণের জন্য এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। গ্রুপ টেস্টিংয়ে একজন মানুষের নমুনার পরিবর্তে একাধিক মানুষের নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব এবং এতে সময় ও খরচ দুটোই বাঁচে। ধরা যাক একটি পুলিশ ব্যারাকে মোট ১০০ জন পুলিশ সদস্য আছেন। কোনো কারণে এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে যে এদের মধ্যে কেউ কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন। এ ধারণা সত্যি কিনা, সেটা যাচাই করার উপায় হলো প্রত্যেক সদস্যের জন্য নভেল করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষা করা, যেটা একদিকে যেমন সময়সাপেক্ষ, অন্যদিকে ব্যয়বহুলও বটে। এ সমস্যার একটা সহজ, দ্রুত এবং সুলভ সমাধান হতে পারে গ্রুপ টেস্টিং। এ পদ্ধতিতে এই ১০০ জন সদস্যের নমুনা সংগ্রহ করে সেটা একটি নমুনা হিসেবে পরীক্ষা করা হবে। এতে দুটো বিষয় জানার সুযোগ আছে। পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ এলে বোঝা যাবে এ ব্যারাকে কোনো পুলিশ সদস্যই নভেল করোনাভাইরাসে অক্রান্ত নন, কাজেই সবাই কাজে যাওয়ার জন্য উপযোগী অথবা পরীক্ষার ফলাফল পজিটিভ হলে বোঝা যাবে ব্যারাকে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে যে সন্দেহ ছিল সেটা সত্যি। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তখন প্রত্যেক সদস্যকে আলাদা করে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে কে বা কারা আক্রান্ত হয়েছেন। এ পরীক্ষার ফলে একদিকে যেমন আগেই অধিকসংখ্যক পরীক্ষা না করায় সময় ও খরচ কমানো গেল, অন্যদিকে সুস্থ পুলিশ সদস্যদের কর্মঘণ্টার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা গেল।
এটি কেবল একটি সহজ উদাহরণ মাত্র। এ লেখা প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেব্রাস্কা অঙ্গরাজ্যে এবং ইসরায়েলে গ্রুপ টেস্টিং পদ্ধতিতে নভেল করোনাভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে। গ্রুপ টেস্টিং পদ্ধতি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে, সেটা ভেবে দেখার সুযোগ আছে। এ পদ্ধতিতে নভেল করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষার বৈজ্ঞানিক দিকগুলোর ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মতামত নেয়া একান্ত প্রয়োজন। গ্রুপ বা দলে মানুষের সংখ্যা ঠিক কত হলে পরীক্ষার ফলাফল সঠিক এবং যথাযথ থাকে, সেটি নিরূপণ করা প্রয়োজন। এখন পর্যন্ত একসঙ্গে ৬৪ জনের নমুনা, যার মধ্যে একজন প্রকৃতপক্ষে নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, একসঙ্গে গ্রুপ টেস্টিং পদ্ধতিতে পরীক্ষা করে সঠিক ফলাফল পাওয়া গেছে। গ্রুপ বা দলের ধরন কেমন হবে বা কোন কোন ক্ষেত্রে এ পদ্ধতিতে পরীক্ষা করা হবে, কীভাবে বাস্তবায়ন করলে এটি সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে এবং সর্বোপরি সবার জন্য নিরাপদ হবে, তার একটি সুনির্দিষ্ট প্রোটোকল থাকতে হবে। প্রোটোকল প্রণয়নে বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল ও সীমিত সম্পদের দেশে লকডাউন-উত্তর সময়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিরাপদে শুরু করতে গ্রুপ টেস্টিং পদ্ধতির সম্ভাবনা যাচাই করা প্রয়োজন। বিশেষ করে শিল্প-কারখানায় শ্রমিকদের দ্রুততম সময়ে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে, নিরাপদে কাজে ফিরিয়ে নিতে এটি সহায়ক হতে পারে। সেই সঙ্গে ঘরের বাইরে, গণপরিবহনে, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও কলকারখানায় অন্য সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করা বিশেষ জরুরি। নভেল করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষা ও চিকিৎসা সুবিধা ঢাকার পাশাপাশি প্রয়োজন অনুযায়ী অন্যান্য জেলাশহরে বা প্রয়োজনে থানা পর্যায়ে পৌঁছে দেয়া এবং দেশব্যাপী নভেল করোনাভাইরাস ও এর থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন।
এছাড়া আরো যে বিষয়গুলো মনে রাখা প্রয়োজন সেগুলো হলো, যাদের কাজের প্রয়োজনে প্রতিদিন বাইরে যেতে হচ্ছে, তাদের একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর পরীক্ষা করা দরকার। কারণ একবার পরীক্ষা করে শরীরে নভেল করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব না পাওয়ার অর্থ এই নয় যে পরীক্ষিত ব্যক্তি কখনো নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবেন না। কারো শরীরে করোনাভাইরাসের লক্ষণ দেখা গেলে গ্রুপ টেস্টিংয়ের জন্য অপেক্ষা না করে যত দ্রুত সম্ভব পরীক্ষা করতে হবে। এ মুহূর্তে যখন সরকার আক্রান্তের হার অনুযায়ী ঢাকা শহরকে লাল (৪০/১০০,০০০), হলুদ (৩-১৯/১০০,০০০), সবুজ
(<৩/১০০,০০০) বিভিন্ন জোনে ভাগ করতে চাইছে, তখন গ্রুপ টেস্টিং পদ্ধতি বেশ কার্যকর হতে পারে। যেমন কোনো একটি বিশেষ এলাকার সব ভবনের বাসিন্দার উপযুক্ত সংখ্যায় দলে ভাগ করে গ্রুপ টেস্টিং করা যেতে পারে। গ্রুপ টেস্টিং পরিবারভিত্তিকও হতে পারে। এক্ষেত্রে জোন ভাগাভাগি করার পরিকল্পনা সহজে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে এবং এ উদ্যোগ নভেল করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে কার্যকরী হওয়ার সম্ভাবনা বাড়াতে পারে।
মনে রাখা প্রয়োজন যে গ্রুপ টেস্টিং স্বতন্ত্র বা একক পরীক্ষা পদ্ধতির কোনো বিকল্প নয়। জনসংখ্যা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা, সম্পদের অপ্রতুলতা এবং সার্বিক অবস্থা বিচারে বাংলাদেশের পক্ষে নভেল করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষার আদর্শ লক্ষ্য অর্জন করা হয়তো সহসাই সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে লক্ষণভিত্তিক একক নভেল করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষার পাশাপাশি গ্রুপ টেস্টিং পদ্ধতির ব্যবহার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও সীমিত সম্পদের ওপর থেকে চাপ কমাতে এবং নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যেসব এলাকায় বেশি, সেসব এলাকা দ্রুত নির্দিষ্ট করতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। গ্রুপ টেস্টিংয়ের জন্য লক্ষণভিত্তিক এবং দৈবচয়ন উভয় প্রক্রিয়ায় এলাকা নির্ধারণ করা যেতে পারে। দৈবচয়ন প্রক্রিয়ায় এলাকা নির্ধারণ করে পরীক্ষা করলে তা নভেল করোনাভাইরাসের বিস্তার সম্পর্কে একটি ধারণা দিতে পারবে। দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে সরকার এরই মধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। গ্রুপ টেস্টিংয়ের ব্যবহার এক্ষেত্রে একটি সহায়ক পদক্ষেপ হতে পারে।
সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকস অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি, মনাশ ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া