কভিড-১৯ সংকট

ব্যাংকে ব্যাংকে কমছে কর্মীদের বেতন-ভাতা

হাছান আদনান

করোনা তাণ্ডবের আগে দ্য সিটি ব্যাংকের আয় ও ব্যয়ের অনুপাত ছিল ৫৫ শতাংশ। অর্থাৎ, প্রতি ১০০ টাকা আয় করতে ব্যাংকটিকে ব্যয় করতে হয়েছে ৫৫ টাকা। চলমান সংকটে আয়ের প্রায় সব পথ সংকুচিত হয়ে পড়ায় বর্তমানে ব্যাংকটির আয়-ব্যয়ের অনুপাত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৬ শতাংশে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বছর শেষে ব্যাংকটি লোকসানে পড়বে। এ অবস্থায় লোকসান ঠেকানোর পাশাপাশি কর্মীদের চাকরি বাঁচাতে ব্যয় সংকোচনের উদ্যোগ নিয়েছে ব্যাংকটি। এরই অংশ হিসেবে কর্মীদের বেতন, ইনক্রিমেন্ট ও অন্যান্য ভাতার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে দ্য সিটি ব্যাংক।

৩০ হাজার টাকার বেশি বেতন পান, এমন কর্মীদের বেতন-ভাতার ১০ শতাংশ কর্তন করেছে সিটি ব্যাংক। একই সঙ্গে বন্ধ থাকবে কর্মীদের বছর শেষের ইনক্রিমেন্টও। পদোন্নতি বন্ধ রাখার পাশাপাশি কর্মীদের পারফরম্যান্স বোনাস না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যাংকটি। চলতি বছরের জুন থেকে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বেতন-ভাতাসংক্রান্ত এ নতুন নির্দেশনা কার্যকর থাকবে।

বিষয়টিতে বেশ নাখোশ প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা। অন্যদিকে দ্য সিটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী মাসরুর আরেফিন বলছেন, আগুন যেহেতু লেগেছে ফায়ার সার্ভিস আসতই। এজন্য ফায়ার সার্ভিস আসার আগেই আগুন নেভানোর চেষ্টা করছি।

সিটি ব্যাংকের মতোই টিকে থাকার তাগিদে কর্মীদের বেতন-ভাতা কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে বেশ কয়েকটি ব্যাংক। গত মাস থেকেই এন্ট্রি লেভেল থেকে এমডি পর্যন্ত ৩ ও ৫ শতাংশ হারে বেতন-ভাতা কর্তন করেছে এবি ব্যাংক। একই পথে হাঁটতে যাচ্ছে এক্সিম ব্যাংকও। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে বেসরকারি খাতের অন্যান্য ব্যাংকেও।

যেকোনো ব্যাংকের আয়ের প্রধান উৎস হলো বিতরণকৃত ঋণ থেকে প্রাপ্ত সুদ। এর বাইরে বিভিন্ন ধরনের ফি আর এলসি কমিশন থেকেও বড় অংকের আয় করে থাকে ব্যাংকগুলো। কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোর আয়ের এ দুটি উৎসই প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করলেও ৩০ জুন পর্যন্ত গ্রাহকদের খেলাপি না করার নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে স্থগিত করা হয়েছে এপ্রিল ও মে মাসের ঋণের সুদও। এ অবস্থায় ব্যবসা-বাণিজ্য সচল আছে, এমন সামর্থ্যবান গ্রাহকরাও ব্যাংকঋণের কিস্তি পরিশোধ বন্ধ রেখেছেন।

আমদানি-রফতানিসহ দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা নেমে আসায় ব্যাংকের কমিশন আয়ও নেমে এসেছে এক-তৃতীয়াংশে। এ অবস্থা দেশের প্রায় সব ব্যাংকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এ পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে ব্যাংকগুলো, বিশেষত বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো এখন ব্যয় সংকোচনেই জোর দিচ্ছে সবচেয়ে বেশি।

মূলত প্রাথমিক পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণযোগ্য ব্যয় হ্রাসের ওপরই ব্যাংকগুলো জোর দিচ্ছে সবচেয়ে বেশি। এক্ষেত্রে জোর দেয়া হচ্ছে নতুন কর্মী নিয়োগ না দেয়া, নতুন শাখা না খোলা, বিদ্যমান শাখার সংখ্যা ও পরিসর কমিয়ে আনা, স্টেশনারি ব্যয় হ্রাস, কর্মীদের টিএ-ডিএ বিলে কাটছাঁট ও বিদ্যুৎসহ অন্যান্য ইউটিলিটি বিল কমিয়ে আনার ওপর। একই সঙ্গে বিদ্যমান কর্মীদের বেতন-ভাতা কর্তন, কর্মী ছাঁটাইয়ের মতো কঠোর পদক্ষেপও নেয়া শুরু করেছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো।

দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে ক্রেডিট কার্ড, রিটেইল ও এসএমই ব্যাংকিংয়ের জন্য বেশ সুনাম অর্জন করেছে দ্য সিটি ব্যাংক। সম্পদের বিপরীতে আয় (আরওএ) এবং ইক্যুইটির বিপরীতে আয়ের (আরওই) দিক থেকেও সিটি ব্যাংকের অবস্থান সামনের সারিতে। তার পরও ৩৫ হাজার কোটি টাকা সম্পদের ব্যাংকটির কর্মীদের বেতন-ভাতা কেন কমাতে হলো জানতে 

চাইলে ব্যাংকটির এমডি মাসরুর আরেফিন বলেন, তিনটি কারণ ও দুটি উদ্দেশ্য নিয়ে কর্মীদের বেতন-ভাতা কমানো হয়েছে। প্রথমত, ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনায় ব্যাংকের আয়ে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। দ্বিতীয়ত, বহু চেষ্টা করেও আমানতের সুদহার কমানো যাচ্ছে না, ব্যাংকের নতুন কোনো বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। তৃতীয়ত, ঋণগ্রহীতারা ব্যাংকের টাকা ফেরত দিচ্ছে না। সুদ খাত থেকে ব্যাংকটির কোনো আয় নেই বললেই চলে। তার ওপর আমদানি-রফতানিতে ভয়াবহ বিপর্যয়ের কারণে এলসি কমিশনও নেই। কভিড-১৯ সৃষ্ট পরিস্থিতিতে সিটি ব্যাংক এরই মধ্যে ৩৯৪ কোটি টাকা ক্ষতির শিকার হয়েছে। এ অবস্থায় ব্যাংকের লোকসান ঠেকানো ও কর্মীদের চাকরি বাঁচাতেই বেতন-ভাতা কমানো হয়েছে। এটি করতে আমরা বাধ্য হয়েছি।

সিটি ব্যাংকের এ সিদ্ধান্তকে শতভাগ সঠিক ও সময়োপযোগী বলে মনে করছেন ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম মজুমদার। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, একটি সুস্থ-সবল সুন্দর ব্যাংককে জীবিত রাখার জন্য সিটি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ যে উদ্যোগ নিয়েছে, সেটি সাহসী সিদ্ধান্ত। এজন্য ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই। বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখতে কর্মীদের বেতন-ভাতা কমানো এবং বিশেষ বোনাস বন্ধ করার কোনো বিকল্প নেই। ব্যাংক টিকে থাকলে কর্মীদের চাকরিও টিকবে। কোনো ব্যাংক ধসে গেলে দেশের অর্থনীতিতে বিপর্যয় আরো গভীর হবে। ব্যাংক কর্মীদের বেতন-ভাতা কমানোর বিষয়ে এরই মধ্যে অর্থমন্ত্রী ও গভর্নরের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তাদের পক্ষ থেকেও ইতিবাচক বার্তা পেয়েছি।

নজরুল ইসলাম মজুমদার বেসরকারি খাতের এক্সিম ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান। নিজ ব্যাংকের কর্মীদের বেতন-ভাতা কমানোর বিষয়ে তিনি বলেন, সবার আগে আমাদের ব্যাংকের কর্মীদের বেতন-ভাতা কমানোর ইচ্ছা ছিল। কিন্তু কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে সেটি এখনো সম্ভব হয়নি। তবে সহসাই পর্ষদের সভা করে কর্মীদের বেতন কমানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

দেশের অর্থনীতিতে করোনার ঢেউ আঘাত হানার পর সবার আগে কর্মীদের বেতন-ভাতায় ছুরি চালিয়েছে এবি ব্যাংক। গত মাসে (মে) ব্যাংকটির সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার (এসপিও) থেকে এমডি পর্যন্ত পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের গ্রস বেতন-ভাতার ৫ শতাংশ কর্তন করা হয়। এন্ট্রি লেভেল থেকে প্রিন্সিপাল অফিসার (পিও) পর্যন্ত কর্মীদের বেতন-ভাতা কমানো হয় ৩ শতাংশ। মে, জুন, জুলাই—এ তিন মাসের জন্য ওই হারে বেতন-ভাতা কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে অস্তিত্ব রক্ষায় এবি ব্যাংককে কর্মীদের এ বেতন-ভাতা কর্তনের হার আরো বাড়ানো হতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

তবে সাধারণ ব্যাংকারদের যুক্তি হলো, দেশের ব্যাংকিং খাত লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে মূলত চেয়ারম্যান, পরিচালক ও শীর্ষ পর্যায়ে দায়িত্ব পালনকারী ব্যাংকারদের মাধ্যমে। পরিচালকদের তদবির ও রাজনৈতিক প্রভাবে বাধ্য হয়ে দেয়া ঋণগুলো আর ব্যাংকে ফেরত আসেনি। এখন করোনা পরিস্থিতিতে সেসব অপকর্মের দায়ভার সাধারণ ব্যাংকারদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে।

কয়েকটি ব্যাংকের বিভিন্ন পদমর্যাদার বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কর্মীদের বেতন না কমিয়ে খেলাপি ঋণ উদ্ধারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। একই সঙ্গে ব্যাংকের পরিচালক, তাদের পরিবার ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের পেছনে ব্যাংকের যে অর্থের অপব্যয় হয়, তার লাগাম টেনে ধরলে ব্যাংকের ব্যয় এমনিতেই এক-চতুর্থাংশ কমে যাবে। কিন্তু তা না করে ব্যাংক কর্মকর্তাদের মেধা ও শ্রমের অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, গত ১৩ মে বণিক বার্তায় ‘ব্যয় সংকোচনে ব্যাংক; কর্মীদের বেতন কমতে পারে ১০-২৫ শতাংশ’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

>>ব্যয় সংকোচনে ব্যাংক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন