বৈশ্বিক র‍্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হতাশাজনক অবস্থান

মৌলিক গবেষণা ও উচ্চশিক্ষার মানে দীনতারই বহিঃপ্রকাশ

উচ্চশিক্ষা এখন আর দেশের ভূখাণ্ডিক সীমানা বা আঞ্চলিক চৌহদ্দিতে আটকে নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যের মতো উচ্চশিক্ষারও ব্যাপকতর বিশ্বায়ন ঘটেছে। তাই বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যকার প্রতিযোগিতা বৈশ্বিক। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সম্মানের, সমৃদ্ধির নতুন জ্ঞানজগতে এগিয়ে চলার। সাংহাই, টাইমস হায়ার এডুকেশন (টিএইচই), কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডসের (কিউএস) মতো সংস্থার র‍্যাংকিং উচ্চশিক্ষার প্রতিযোগিতায় নতুন মাত্রা এনেছে। এর মধ্যে কিউএসের প্রকাশিত সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকাকে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মনে করা হয়। র‍্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বৈশ্বিক প্রবণতার উল্টো পথে অবস্থান করছে। সম্প্রতি প্রকাশিত তালিকার প্রথম ১০টিতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য   সুইজারল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অবস্থান করছে। ১১তম অবস্থানে রয়েছে সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর (এনইউএস) প্রথম ১০০টিতে রয়েছে ফ্রান্স, জার্মানি, চীন, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া তাইওয়ানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান। ২০০টির মধ্যে রয়েছে ভারতের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সৌদি আরবের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান। আর ৩০০-৫০০-এর মধ্যে আছে ইন্দোনেশিয়ার দুটি বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, সমপর্যায়ের দেশগুলোর বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় তালিকার প্রথম ৫০০ অবস্থানের মধ্যে থাকলেও বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের তাতে স্থান হয়নি। তথ্যানুযায়ী, কিউএসের বিশ্বসেরা এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় টানা তৃতীয়বারের মতো স্থান পেয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) বৈশ্বিক মানদণ্ডে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এমন হতাশাজনক অবস্থান মৌলিক গবেষণা উচ্চশিক্ষার মানে দীনতারই বহিঃপ্রকাশ। স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর সময়কালে এটি মোটেই কাঙ্ক্ষিত নয়।

যেকোনো দেশের শিক্ষা গবেষণার প্রাণকেন্দ্র হলো সেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। পুরনো জ্ঞানের সংরক্ষণ বিতরণ এবং নতুন জ্ঞান সৃজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ। মৌলিক গবেষণা ব্যতিরেকে যা কখনই সম্ভব নয়। পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, র‍্যাংকিংয়ের শীর্ষে অবস্থানরত ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি মূলত একটি গবেষণানির্ভর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। পাশাপাশি প্রথম সারির দিকের বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাফল্যও গবেষণাকেন্দ্রিক। তার মানে সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিতভাবে নতুন নতুন গবেষণা হয়, সেগুলোর মানও বিশ্বমানের এবং তারা গবেষণাকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়। অথচ বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা উল্টোমুখী। ইউজিসির এক প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, দেশের ৬৫ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হয় না। গবেষণার বদলে চলে মুখস্থনির্ভর চাকরিকেন্দ্রিক পড়ালেখা। শিক্ষার্থীরা ভর্তি হওয়ার পর পরই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয় চাকরির চিন্তা, ভবিষ্যৎ চিন্তা। প্রকৃত অর্থে বিশ্ববিদ্যালয় হলো দেশের মুক্ত জ্ঞানচর্চার স্থান। শিক্ষার্থী-শিক্ষকরা গবেষণা করবেন, নতুন নতুন উদ্ভাবন করবেন, জাতিকে বিশ্বদরবারে মেলে ধরবেনএটাই হওয়া উচিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উদ্দেশ্য। কিন্তু হচ্ছে ঠিক ব্যতিক্রম। শিক্ষার্থীদের হাতে দেয়া হচ্ছে কিছু পাঠ্যবই, লেকচার শিট, মুখস্থনির্ভর পরীক্ষা আর নামমাত্র রিসার্চ পেপার; যার যথার্থতা শিক্ষকরা সঠিকভাবে বিচার করেও দেখেন না। তাদের মুক্ত জ্ঞানচর্চার সুযোগ না দিয়ে বরং ক্লাসে বাধ্যতামূলক উপস্থিতি, অ্যাসাইনমেন্ট প্রেজেন্টেশনের গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখা হয়। বৈশ্বিক মানে এগিয়ে যেতে হলে পাঠদানের গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে গবেষণাকেন্দ্রিক পাঠদানে অধিক মনোযোগ দিতে হবে বৈকি।

সত্য যে গবেষণার জন্য বাস্তবিক কিছু সমস্যাও বিদ্যমান। গবেষণায় বরাদ্দ কম। আগ্রহী শিক্ষকদের তেমন কোনো প্রণোদনা দেয়া হয় না। বেসরকারি পর্যায় থেকেও গবেষণায় অনুদান দেয়ার প্রথা বিরল বললেই চলে। ফলে অনেকেই ইচ্ছা থাকলেও কাঙ্ক্ষিত গবেষণা করতে পারেন না। আবার উল্টো দিকে গবেষণায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যাও বরাদ্দ দেয়া হয়, তাও অনেক সময় ঠিকমতো ব্যয় হয় না। আনুগত্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় রাজনৈতিক দলীয় রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ণের কারণে যথার্থ শিক্ষক বা শিক্ষার্থী অনেক ক্ষেত্রে গবেষণাসংক্রান্ত অর্থ পান না। এতে গবেষণা ব্যাহত হচ্ছে। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণার মান পরিমাণ বাড়াতে হলে এসব বিষয়েরও সুষ্ঠু সুরাহা জরুরি।

আরেকটি বিষয় হলো, ভাচুর্য়াল জগতে হালনাগাদ না থাকা এবং নাজুক অবস্থান। বাংলাদেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটের অবস্থাই চরম দুর্দশাগ্রস্ত। ওয়েবসাইটে গেলে বহু পুরনো কিছু তথ্য মেলে অথবা আদৌ কিছুই জানা যায় না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আনুষ্ঠানিক উপস্থিতি নেই। ফলে দেশের বাইরে থেকে যদি জানতে চান বাংলাদেশী কোনো বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে, ওয়েবসাইট থেকে প্রায় কোনো তথ্যই পাওয়া যায় না। এর সমাধান কিন্তু কঠিন নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা শিক্ষা এবং অন্যান্য অর্জন সম্পর্কে খুব সহজেই ভালো ওয়েবসাইট বানানো হালনাগাদ করে রাখা সম্ভব। দরকার কেবল সদিচ্ছা সচেতনতা। বৈশ্বিকভাবে এগিয়ে যেতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এদিকটায় দৃষ্টি দেয়া এখন সময়ের দাবি।

জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতির যুগে বিশ্ববিদ্যালয়কে এখন আর শিক্ষার্থীদের সাদামাটা পাঠদান সনদ প্রদানের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনার সুযোগ নেই। ঐতিহ্য নিয়ে পড়ে থাকার দিনও শেষ। বিশ্ববিদ্যালয় এখন ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির চালক। মূল্যবান তথ্য বা জ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ উৎস বিশ্ববিদ্যালয়। তারা মানবসম্পদ তৈরি করে, নতুন নতুন ধারণার জন্ম দেয়। বিষয়টি আমলে নিয়ে কর্তৃপক্ষগুলো নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম মান বৃদ্ধিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে, এটিই প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন