কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকায় সরকারকে ঋণ দিচ্ছে বেসরকারি ব্যাংক

হাছান আদনান

সরকারের ট্রেজারি বিল-বন্ডের নিলামে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো। আবার ব্যাংকগুলোই রেপোতে ধার নেয়ার জন্য প্রতিনিয়ত ধরনা দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে। কম সুদে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার নিয়ে সে টাকা থেকেই সরকারকে বেশি সুদে ঋণ দিচ্ছে অনেক বেসরকারি ব্যাংক।

করোনার আঘাত থেকে ব্যাংকগুলোকে কিছুটা সুরক্ষা দিতে রেপোর সুদহার শতাংশ থেকে দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অন্যদিকে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকার ঋণ নিচ্ছে শতাংশের বেশি সুদে। নীতি সুদহারের সঙ্গে সরকারের ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদের ব্যবধান বেড়ে যাওয়ায় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

ব্যাংকাররা বলছেন, বেসরকারি খাতে ঋণ দিতে হবে সর্বোচ্চ শতাংশ সুদে। বিতরণকৃত ঋণের বিপরীতে রাখতে হবে শতাংশ সাধারণ সঞ্চিতি (জেনারেল প্রভিশন) আবার বিতরণকৃত ঋণ ব্যাংকে ফেরত আসবে কিনা, তা নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা। অবস্থায় ব্যাংকের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ হলো সরকারকে ঋণ দেয়া। এজন্য হাতে থাকা সব অর্থ দিয়েই ট্রেজারি বন্ড কেনার চেষ্টা করছে ব্যাংকগুলো। এক্ষেত্রে রেপোতে ধার নিয়ে হলেও ট্রেজারি বন্ড কেনার চেষ্টা করা হচ্ছে।

এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বলছে, রেপোতে ধার করা টাকা দিয়ে ট্রেজারি বন্ড কেনা নিষিদ্ধ নয়। তবে তা অবশ্যই নৈতিকতাবিরুদ্ধ। রেপোর মূল স্পিরিট হলো ব্যাংকের দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে সহায়তা করা।

বিপুল রাজস্ব ঘাটতির চাপে থাকা সরকারের কার্যক্রম চলছে ব্যাংকঋণনির্ভর হয়ে। ব্যয় নির্বাহে প্রতিনিয়তই ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নিচ্ছে সরকার। সরকারের অভাবকে নিরাপদ বিনিয়োগের উপকরণ বানিয়ে ফেলেছে দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো। ধুঁকতে থাকা বেসরকারি খাতে ঋণ না দিয়ে সরকারকে ঋণ দেয়াকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন ব্যাংকাররা। যত সম্ভব সরকারকে ঋণ দাও নীতিতেই চলছে ব্যাংকগুলোর ট্রেজারি বিভাগ।

সরকারকে হাজার কোটি টাকা ঋণের জোগান দিতে জুন নিলাম ডেকেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। দুই বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের ওই নিলামে বিড হয়েছে ১১১টি। বিডে সরকারকে হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা ঋণ দিতে চেয়েছে ব্যাংকগুলো। শেষ পর্যন্ত নিলাম কমিটি গ্রহণ করেছে মাত্র ১৭টি বিড। বিডের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো থেকে সরকার ঋণ পেয়েছে ৯৭৫ কোটি টাকা। বাকি হাজার ২৫ কোটি টাকাই নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দুই বছর মেয়াদের ওই ট্রেজারি বন্ডের সুদহার (ইল্ড) ছিল দশমিক শূন্য শতাংশ। অথচ ওই দিনই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৮৫৮ কোটি টাকা রেপোতে ধার নিয়েছে ব্যাংকগুলো। আর পরের দিন জুন রেপোতে ব্যাংকগুলোর ধার নেয়া অর্থের পরিমাণ ছিল হাজার ৭৪ কোটি টাকা।

ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক মঈনউদ্দীন মনে করেন, ব্যাংকগুলো মুহূর্তে নিরাপদ বিনিয়োগের পথ খুঁজছে। সরকারকে দেয়া ঋণ যেহেতু শতভাগ নিরাপদ, এজন্য ব্যাংকগুলো ট্রেজারি বিল-বন্ড কেনাতে বেশি ঝুঁকছে। রেপোতে ধার নেয়া টাকা দিয়ে ব্যাংকগুলো ট্রেজারি বিল-বন্ড কিনছে কিনা, তা আমার জানা নেই। তবে রেপোর টাকায় বিল-বন্ড কেনায় কোনো নিষেধাজ্ঞাও নেই।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, রেপোর মূল উদ্দেশ্য হলো ব্যাংকের দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করা। এখন কোনো ব্যাংক যদি রেপোতে টাকা ধার নিয়ে ট্রেজারি বিল-বন্ড কেনে, তাহলে তা অবশ্যই নৈতিকতাবিরুদ্ধ। ধরনের ঘটনা ঘটে থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবশ্যই তা খতিয়ে দেখবে।

করোনার আঘাতের পর থেকেই ব্যাংকে আমানত আসার পথ প্রায় বন্ধ। দেশের বেশির ভাগ বেসরকারি ব্যাংকেরই আমানত গত তিন মাসে কমেছে। অবস্থায় ব্যাংকগুলো দৈনন্দিন লেনদেন মেটানোর জন্য কলমানি বাজারে ঝুঁকেছে। এতে বেড়েছে কলমানি বাজারের সুদহারও। তবে চাহিদা অনুযায়ী কলমানি বাজারে ধার পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ব্যাংকগুলোর মূল ভরসার জায়গা হয়ে পড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেপো সুবিধা। মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিদিন গড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকাও রেপোতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ধার দিয়েছে। একই সময়ে রেপোর সুদহার কমিয়ে দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নমনীয়তারই সুযোগ নিচ্ছে ব্যাংকগুলো।

মার্চেই দেশের বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে এক যুগের সর্বনিম্নে। তার পরের মাসগুলোতে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। গত দুই মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ নেই বললেই চলে। পরিস্থিতিতে ব্যাংকের হাতে যা টাকা আছে, তা দিয়ে ট্রেজারি বিল-বন্ড কেনার প্রতিযোগিতায় নেমেছে ব্যাংকাররা।

চলতি অর্থবছরের শুরুতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। বিপুল ঘাটতির কারণে পরে তা কমিয়ে লাখ ৫০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। গত এপ্রিল পর্যন্ত রাজস্ব আদায় হয়েছে লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা, যা ওই সময়ের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৬২ হাজার কোটি টাকা কম। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে হাজার ৬৪৩ কোটি টাকার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭৫ শতাংশ কম। এজন্য চলতি অর্থবছরের সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ২৭ হাজার কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ১২ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। তবে লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও শেষ পর্যন্ত পূরণ হবে না বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। উল্টো অনেক গ্রাহকই করোনা দুর্যোগে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে সঞ্চয়পত্র ভাঙাতে আসছেন।

আয়ের প্রধান উৎসগুলো স্ফীত হয়ে যাওয়ায় ব্যয় মেটাতে সরকার পুরোপুরি ব্যাংকিং খাতনির্ভর হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ৩১ মে পর্যন্ত ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৪ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা। যদিও অর্থবছরের শুরুতে ব্যাংকিং খাত থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল সরকার। পরে তা বাড়িয়ে ৭২ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা করা হয়।

ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেয়ার জন্য ট্রেজারি বিল বন্ডকে প্রধান উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে সরকার। বর্তমানে দেশে , ১৪, ৩০, ৯১, ১৮২ ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিল প্রচলিত রয়েছে। ৩১ মে পর্যন্ত তফসিলি ব্যাংকগুলো থেকে শুধু ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে সরকারের নেয়া মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৫০ হাজার ১৪০ কোটি টাকা। একই সময়ে ট্রেজারি বন্ডের মাধ্যমে সরকার তফসিলি ব্যাংক থেকে নিয়েছে লাখ ২৩ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকার ঋণ। , , ১০, ১৫ ২০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের মাধ্যমে ঋণ নিয়েছে সরকার। এছাড়া বিশেষ ট্রেজারি বন্ডের মাধ্যমেও সরকার ১২ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। সব মিলিয়ে বিল-বন্ড কেনার মাধ্যমে সরকারকে লাখ ৮৬ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা ঋণের জোগান দিয়েছে তফসিলি ব্যাংকগুলো। এর বিপরীতে ব্যাংকগুলোতে জমা আছে ৩৩ হাজার ৪৬১ কোটি টাকার সরকারি আমানত।

অন্যদিকে ট্রেজারি বিল-বন্ডসহ অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করে সরকারকে ৬৫ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা ঋণের জোগান দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নিজস্ব তহবিল থেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থের সংস্থান করেছে।

ব্যাংকগুলো বেসরকারি খাতে ঋণ না দিয়ে কেন সরকারকে ঋণ দিতে মুখিয়ে আছে? এমন প্রশ্নের জবাবে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের  (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, সরকারি সিদ্ধান্তে ব্যাংকগুলো ঋণের সুদহার শতাংশে নামিয়ে এনেছে। বেসরকারি খাতে ঋণ দিলে ব্যাংকগুলোকে শতাংশ সাধারণ সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়। বিতরণকৃত ঋণ খেলাপি হলে তো পুরো বিনিয়োগই শেষ। অবস্থায় সরকারকে ঋণ দেয়াই সবচেয়ে বেশি নিরাপদ। সরকারেরও ঋণ দরকার। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন