ছয় দফার ইতিহাসের সঙ্গে ৭ জুনের ইতিহাস চাই

ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী

গুগল বা উইকিপিডিয়া ঘেঁটে দেখা গেছে পৃথিবীর ইতিহাসে জুন গুরুত্ব বহন করে, কারণ সেদিন জনৈক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমবারের মতো স্বল্পতম সময়ে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করেন। আমাদের ইতিহাসে ১৯৬৬ সালের দিনটিকে কেউ বলেন ছয় দফা দিবস, কেউ বলেন আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঁক পরিবর্তনের দিবস, আবার কেউ বলেন লাল অক্ষরে লেখা দিবস বা রক্তাক্ষরে লেখা দিবস। ব্যক্তিগতভাবে আমি জুনকে বরং রক্তাক্ষরে লেখা দিন বলে অভিহিত করেত পছন্দ করি। আমি অস্বীকার করছি না যে দিনটি ছিল আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে এক উজ্জ্বল মাইলফলক, যা নিরস্ত্র সংগ্রামকে সশস্ত্র যুদ্ধে রূপান্তরে প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল।

ঘটনাটি ঘটেছে আজ থেকে ৫৪ বছর আগে। আমাদের জাতীয় জীবনে এই ৫৪ বছরের আগে পরে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে, যার একটি অন্যটিকে প্রায়ই ভুলিয়ে দিয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি এই দিনটিকে ভুলতে পারি না, ভুলতে পারি না সে দিনটির মহান উদ্যোক্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে কিংবা সেদিনে একান্ত দৈবক্রমে আমার বেঁচে থেকে আজও বেঁচে থাকাকে।

দিনটি ছিল মঙ্গলবার, খ্রিস্টীয় বর্ষের ১৬৬তম দিন। তারিখটাকে খ্রিস্টানরা অতি সৌভাগ্যের দিন বলে বিবেচনা করে, আর আমাদের ক্ষেত্রে তা হলো এক মিশ্র প্রতিক্রিয়ার দিন। আনন্দ-বেদনা মিশ্রিত দিন।

আনন্দের দিন এই কারণে যে সেদিন বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে আওয়ামী লীগের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় দিনটি পালিত না হলে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধ এত ত্বরান্বিত হতো কিনা সন্দেহ। দিনটি বেদনার দিন কারণে যে সেদিন পুলিশ আধা সামরিক বাহিনীর গুলিতে ১০ জন আন্দোলনকারী রাজপথে শহীদ হয়েছিলেন। অবশ্য একাদশ ব্যক্তিটি জুন কাতরিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। শেখ মুজিবুর রহমানের কারাগারের রোজনামচায় সেদিনটি এবং তার কয়েক দিন আগের পরের ঘটনা উল্লিখিত আছে। বঙ্গবন্ধুর এই ডায়েরি সঠিক ইতিহাসের আকর গ্রন্থ হয়ে বিরাজ করলেও জুনের কোনো পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস কোথাও নেই কিংবা জুনকে নিয়ে আলাপ-আলোচনা, সম্মেলন-সেমিনার খুব একটা নজরে পড়ে না। আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত কিংবা অধিষ্ঠিত না থাকলেও তার নেতা-নেত্রীরা অন্তত একটি বিবৃতি দিয়ে দিনটিকে স্মরণ করেন। আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন তার সঙ্গে কণ্ঠ মিলালেও গণমাধ্যমগুলো তাদের সযত্নে এড়িয়ে যায়। কারণে এই দিনটি এলেই আমি বেদনা ভারাক্রান্ত হয়ে নিজস্ব পরিসরে কিছুটা আহ্-উহ্ করি। হয়তো কখনো কখনো কিছু স্মৃতিচারণমূলক লেখা লেখি। গণমাধ্যমের কেউ সেটা ছাপিয়ে দেন কিংবা কেউ তা বিশ্বাসযোগ্য নয় ভেবে ডাস্টবিনে ফেলে দেন। বছর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অন্যতম কর্মসূচি হিসেবে ১৪ দল আমাকে জুনের ওপর একটি প্রবন্ধ লেখার দায়িত্ব দেয়। দুর্ভাগ্য আমাদের, দুর্ভাগ্য সারা বিশ্বের যে নভেল করোনাভাইরাস সবকিছুতে বাদ সেধেছে। অনুষ্ঠানটি করতে পারলে তা হতো মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রথম যৌথ অনুষ্ঠান। তবুও লিখছি, কেননা দিনটিকে আমি ভুলে যেতে পারি না এবং দিনটিকে ভুলে যেতে দেয়া অনুচিত।

আমি ভুলে যেতে পারি না কারণে যে সেদিন আমি মরতে মরতে বেঁচে গেছি এবং আজও বেঁচে আছি। নিজেকে তাই হারিয়ে যাওয়া ১১ জুনের মতো হতভাগা মনে করি না। সরকারি তথ্য বিবরণীতে সে আন্দোলনে মৃতের সংখ্যা ১১ জন বলা হলেও সংখ্যাটা কেউই বিশ্বাস করেনি। জেলে থেকে বঙ্গবন্ধুও যে তা বিশ্বাস করেননি, তা তার ডায়েরিতে উল্লেখ আছে। সেদিনকে ঘিরে যে সরকারি প্রেস নোট তৈরি হয়, তা সে সময়ে প্রকাশিত একটি পত্রিকা ছাপেইনি, আর তিনটি পত্রিকা ইহা একটি সরকারি ভাষ্য, উল্লেখ করে সংখ্যাটার প্রতি এক ধরনের অনাস্থা অনীহা প্রকাশ করেছে। ধরে নিলাম সংখ্যাটা ১১, তাহলে তাদের নাম বা পরিচিতি কি কোথাও লিপিবদ্ধ আছেনাকি আজ পর্যন্ত তাদের পরিবার বা স্বজনদের ব্যাপারে কিছু করা হয়েছে? ব্যক্তি উদ্যোগে নাখালপাড়ায় শহীদ মনুমিয়ার নামে একটা স্কুল আছে, কিন্তু দুঃসাহসী আবুল হোসেনের কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। আবুল সেদিন স্বেচ্ছায় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আধা সামরিক বাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করে শার্টের বোতাম খুলে আত্মদানের জন্য নির্ভয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। আধা সামরিক বাহিনী তাকে নির্দ্বিধায় হত্যা করে, প্রেস নোটে ঢাকার বর্ণনা আছে। কিন্তু সারা দেশে যে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হলো, তার কুশীলবরা কোথায় এবং সারা দেশে কি আর একজনও শহীদ হননি, তার গ্যারান্টি কোথায়?

নিজের কথা স্মরণ করি। সেদিন কার্জন হলের সামনে আমি আবদুর রাজ্জাক (মরহুম) পিকেটিং করছিলাম। এমন সময় পুলিশের আলম নামে এক ডিএসপি অত্যন্ত উদ্ধত ভঙ্গিতে হরতাল ভাঙার অভিপ্রায়ে তার জিপ গাড়ি বাহিনী নিয়ে ছোটাছুটি করছিল। তার জিপটাকে ঠেকাতে আমি রাজ্জাক সাহেব লাঠি বাঁশের গুঁড়ি দিয়ে অনেকটা মতিভ্রমের মতো জিপটার বনেটে পিটাচ্ছিলাম। হঠাৎ সেই পুলিশ অফিসার পকেট থেকে পিস্তল বের করে আমার মস্তক লক্ষ্য করে গুলি করার আগমুহূর্তে রাজ্জাক সাহেব ত্বরিত গতিতে আমাকে রাস্তায় ফেলে না দিলে আমার যে কী হতো! আজও সেদিক দিয়ে যাওয়ার সময় গা শিউরে ওঠে। লোম খাড়া হয়ে ওঠে। পরিণত বয়সে এসে আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাই যে মহান আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। স্বাধীনতা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে সমাজ পরিবর্তনের বহু আন্দোলনে শরিক হতে পেরেছি। রাজ্জাক ভাই আমাদের মধ্যে নেই, তবে সেদিন তিনি আমাকে মনে হয় দেবদূতের মতো প্রায় মৃদুস্বরে বলছিলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আমরা মরব না। জবাবে আমি শপথের মতো করে বলেছিলাম, আমিও মরব না। সে কারণে মুক্তিযুদ্ধকালে দেরাদুনে প্রশিক্ষণে যাওয়ার পথে রাজ্জাক সাহেব আমাকে দেখে চিত্কার দিয়ে বলেছেন, মান্নান তুমিও এসেছ। আমার ধারণা ছিল তুমি সুখের সদন ছেড়ে আসবে না। তার কথা বলার কারণ ছিল যে মুক্তিযুদ্ধের আগেই আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম। আর আমার হাতে তখন ফোর্ড ফাউন্ডেশনের একটি স্কলারশিপ ছিল। তদুপরি আমি ছিলাম আমার অকাল বিধবা মায়ের একমাত্র পুত্রসন্তান। যাক, ব্যক্তিগত কথা অনেক বলা হয়ে গেল।

সেদিন দেখলাম কার্জন হলের যে স্থানটিতে আমাকে পয়েন্ট ব্লাঙ্ক গুলি করা হয়েছিল, সে জায়গাটি বলতে গেলে মুছে ফেলা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর কারাগারের রোজনামচা পড়তে পড়তে দেখলাম জুন তিনি লিখেছেন যে তেজগাঁ কার্জন হল পুরান ঢাকার কোথাও কোথাও গুলি হয়েছে, তাতে অনেক লোক মারা গেছে। তবে পরিপূর্ণ খবর নিয়ে তিনি জেনেছিলেন যে শুধু তেজগাঁয়ে ১০ জন আন্দোলনকারী শহীদ হয়েছেন। তিনি তার ডায়েরিটিতে সঠিকভাবে পরের দিন উল্লেখ করেছিলেন, অনেক লোক মারা গেছে তেজগাঁ নারায়ণগঞ্জে। বর্ণনা সঠিক। দৈবক্রমে আমি তো বেঁচে গিয়েছিলাম, বেঁচে আছি।

বেঁচে যখন আছিই তখন দাবি জানাচ্ছি জুনকে স্মরণীয় নবপ্রজন্মের কাছে বরণীয় করার জন্য। ছয় দফার ইতিহাসের সঙ্গে জুনের ইতিহাস চাই। আমাদের প্রজন্মের পক্ষে এটা সম্ভব না হলেও আগামী প্রজন্ম অন্তত আমার লেখাটি পড়ে উদ্বেলিত হতে পারে এবং কিছু করার জন্য অনুপ্রাণিত হতে পারে।

 

. আবদুল মান্নান চৌধুরী: মুক্তিযোদ্ধা, বর্তমানে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের উপাচার্য

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন