অগ্রিম কর প্রত্যাহার চান ইস্পাত ও সিমেন্ট খাতের উদ্যোক্তারা

রাশেদ এইচ চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরো

নভেল করোনাভাইরাসের কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে ব্যবসা। অবস্থায় অতিরিক্ত করের বোঝা অব্যাহত থাকলে বন্ধ হয়ে যেতে পারে অনেক কারখানা। এতে বাড়বে বেকারত্ব, অনাদায়ী থেকে যাবে ব্যাংকঋণ। এসব কারণ দেখিয়ে অগ্রিম কর প্রত্যাহার চান দেশের ইস্পাত সিমেন্ট খাতের উদ্যোক্তারা।

অগ্রিম কর প্রত্যাহার চেয়ে সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চিঠি দিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে নিয়মিত পণ্য আমদানি করা চট্টগ্রামভিত্তিক একটি শিল্প গ্রুপ। চিঠিতে তারা বলেছে, করোনাভাইরাসের কারণে চলমান বৈশ্বিক অর্থমন্দার প্রভাব দেশেও প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। অবস্থার মধ্যেও কাঁচামাল আমদানি পর্যায়ে অগ্রিম করের কারণে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের, যা তাদের পুঁজিতে টান ফেলছে। শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে শতাংশ হারে অগ্রিম কর আদায় না করে উৎপাদিত পণ্য সরবরাহকালে প্রযোজ্য উৎপাদন কর হিসেবে আদায় করার অনুরোধ করা হয়েছে চিঠিতে।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) বিভিন্ন খাতের কোটি ৪০ লাখ টনের বেশি পণ্য আমদানি হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। আমদানির বিপরীতে ১৩ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা অগ্রিম কর (এটি) আদায় করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে হাজার ২৯২ কোটি টাকা বাণিজ্যিক আমদানিতে বাকি হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা বন্ড সুবিধায় আনা পণ্যের বিপরীতে আগাম কর হিসেবে আদায় হয়েছে। আমদানি পর্যায়ে ২০১৯-২০ আর্থিক বছরে অগ্রিম ব্যবসায় ভ্যাট (এটিভি) উঠিয়ে শতাংশ অগ্রিম কর বসানো হয়েছে এনবিআরের পক্ষ থেকে। আমদানিকারকের পরবর্তী সময়ে যথাযথ হিসাব কাগজপত্র দাখিল করে অর্থ ফেরত পাওয়ার সুযোগ থাকলেও আমদানিকারকরা বলছেন অগ্রিম পরিশোধ করা অর্থ সময়মতো আর ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না।

আসন্ন বাজেটকে সামনে রেখে আগাম কর প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়ে এককভাবে শিল্প প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি দাবি জানাচ্ছে বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়িক সংগঠনগুলোও। অর্থ মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে নিয়ে প্রতিনিয়ত আবেদন করা হচ্ছে ব্যক্তি পর্যায় খাতভিত্তিক অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে।

ইস্পাত খাতের পক্ষ থেকে এনবিআরে দেয়া চিঠিতেও ইস্পাত খাতের সব আমদানি পণ্যের ওপর আরোপিত শতাংশ অগ্রিম কর অব্যাহতি চাওয়া হয়েছে। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত সেক্টরের মধ্যে অন্যতম হবে ইস্পাত খাত। স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতেও শিল্পটির দীর্ঘ সময় প্রয়োজন। বছরের মার্চ এপ্রিলেই ইস্পাত খাতে সম্ভাব্য লোকসানের পরিমাণ প্রায় হাজার কোটি টাকা। পরিস্থিতি চলমান থাকলে বছর শেষে খাতটিতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। করোনা-উত্তর সময়ের ইস্পাত খাতের উদ্যোক্তাদের আর্থিক দুরবস্থা প্রশমনে অগ্রিম কর প্রত্যাহার চেয়েছেন তারা।

বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসএমএ) চেয়ারম্যান আনোয়ার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মানোয়ার হোসেন প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতির কারণে যেকোনো শিল্প প্রতিষ্ঠানের পক্ষে মুনাফা অর্জন অসম্ভব। বর্তমানে ব্যবসায়ীদের পক্ষে তাদের কর্মচারী শ্রমিকদের মাসিক ভাতা অব্যাহত রাখাই কষ্টসাধ্য। অবস্থায় অগ্রিম কর অব্যাহত রাখলে অযৌক্তিক বাড়তি চাপ থাকবে। আসছে বাজেটে যৌক্তিক আবেদনটি বিবেচনায় না নিলে উদ্যোক্তাদের পুঁজি আটকে থেকে ব্যবসায়িক সক্ষমতা হারাবে খুব দ্রুত।

আসন্ন বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর নীতিতে আগাম কর অব্যাহতি চেয়েছেন জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ শিল্পের ব্যবসায়ীরা। শিল্পটির সংগঠন বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিআরএ) কর্মকর্তারা জানান, জাহাজ আমদানির ক্ষেত্রে আগে কোনো ধরনের আগাম কর দিতে হতো না। কেবল প্রতি টনে ৩০০ টাকা হারে ভ্যাট পরিশোধ করতে হতো। কিন্তু পরে নতুন ভ্যাট আইনে শিল্পে জাহাজের মোট মূল্যের শতাংশ আগাম কর আরোপ করা হয়, যা আমদানির সময় পরিশোধ করতে হয়। আগাম কর পরবর্তী সময়ে সমন্বয় ফেরত দেয়ার বিধান থাকলেও তা ফেরত পাচ্ছেন না শিল্প মালিকরা। সর্বোচ্চ ছয় মাসের মধ্যে আগাম কর ফেরত দেয়ার বিধান থাকা সত্ত্বেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে একটি টাকাও ফেরত পাননি। ফলে ব্যবসায়ীদের মূলধন ঘাটতি অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত সরকারের কাছে ২৩৮ কোটি টাকা ফেরত পাওয়ার কথা চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।

বিএসবিআরএর নির্বাহী সদস্য পিএইচপি ফ্যামিলির পরিচালক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম রিংকু বণিক বার্তাকে বলেন, চলমান করনীতিতে শতাংশ অগ্রিম কর ধার্য করায় খাত থেকে সরকারের কোষাগারে অর্থ পেয়েছে কম। পুরনো জাহাজ আমদানি কমেছে। সার্বিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যেখানে তারল্যের ব্যাপক সংকট, সেখানে আগাম কর আদায় করার ফলে একদিকে যেমন ব্যবসায়ীদের সুদ বাড়ছে, অন্যদিকে মূলধন সংকট তৈরি হয়েছে। অগ্রিম কর পরবর্তী সময়ে সমন্বয় ফেরত দেয়ার বিধান থাকলেও তা ফেরত পাচ্ছেন না শিল্প মালিকরা।

চলমান সংকট কাটাতে পুঞ্জীভূত অগ্রিম করের টাকা দ্রুত ফেরত বা ছাড় করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতে এনবিআরের চেয়ারম্যানকে অনুরোধ জানিয়েছেন সিমেন্ট খাতের উদ্যোক্তারাও। সরকারের কাছে পুঞ্জীভূত ৭৫০ কোটি টাকা ফেরত চেয়েছেন তারা। সম্প্রতি বিষয়ে বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) পক্ষ থেকে এনবিআরের কাছে দেয়া চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, সিমেন্ট কোম্পানিগুলোর ব্যবসা করার ক্ষমতা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। পরিস্থিতিতেই নভেল করোনাভাইরাস সিমেন্ট শিল্পে বড় ধরনের আঘাত হেনেছে। গত বছরের এপ্রিলের তুলনায় বছরের এপ্রিলে দেশব্যাপী সিমেন্ট বিক্রির পরিমাণ ৪৬ শতাংশ কমেছে। সব সিমেন্ট কোম্পানির সম্মিলিতভাবে ৭৫০ কোটি টাকারও বেশি অসমন্বিত অগ্রিম আয়কর সরকারি কোষাগারে জমা রয়েছে। যদি ১০ শতাংশ হারে সুদ বিবেচনায় নেয়া হয়, তাহলে শুধু সুদ হিসেবে প্রতি বছর ৭৫ কোটি টাকা হারাচ্ছে সিমেন্ট খাত।

এফবিসিসিআইয়ের সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ আমিরুল হক প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, অগ্রিম করের কারণে চলতি মূলধন আটকে থাকছে, যা ব্যবসার ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান আরো পিছিয়ে পড়ছে। কোনো দেশে এভাবে ব্যবসায়ীদের পুঁজি আটকে রাখার নজির নেই। ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করেন, তার বিপরীতে মোটা অংকের সুদ গুনতে হয়। এত বিপুল অংকের টাকা সরকারের কাছে আটকে থাকার কারণে একদিকে সুদ বাড়ছে, অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের মূলধনে টান পড়ছে। আগাম কর কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস বা ইজ অব ডুয়িং বিজনেসের পরিপন্থী।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন