‘শিল্পীদের অস্তিত্ব, কার্যক্রম নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে’

কভিড-১৯ মানুষের ব্যক্তিগত জীবনযাপন থেকে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম সবকিছু নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। করোনার কারণে সংকটে পড়েছে দেশের ভিজুয়াল আর্ট ইন্ডাস্ট্রিও। এখন শিল্পকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে শিল্পীদের। করোনাকালে তার ব্যক্তিগত শিল্পচর্চার পাশাপাশি করোনা মহামারী শিল্পের বিবর্তনে কেমন ভূমিকা রাখবে এমন সব বিষয়ে টকিজের কথা হয় শিল্পী ওয়াকিলুর রহমানের সঙ্গে। আলাপ করেছেন রাইসা জান্নাত

করোনাকালে আপনার জীবনযাপন সম্পর্কে বলুন।

প্রায় দুই মাস ধরে সেলফ আইসোলেশনে (স্বেচ্ছা সঙ্গনিরোধ) আছি। এখন সরকারিভাবে কিছু জিনিস উন্মুক্ত হয়েছে। মানসিকভাবে এটা একটা নতুন পরিস্থিতি। প্রথম দিকে ঘরে থাকতেই হবে রকম বাধ্যবাধকতা ছিল। সেভাবে সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছিলাম। এখন মানসিকভাবে একটু নড়বড়ে আছি। বিগত জীবনযাপনের মাধ্যমে সঞ্চিত স্মৃতিগুলো আবার নাড়াচাড়া দেয়া শুরু করেছে। পেশাদারিত্ব, অর্থনীতিএসব নিয়ে টানা দুই মাস এক ধরনের ভাবনা ছিল। ভাবনাগুলোও এখন নড়বড়ে। বুঝতে পারছি না কী করা উচিত।


ঘরবন্দি সময়টাতে আপনার শিল্পচর্চা নিয়ে জানতে চাই।

প্রথমে যে জায়গায় নিজেকে আইসোলেশন করি, সেখানে সচেতনভাবেই কোনো শিল্পোপাদান ছিল না। কারণ আমার স্টুডিও আছে। প্রথম থেকেই চিন্তা ছিল, হাতের কাছে যে উপাদানগুলো আছে তা দিয়েই কিছু না কিছু করার। আর ডিজিটালি কিছু কাজের প্রবণতা আগে থেকেই ছিল। কিন্তু এতদিন পর একটা বিষয় লক্ষ করলাম যে কাজের মধ্যে এক ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। প্রথমে ড্রয়িং অন ল্যান্ডস্কেপ নিয়ে কিছু কাজ শুরু করি। ঘরের কিছু জায়গা ফাঁকা করে। আর প্রকাশ করি সামাজিক মাধ্যমে। পরে দেখি আর্কিটেকচারাল স্পেস গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। তখন কিছু থ্রি-ডাইমেনশনাল অবজেক্ট নিয়ে কাজ করি এবং এক ধরনের নতুন অনুভূতি পাই। তারপর ঘরের অনেক স্পেস নিয়ে কাজ করি। এরপর দেখি বিভিন্ন বস্তু ভিন্ন মাত্রায় হাজির হচ্ছে। সেগুলো গুছিয়ে কিছু কাজ করলাম। যেমনসুটকেস, জুতা, সাবান ইত্যাদি। এখন দুই মাস ধরে যে কাজগুলো করলাম, সেগুলোকে একত্র করে একটা ন্যারেটিভ বলা যায় কিনা, ধরনের কাজের চেষ্টা করছি।

কাজের প্রসঙ্গ ধরেই বলছি, কভিড-১৯ আপনার শিল্পকর্মের ওপর কোনো ধরনের প্রভাব বা নতুন কোনো অনুপ্রেরণা তৈরি করেছে কিনা?

একটা নির্দিষ্ট জায়গায় থেকে একটা বিশেষ সময়ে এভাবে কখনো কাজ করিনি। এটা আমার জন্য বড় অভিজ্ঞতা। প্রথমত, কনসেনট্রেট একটা সময়, একটা অভিজ্ঞতা কীভাবে আর্ট ওয়ার্ক হতে পারে। দ্বিতীয়ত, হাতের কাছে যা আছে তা দিয়ে কতটুকু কাজ করা সম্ভব। এগুলোকে কীভাবে প্লেসমেন্ট করলে বিশেষ হয়ে ওঠে। এখানে একটা সংজ্ঞা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। আর্ট আর কিছুই না, একটা জিনিসকে বিশেষভাবে দেখানো। এতে যে অর্থ অভিজ্ঞতা তৈরি হয় আমার মতে, সেটাও আর্টের একটা সংজ্ঞা। তৃতীয়ত, বস্তুর বিষয়ে অনেক সচেতন হয়েছি। কেননা প্রতিটি বস্তুরই টাইম, ম্যাটেরিয়াল, কালচারাল কনটেক্সট আছে। বস্তুর বিভিন্ন প্রকাশভঙ্গি অর্থ তৈরি স্মৃতিকে স্পর্শ করার জন্য যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা দুই মাসে নিজের কাজের মধ্য দিয়ে বুঝতে পেরেছি। কাজগুলোকে আমি কনসেপচুয়াল ইন্টারপ্রিটেশন বলতে পারি।


করোনাকালে ভিজুয়াল আর্টের ক্ষমতা...

কিছু কিছু শিল্প সময় মানুষকে নতুন অভিজ্ঞতা দিয়েছে। এর মধ্যে চলচ্চিত্র, সাহিত্য সংগীতের কথা বলা যায়। ভিজুয়াল আর্ট আমার কাছে সবসময় অভিজ্ঞতার মনে হয়। রঙ, ফর্ম, টেক্সচার, সাইজ, ভলিউমসবকিছু মিলে নির্দিষ্ট উপস্থাপনার মাধ্যমে আমরা এটাকে উপভোগ করি। কিন্তু রকম একটা পরিস্থিতিতে ঘরে থেকে এর মাধ্যমে যোগাযোগ করা নিয়ে আমার সন্দেহ তৈরি হয়। প্রযুক্তিগতভাবে আর্ট মানুষের কতটুকু কাছাকাছি যেতে পারে? এর মাধ্যমে কিছু তথ্য হয়তো আমরা দিতে পারি। এর বেশি কিছু নয়। নতুনভাবে এগুলো নিয়ে ভাবছি। এক ধরনের সীমাবদ্ধতাও অনুভব করছি, আবার নতুন কিছু ধারণারও।

ভিজুয়াল আর্ট একটা ইন্ডাস্ট্রি। করোনা-পরবর্তী সময়ে এর চেহারাটা কেমন হতে পারে বলে মনে করছেন?

এখানে কিছু প্রশ্ন চলে আসে। আমি কলাকেন্দ্র আর্ট গ্যালারি চালাই। এর মাধ্যমে বিষয়টি বুঝিয়ে বলছি। প্রথমত, যদি আমি গ্যালারি উন্মুক্ত করি, যে কাজগুলো আগে করতাম, সেগুলোর সঙ্গে দর্শকদের সম্পর্ক রয়েছে। প্রদর্শনী করলে শিল্পীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। শিল্পীরা নিজস্ব কিছু আগ্রহের কারণেই আমাদের সঙ্গে কাজ করেন। এখন আগামী ছয় মাসে শিল্পীদের আগ্রহগুলো কাজ করবে কিনা? ধরে নিই, শিল্পীর আগ্রহ আছে। প্রদর্শনী করলাম। আমরা অবশ্যই চাইব এটার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হোক, দর্শক আসুক। প্রচারণা বেচাকেনা হোক। ধরনের কাজের মাধ্যমে সমাজে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি হোক। এটাকে কেন্দ্র করে আলোচনা এবং সেখানে অনেক মানুষ উপস্থিত থাকুক। কিন্তু আগামী ছয় মাস আমরা ধরনের মানুষ পাব কিনা? দ্বিতীয়ত, ধরনের কাজ না থাকলে আমি গ্যালারিতে গিয়ে কী করব? প্রোগ্রাম না হলে আমি জায়গাটা রাখব কিনা? কারণ আমাকে তো ভাড়া গুনতে হবে। লাইভ আলোচনা করে অনুষ্ঠানগুলো সফল করা যাবে না। কাজেই সব মিলিয়ে আমাদের অস্তিত্ব, কার্যক্রম নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।


আমার শেষ প্রশ্ন, করোনা কি কনটেম্পোরারি আর্টের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন ঘটাচ্ছে?

হ্যাঁ। সমাজের ধরনের প্রতিটি পরিস্থিতিতে শিল্পীরা প্রতিক্রিয়া জানায়। আমরা একদিকে ব্যক্তিগত সামষ্টিক অভিজ্ঞতার প্রকাশ করি। অন্যদিকে এটা একটা বড় শিল্প। মার্কেট, ভোক্তা, অর্থনীতি, গ্যালারি, সমালোচক, কিউরেটরআরো অনেক কিছু যুক্ত থাকে। পুরো প্রক্রিয়াটার মধ্যে পরিবর্তন ঘটবে সেটা বুঝতে পারছি আমরা। আরেকটি বিষয় হলো, কনটেন্ট। শিল্পীরা কী করছে, করবে? আমি কিছু জিনিস পর্যবেক্ষণ করেছি। দেশে কনটেম্পোরারি আর্ট বলতে আমরা যা বুঝি, সেখানে তরুণ প্রজন্ম ইস্যুটা নিয়ে কাজ করছে। কিন্তু কী কাজ করছে? এখানে আমার একটু সমস্যা আছে। যে তথ্যগুলো নিয়ে তারা কাজ করছে, এর সঙ্গে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সম্পর্কটা কী? একটা উদাহরণ দিই, করোনার যে মোটিফ আমরা আঁকছি, সেটা কিন্তু কেউ দেখিনি। এটা একটা মাইক্রোস্কোপিক অভিজ্ঞতা। এর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনো অভিজ্ঞতা নেই। ভয় আছে। তো ইমেজ তৈরিতে কী ধরনের তথ্য দিচ্ছি আবহ তৈরি করছি, এগুলোর সঙ্গে সমসাময়িকতার একটা গুরুত্ব আছে। একটা কাজ সমসাময়িক হয়ে ওঠার জন্য সমসাময়িক চিন্তা, অভিজ্ঞতার সঙ্গে কতটুকু সম্পৃক্ত, সে জায়গা থেকে খুব কম শিল্পী পর্যবেক্ষণ করছেন বলে মনে হচ্ছে। আমার মতে, শারীরিক বুদ্ধিবৃত্তিক অভিজ্ঞতা ছাড়া কনটেম্পোরারি আর্ট মুশকিলের ব্যাপার। আমার মনে হচ্ছে, করোনা নিয়ে যে সমসাময়িক কাজ, তার জন্য আরো অপেক্ষা করতে হবে।

 

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন