আলোকপাত

অর্থনীতি কি ফিরবে আগের অবস্থায়?

ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, ড. ইসমত আরা বেগম

মুসলিম উম্মাহর যে দুটি ঈদ উৎসব, তার মধ্যে দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর ঈদুল ফিতর অন্যতম। ১৫ রোজার পর থেকে সবাই চাঁদ রাতের জন্য অপেক্ষা করে। চাঁদ রাতে কবি নজরুল ইসলামের রমজানের এই রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ বেজে ওঠে চারদিকে। চাঁদ না দেখেও রেডিও-টিভিতে সংগীত শুনে সবাই বুঝে নেয় ঈদের আগমনী বার্তা। ঈদের দিন নতুন কাপড় পরে নামাজ পড়া, কোলাকুলি করা, নামাজ শেষে মৃত স্বজনদের কবর জিয়ারত ভালো খাবার গ্রহণ করার মাধ্যমে দিনটি উত্যাপন করা হয়। সাধ্যমতো গরিবের হক জাকাত প্রদান করা হয়। ধনী-গরিব নির্বিশেষে দিনটিতে সবাই সবার সঙ্গে ভাব বিনিময় করে আনন্দ ভাগ করে নেয়। আগে কেবল কাপড়চোপড় উপহার হিসেবে দেয়ার রেওয়াজ থাকলেও দশক ধরে জুয়েলারি ইলেকট্রনিক উপহার হিসেবে দেয়ার রেওয়াজ ব্যাপক বেড়েছে। ঈদ সামনে রেখে ঈদ বাজেট হয়, অর্থনীতি পায় ভিন্ন রূপ। করোনাকালীন ২০২০-এর ঈদ অর্থনীতি কেমন ছিল?

ঈদ উৎসবে পরিবহন খাতে প্রচুর অর্থের প্রবাহ হয়। যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবমতে ঈদ উৎসবে ৯০ লাখ থেকে এক কোটির মতো মানুষ ঢাকা ছেড়ে গ্রামে বা অন্য শহরে বাবা-মা আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে ঈদ করতে যায় আর সব মিলিয়ে সাড়ে তিন কোটিরও বেশি মানুষ যাতায়াত করে। তাতে গ্রামীণ অর্থনীতিসহ অন্য শহরের অর্থনীতিও চাঙ্গা হয়। পরিবহন ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকসহ বাস, ট্রাক, ট্রেন, অটোরিকশা, মাইক্রোবাসের দুরন্ত ছুটে চলার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অর্থের প্রবাহ হয়। অবশ্য ছুটে চলা অনেকের জীবনও কেড়ে নেয়। এবার সরকারি বিধিনিষেধ করোনা সংক্রমণের ভয় থাকায় গ্রামে বা অন্য শহরে বাবা-মা আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে অনেকে ঈদ করতে পারেনি।

টুপি, রুমাল, আতর, খাদ্যদ্রব্য, নতুন কাপড়, জুতা, জুয়েলারি, ইলেকট্রনিকস দ্রব্যাদি ক্রয়, সিনেমা হল, পার্ক, পর্যটন, চিড়িয়াখানা বেড়ানোসহ অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠান যেমনবিয়ে, নতুন বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীর শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে যাওয়া ইত্যাদি কারণে স্থানীয় অর্থনীতিতে অর্থের চক্রাকার প্রবাহ সৃষ্টি হয়। দোকান মালিক সমিতির মতে ঈদের সময় কাপড়চোপড়ের খুচরা বিক্রয় - হাজার কোটি টাকা। ফ্যাশন উদ্যোক্তা সমিতি বাংলাদেশের তথ্যমতে দেশে পাঁচ হাজারের মতো ফ্যাশন বুটিক দোকান আছে। কয়েক বছর ধরে তাদের দেশব্যাপী বিক্রির পরিমাণ ২৫-৩০ হাজার কোটি টাকা। প্রতি বছর প্রায় শতাংশ করে তাদের বিক্রি বেড়েছে। করোনা সংক্রমণের ভয়ের পাশাপাশি আয় কমে যাওয়া, আয়হীন হয়ে যাওয়া কিংবা ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার কারণ ভেবে অনেকেই কেনাকাটা করা থেকে বিরত থেকেছে। করোনাকালীন এসব খাতের উৎপাদন বিপণনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ২৫ লাখ লোকের একটা বড় অংশ তাদের আয় হারিয়েছে। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির হিসাব মতে ২০১৬ সালে আরএমজি খাতে বিক্রি হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা, যা ২০২০ সালে বেড়ে সাড়ে ৪২ হাজার কোটি টাকা হওয়ার কথা। ঈদ উৎসবে বাইরে থেকে আসা রেমিট্যান্স সরকারি-বেসরকারি খাতের প্রাপ্ত ঈদ বোনাস ব্যয় করা হয়। করোনার সময়ে রেমিট্যান্স বোনাস থাকলেও ঈদের কেনাকাটা তেমন হয়নি। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ অনেক জায়গার তথ্য নিয়ে জেনেছি, এবার তা হয়তো ১০ ভাগের ভাগ হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোকান খোলার অনুমতি থাকলেও অনেক শপিংমল যেমনযমুনা ফিউচার পার্ক, বসুন্ধরা, নিউমার্কেটসহ বড় দোকানগুলো বন্ধ ছিল। রাস্তার পাশের দোকানগুলোও ছিল প্রায় বন্ধ, কেননা এসব দোকানের ক্রেতা মূলত নিম্ন বা নিম্নমধ্যবিত্ত আর এসব ক্রেতা করোনার আকস্মিক প্রভাবে এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গিয়েছে। পিপিআর বিআইজিডির এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে শহরের মানুষের আয়-রোজগার কমেছে ৭৫ শতাংশ  গ্রামের ৬২ শতাংশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, কাজ হারিয়ে দরিদ্র হয়ে পড়েছে কোটি ৬৯ লাখ ৮৮ হাজার মানুষ। সব মিলিয়ে সাত কোটি দরিদ্র মানুষ করোনার কারণে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। ফলে রাজধানীসহ বিভাগীয় জেলা শহরের রাস্তার পাশে গড়ে ওঠা অস্থায়ী দোকানগুলোর ক্রেতা নেই। ছোট ছোট দোকান শ্রমিক আজ কর্মহীন, নেই জীবিকা নির্বাহের জন্য ন্যূনতম আয়।

বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে ২০১৪ সালে দুই ঈদে খুচরা বিক্রি হয়েছে ৭৭ দশমিক ৩৫ হাজার কোটি থেকে ৯২ দশমিক ৮৫ হাজার কোটি টাকা। দেশে গত কয়েক বছর আয় বাড়ার পাশাপাশি মানুষের ভোগের প্রবণতাও বেড়েছে। ২০১৪-১৯ পর্যন্ত সময়ে মোট আয়ের হিসাবে দেশের অর্থনীতির আকার বেড়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ। দোকান মালিক সমিতির হিসাব মতে প্রাত বছর শতাংশ বাড়লেও ২০১৯ সালে তার পরিমাণ ছিল ৯৮ দশমিক ৭২ থেকে ১১৮ দশমিক হাজার কোটি টাকা এবং ২০২০ সালে হওয়ার কথা ১০৩ দশমিক ৬৬ থেকে ১২৪ দশমিক ৪৩ হাজার কোটি টাকা, কিন্তু করোনার কারণে তা হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মতে রোজার মাসে রোজা ঈদকে কেন্দ্র করে বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় খুচরা লেনদেন বেড়ে যায় প্রায় ১০ গুণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০১৬ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, কেবল রোজার মাসে লেনদেন হয়েছে ৭০ হাজার কোটি টাকা। প্রতি বছর শতাংশ বেড়ে ২০২০- দাঁড়ায় প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা, যার হয়তো সামান্য লেনদেন হয়েছে করোনাকালীন ঈদ উৎসবে। যদি করোনাকালীন সময়ে তা ১০ শতাংশ হিসাবে হাজার ৫০০ কোটি টাকা আর ২০ শতাংশ হিসাবে ১৭ হাজার কোটি টাকা। অবশ্য বছর অন্য বছরের তুলনায় অনলাইন বা -কমার্স প্লাটফর্মে বিক্রির পরিমাণ বেড়েছে।

ঈদের আগে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আসে। বিদেশে এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশীর মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশ মধ্যপ্রাচ্যে, যার শতভাগই ঈদের সময়ে প্রয়োজনে অন্যদের কাছ থেকে ধার করে হলেও দেশে পরিবারের কাছে টাকা পাঠায়। ২০১৯ সালে ঈদের আগে মে মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৭৪ কোটি ৮২ লাখ ডলার, যা ২০২০ সালের করোনাকালীন সময়ে (২২ মে পর্যন্ত) কমে এসেছে ১১২ কোটি ডলারে।

বিজনেস পোস্টের তথ্য অনুযায়ী ফুটওয়্যার খাতের বার্ষিক টার্নওভার - হাজার কোটি টাকার মধ্যে ঈদে আসে হাজার থেকে হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ফুটওয়্যার খাতের উৎপাদন বিপণনে ১০-১২ লাখ লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। এপেক্স ফুটওয়্যারের তথ্যমতে মোট বিক্রির প্রায় ৩০ শতাংশ আসে ঈদ মৌসুমে। পাদুকা প্রস্তুতকারক সমিতির তথ্যমতে করোনার কারণে এবার ঈদ মৌসুমে তাদের ক্ষতি হয়েছে হাজার ৫০ কোটি টাকা।

ঈদ উৎসবে মানুষ খাবারের পাশাপাশি অন্যান্য খাতেও অর্থ ব্যয় করে। ঈদের দিন ঈদের পর বেশ কয়েক দিন পর্যন্ত চিড়িয়াখানা, পার্ক, সমুদ্রসৈকতে পর্যটকদের ভিড় হয়। সিনেমা হলে যাওয়া কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠান যেমনবিয়ে অথবা শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে যাওয়া, খতনা ইত্যাদি অনুষ্ঠান প্রচলিত। এতে হাজার হাজার কোটি টাকার অর্থপ্রবাহ হয়। একজনের খরচ অন্যজনের আয়। করোনার কারণে ধরনের অনুষ্ঠান নেই আর অনুষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক আজ কর্মহীনজীবিকা নির্বাহের জন্য পার করছে কঠিন সময়।

ঈদ উৎসবে আমরা বলে থাকি ধর্ম যার যার কিন্তু উৎসব সবার ধনী-গরিবের ব্যবধান পেছনে ফেলে এদিন নিয়ে আসে সাম্য, সম্প্রতি মেলবন্ধনের যোগসূত্র। পাড়ার ছোটবেলার বন্ধু যে আজ জীবন সংসার বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে আছে, সেও অপেক্ষা করে ছোটবেলার বন্ধু আসবে, আসবে পাড়ার বড় ভাই, প্রাইমারি হাইস্কুলের পুরনো ছাত্রটি, যে আজ দেশ-বিদেশ দাপিয়ে চাকরি করে বেড়াচ্ছে। অনেক আশা নিয়ে থাকে বাড়ি যাবে, দেখা হবে তার ছোট সময়ের হাতেখড়ি দেয়ার স্যারের সঙ্গে, দেখা হবে ছোটবেলার বন্ধুর সঙ্গে। চাঁদ রাত আর ঈদ রাত ঘণ্টার পর ঘণ্টা জেগে আড্ডায় অতীত রোমন্থন, বর্তমান, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় রাত পার হবে। করোনায় সবকিছু থামিয়ে দিয়েছে।

সামনে মাস ১০ দিন পর ঈদুল আজহা। গরু, মোষ, ছাগল জবাই করে আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রার্থনা করার দিন। বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে ২০১৯ সালে ঈদুল আজহায় দশমিক শূন্য কোটি গবাদিপশু জবাই করা হয়েছিল। সব মিলিয়ে ঈদুল আজহার অর্থনীতি ছিল প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে কেবল গবাদিপশু বিক্রি হয়েছিল ২৮ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকার। পিআরআইয়ের তথ্যমতে ২০১৯ সালের ঈদুল আজহার অর্থনীতির আকার ছিল ৪৫ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে গবাদিপশু বিক্রি থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা আর বাকি ১৫ হাজার কোটি টাকা ছিল পরিবহন, পর্যটন, খাদ্যদ্রব্য, রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার, ফার্নিচার, কাপড়চোপড় বিক্রি থেকে। এবার ঈদুল আজহার অর্থনীতির আকার কেমন হবে? করোনার প্রভাবে ঈদ অর্থনীতি কি ফিরবে আগের অবস্থায়?

করোনার মহামারীর সময়ে যার যার সাধ্যমতো দিনটি উত্যাপন করেছে। তালিকাভুক্ত নন বলে যারা সরকারের ত্রাণ বা অন্যান্য সহায়তা পাননি, এমন ৫০ লাখ পরিবারকে প্রধানমন্ত্রী হাজার ৫০০ টাকা করে মোট হাজার ২৫০ কোটি টাকা নগদ আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। তারা হয়তো টাকা দিয়ে ঈদের খরচ করতে পেরেছেন। সরকার তার সাধ্যমতো সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে। বাদ যায়নি মসজিদের ইমাম, খাতিব মুয়াজ্জিন। সরকারি ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনায় ঈদ অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত অনু, ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্প আবার ফিরে দাঁড়াবে। ফিরে দাঁড়াতে হবে অনানুষ্ঠানিক খাতের সবাইকে। জীবণ জীবিকার যুদ্ধে দুটির ভারসাম্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আসুন সবাই মিলে সেই দিনের স্বপ্ন দেখি, যেদিন আমরা হব করোনামুক্ত, ফিরে পাব ঈদের মতো সাম্য মেলবন্ধনের দিন, ফিরে পাব আগের ঈদ অর্থনীতি।

 

. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম: প্রফেসর, কৃষি ব্যবসা বিপণন বিভাগ পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব এগ্রিবিজনেস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

. ইসমত আরা বেগম: প্রফেসর, কৃষি অর্থনীতি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন