বিশ্ব পরিবেশ দিবস

জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ সুরক্ষায় সুশাসন

নেওয়াজুল মওলা, এম. জাকির হোসেন খান

মানুষের জন্য সবুজ পরিবেশের প্রয়োজনীয়তা এবং জীবজগৎ প্রকৃতির সুরক্ষায় জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ২৭তম অধিবেশনে প্রতি বছর জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এরপর ১৯৭৪ সাল থেকে ধরিত্রীর প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর ক্রমবর্ধমান চাপ কমিয়ে পৃথিবীকে বসবাসের উপযোগী রাখতে সক্রিয় ভূমিকা পালনে মানুষকে উৎসাহিত করতে প্রতি বছর পরিবেশ দিবস পালন করা হয়। ইন্টার গভর্মেন্টাল সায়েন্স-পলিসি প্লাটফর্ম অন বায়োডাইভার্সিটি অ্যান্ড ইকোসিস্টেম সার্ভিসেসের (আইপিবিইএস) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, কয়েক দশক ধরে প্রায় এক মিলিয়ন প্রাণী উদ্ভিদ প্রজাতি বিলুপ্তির মুখোমুখি হচ্ছে। তাই প্রতি বছরের ন্যায় এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০২০-এর মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে জীববৈচিত্র্য দিবসের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান জীব প্রজাতির বিলুপ্তি প্রাকৃতিক পরিবেশের অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়েছে। উল্লেখ্য, জীববৈচিত্র্য পৃথিবীতে প্রাণের এবং মানব উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহসহ প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় প্রধান অবদান রাখে। কিন্তু নির্বিচারে বন জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, মনুষ্যসৃষ্ট দাবানল, উপর্যুপরি একের পর ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত, পঙ্গপালের ধ্বংসাত্মক আক্রমণ এবং বিশ্বব্যাপী নির্বিচারে প্রাণের বাসস্থান ধ্বংসের ফলে বিশ্বব্যাপী কভিড-১৯ ভাইরাসজনিত মহামারীর প্রাদুর্ভাবে অসংখ্য মানুষের জীবন হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য বিশ্ববাসীর কাছে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। 

জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ১৪ ১৫-তে জীবজগতের টেকসই ব্যবহার, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, বন উজাড় রোধ করার মাধ্যমে মরুকরণ রোধ এবং ভূমিক্ষয় হ্রাসের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ রোধ পরিবেশ রক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। পাশাপাশি মানবসৃষ্ট কারণে উদ্ভূত বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় অভীষ্ট-১৩-এর সব কয়টি সূচকেই বন, মাটি পানিতে থাকা জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা এবং সংরক্ষণে পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। অভীষ্ট-- জীববৈচিত্র্যের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পানিসম্পদ খাতের সুরক্ষা প্রদানের কথা বলা হয়েছে।

জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ সংকট বৈশ্বিক পরিস্থিতি

বিশ্বব্যাপী নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংস করার কারণে বন বন্যপ্রাণী হুমকির মুখে পড়েছে। কারণে আজকের পৃথিবীর পরিবেশ প্রতিবেশ মারাত্মক ঝুঁকির সম্মুখীন। গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির তথ্যমতে, এখনই সময় মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ককে পুনর্বিবেচনা করে সব কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিবেশ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণকে অগ্রাধিকার দেয়ার। জীববৈচিত্র্য রক্ষা, প্রকৃতির সুরক্ষা নিশ্চিত করা, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস রোধে জীববৈচিত্র্য পরিবেশ সংরক্ষণ আইন বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করাসহ প্রাণ প্রকৃতি তথা জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় বিভিন্ন রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষা এবং তার বাস্তবায়নে নাগরিকদের সোচ্চার হতে হবে। একই সঙ্গে বন্যপ্রাণীসহ বনজ প্রাণিজ সম্পদ ক্রয়-বিক্রয় নিয়ন্ত্রণে ভোক্তা, নাগরিক এবং সামাজিক সংগঠনগুলোকে আরো দায়িত্বশীল হতে হবে। সর্বোপরি পৃথিবীতে মানবজাতিকে টিকে থাকতে হলে প্রকৃতিপ্রদত্ত বাস্তুতন্ত্র জীববৈচিত্র্যকে সুরক্ষা করেই বাঁচতে শিখতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে বৃদ্ধি পাওয়া নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ (ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস) আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে প্রতিবেশ ব্যবস্থা বলতে আমরা যা বুঝি, তা প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। বিভিন্ন স্থানে পঙ্গপালের আক্রমণ ফসল উৎপাদন শূন্যের কোটায় নিয়ে এসেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উষ্ণ অঞ্চলে অতিবৃষ্টি পঙ্গপালের বংশবৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। পরিবেশের ভারসাম্য সুস্বাস্থ্য রক্ষায় প্রকৃতিতে বিদ্যমান প্রতিটি প্রজাতির প্রাণী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিভিন্ন প্রজাতির বিপন্ন ব্যাঙ শামুকের বিলুপ্তি ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের এমন বিশ্বব্যাপী বিস্তারে প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। এছাড়া জীববৈচিত্র্য তাদের বাসস্থান ধ্বংসের কারণে সংক্রামক রোগ ভাইরাস খুব সহজেই বিস্তার লাভ করতে পারছে বলে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অণুজীবের বাসস্থান ব্যাপকভাবে ধ্বংসের কারণে একের পর এক ধ্বংসাত্মক ভাইরাসের জন্ম হচ্ছে, যার মধ্যে কভিড-১৯ সবচেয়ে ধ্বংসাত্মকরূপে আবির্ভূত হয়েছে।

কভিড-১৯ মহামারী মানবজাতিকে পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে পৃথিবীর স্বাস্থ্যের সঙ্গে মানবস্বাস্থ্য সম্পর্কযুক্ত। কভিড-১৯ ভাইরাস জুনোটিক অর্থাৎ এরা প্রাণীদেহ থেকে মানবদেহে সংক্রমিত হতে পারে। বর্তমান বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় এক বিলিয়ন মানুষ বিভিন্ন প্রকার জুনোসেসের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে এবং লাখ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে। মানুষকে আক্রান্ত করতে সক্ষম এসব রোগব্যাধির মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ রোগ এবং নতুন উদ্ভাবিত ৭৫ শতাংশ সংক্রামক রোগ জুনোটিক প্রকৃতির। বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে মানুষ যদি বন্যপ্রাণী তাদের বাসস্থানের প্রতি আচরণ পরিবর্তন না করে, তবে ভবিষ্যতে ধরনের ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব আরো বৃদ্ধি পাবে। ধরনের রোগ থেকে রক্ষাসহ পরিবেশ বিপন্নতা রোধে আমাদের বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল রক্ষা করা, বন্যপ্রাণী ক্রয়-বিক্রয় বিপণন বন্ধ করা, দূষণ রোধ, জলবায়ু পরিবর্তন রোধ এবং বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীর সংরক্ষণে আইনের কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিতে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

জীববৈচিত্র্য পরিবেশ সুরক্ষায় সুশাসন: বাংলাদেশের অবস্থান

বাংলাদেশ সংবিধানের ১৮() অনুচ্ছেদে প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ নিরাপত্তা বিধানের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও পরিবেশগত প্রতিপন্ন এলাকা যেমন সুন্দরবন, পায়রা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ  জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক শিল্প কারখানা নির্মাণ, ব্যাপকভাবে বন জলাশয় দখল এবং ধ্বংস, প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর ক্রামাগত চাপ এবং অনিয়ন্ত্রিত বায়ু মাটিদূষণ বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য পরিবেশ রক্ষায় বড় হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে।

গত কয়েক দশকে জনসংখ্যার চাপ, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, উন্নয়ন কার্যক্রম, নির্বিচারে বৃক্ষনিধন, বনজ সম্পদ আহরণসহ নানা কারণে বাংলাদেশে বনভূমির পরিমাণ ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে। বাংলাদেশ বন অধিদপ্তরের হিসাব মতে, দেশের মোট ভূমির ১৭ দশমিক শতাংশ বনভূমি হিসেবে চিহ্নিত থাকলেও প্রকৃত বন আচ্ছাদিত বনভূমির পরিমাণ আট ভাগের বেশি নয়। পরিবেশ, বন জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ১৯৮৯ সালের পর থেকে পর্যন্ত দেশে মোট লাখ ১৬ হাজার ২৫৬ একর বনভূমি ধ্বংস করা হয়েছে, যার মধ্যে লাখ ৫৮ হাজার ৩১ হেক্টর বনভূমি বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি সংস্থার নামে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে এবং লাখ ৬৮ হাজার ২৫৬ একর বনভূমি জবরদখলের শিকার হয়েছে। ক্রমবর্ধমান এবং অনিয়ন্ত্রিতভাবে বনভূমি ধ্বংসের কারণে এরই মধ্যে বন্যপ্রাণীর ৩৯টি প্রজাতি বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ আরো প্রায় ৩০ প্রজাতির অস্তিত্ব মারাত্মক সংকটে রয়েছে, যা ক্রমে বনকেন্দ্রিক জীবনচক্র বাস্তুসংস্থানের জন্য অশনিসংকেত। জাতীয় আন্তর্জাতিক আইনসহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্যারিস চুক্তি লঙ্ঘন করে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের সন্নিকটে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে অন্যতম নিয়ামক প্রাকৃতিক রক্ষাকবচকে স্থায়ীভাবে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা হচ্ছে। অথচ সুন্দরবন যেমন সমৃদ্ধ জীবজগেক ধারণ করে প্রাণ প্রকৃতির রসদ জোগাচ্ছে, তেমনি সাম্প্রতিককালে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু, ফনীসহ সর্বশেষ আম্পানের তাণ্ডব থেকে উপকূলের কোটি কোটি মানুষের জীবন জীবিকা সুরক্ষা করেছে।

শুধু তাই নয়, বনভূমি ধ্বংসের পাশাপাশি দেশের পরিবেশ আইন, ১৯৯৫ লঙ্ঘন করে নির্বিচারে শিল্পায়ন বিভিন্ন শিল্প বিশেষ করে ডায়িং কারখানা ট্যানারিগুলোর শিল্পবর্জ্য নদ-নদী, খাল-বিলসহ প্রাকৃতিক উন্মুক্ত জলাধারগুলোয় নিক্ষেপণের মাধ্যমে দেশের প্রাকৃতিক জলাধার বা জলজ জীববৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে বিনষ্ট করা হচ্ছে। জলাধারগুলো অবৈধ দখল এবং সংলগ্ন স্থানে অপরিকল্পিত বসতি স্থাপনা নির্মাণের ফলে মাছ বিভিন্ন জলজ প্রাণী উদ্ভিদের আবাসস্থল ধ্বংসসহ জলজ জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এরই মধ্যে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন অনৈতিক উপায়ে দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ প্রাকৃতিক জলাধার (নদ-নদী, খাল-বিল, হাওড় এবং অন্যান্য জলাশয়) বেদখল করা হয়েছে। একই সঙ্গে জাহাজ ভাঙাসহ সমুদ্রের পাড়ে গড়ে ওঠা অবৈধ শিল্প থেকে নিক্ষিপ্ত বর্জ্য প্লাস্টিক দূষণ সামুদ্রিক মাছ সমুদ্রের অভ্যন্তরের জলজজীবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এতে এরই মধ্যে ২১ প্রজাতির মাছ বিপন্নের তালিকায় যুক্ত হয়েছে। এছাড়া নির্বিচারে ডলফিনসহ জলজ প্রাণী হত্যা এবং সরকারি বিধিনিষেধ অমান্য করে মা-মাছ শিকারের কারণে দুই দশক আগে বাংলাদেশের জলাশয়গুলোয় মাছের যে বৈচিত্র্য ছিল, তার মধ্যে অনেকগুলোই বিলুপ্ত অথবা হুমকির মুখে রয়েছে। 

বন জলজ বাস্তুসংস্থানের ওপর অভিঘাতের সঙ্গে সাম্প্রতিক কয়েক দশকে বাংলাদেশে বায়ুদূষণ মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে এবং বাংলাদেশের রাজধানী দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানীয় তালিকায় উঠে এসেছে। স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর বায়ুদূষণজনিত কারণে প্রায় লাখ ২৩ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে এবং অসংখ্য মানুষ ফুসফুস ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়া বায়ুদূষণের ফলে পশু-পাখির খাদ্য সংগ্রহ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। পাশাপাশি কীটনাশকসহ অজৈব সারের যথেচ্ছ ব্যবহারে মাটির উর্বরা শক্তি রক্ষাকারী প্রাকৃতিক অনুজীবসহ শস্য সবজির ওপর নির্ভরশীল খাদ্যশৃঙ্খলের বিভিন্ন পাখি প্রাণী আশঙ্কাজনক হারে মরার কারণে মানুষের জীবন টেকসই জীবিকার ওপর হুমকি ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।

বাংলাদেশে পরিবেশ রক্ষায় প্রয়োজনীয় আইনি কাঠামো থাকা সত্ত্বেও কঠোর প্রয়োগ না করার কারণে জীববৈচিত্র্য যেমন লোপ পাচ্ছে, তেমনি পরিবেশ দূষণ না কমে বরং ক্রমেই আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। উল্লেখ্য, এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেক্স (ইপিআই)-২০১৮ অনুযায়ী, ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৯তম, অর্থাৎ পরিবেশ দূষণ রোধে ব্যর্থ দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। পরিবেশ সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের ঘাটতি, বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক আইনি ব্যবস্থার দুর্বলতা তার অপপ্রয়োগ, দুর্বল তদারকি, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোয় দুর্নীতি অনিয়মে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বাংলাদেশে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস পরিবেশ দূষণ সমস্যার উল্লেখযোগ্য কারণ।

বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০২০: এখনই সময় পরিবেশ জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের

পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশ দূষণ রোধে বিশেষ করে জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা, বায়ুদূষণ রোধ, প্রাকৃতিক পানির উৎস সংরক্ষণ এবং টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে দেশব্যাপী নাগরিকদের সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি খাতগুলোয় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, নাগরিক অংশগ্রহণ শুদ্ধাচার নিশ্চিতে এখনই সময় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের। প্রথমত, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ নিরাপত্তা বিধানের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুসারে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সদিচ্ছার প্রকাশ ঘটিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইন, ১৯৯৫-এর কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে বনভূমি, নদী, জলাশয় জলমহালের অবৈধ ব্যবহার দখলের সঙ্গে জড়িতদের যথাযথ প্রক্রিয়ায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে এবং পরিবেশ দূষণ রোধসংক্রান্ত আইনের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন, ২০১৭-এর কার্যকর প্রয়োগ এবং জীববৈচিত্র্য বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের তদারকি জোরদার করতে হবে। দ্বিতীয়ত, অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (২০২০-২৫) প্রকৃতি জীববৈচিত্র্যকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে সব পরিকল্পনা প্রণয়ন বাস্তবায়ন করতে হবে এবং বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন, ২০১৭-এর পরিপ্রেক্ষিতে একটি জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ তহবিল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তৃতীয়ত, জাতীয় পরিবেশ নীতি, ২০১৮ যথাযথভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে পরিবেশ প্রতিবেশ ব্যবস্থার ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণ ক্ষতিপূরণ আদায়ে ক্ষতিকারক কর্তৃক ক্ষতিপূরণ প্রদান প্রয়োগ করে পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ (দূষণ কর) আদায় করতে হবে। চতুর্থত, প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিতে পরিবার প্রাতিষ্ঠানিক সব ক্ষেত্রে সম্পদের ব্যবহার হ্রাস, পুনর্ব্যবহার পুনর্চক্রায়ন নীতি (3R principle: reduce, reuse and recycle) বাস্তবায়ন করতে হবে। পঞ্চমত, পরিবেশ রক্ষার অপরিহার্য অনুষঙ্গ বন জীববৈচিত্র্য রক্ষায় নির্ভরযোগ্য, দক্ষ এবং স্বার্থের দ্বন্দ্ব নয়, এমন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যেকোনো অবকাঠামো উন্নয়ন, বিশেষ করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনসংশ্লিষ্ট প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়নসাপেক্ষে অনুমোদন করতে হবে। ষষ্ঠত, টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতে জীববৈচিত্র্য রক্ষা, পরিবেশ দূষণ জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত যেকোনো কার্যক্রম বা প্রকল্প প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে ক্ষতিগ্রস্ত ঝুঁকির সম্মুখীন জনগোষ্ঠী বিশেষ করে নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং আদিবাসীদের ব্যাপক কার্যকর অংশগ্রহণ, তাদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং প্রাণ প্রকৃতির সুরক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অগ্রাধিকার প্রদানে জবাবদিহিতা শুদ্ধাচার নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট নাগরিক সমাজ, বিশেষজ্ঞসহ সব অংশীজনের ধারাবাহিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

 

লেখকদ্বয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় পরিবেশ জলবায়ু অর্থায়ন বিষয়ে গবেষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন