দেশে পতিত জমি ১১ কোটি একর

খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে চাষযোগ্য জমির পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার করতে হবে

নভেল করোনাভাইরাসের প্রকোপে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় বিশ্বব্যাপী খাদ্যনিরাপত্তা চরম ঝুঁকির সম্মুখীন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ভোক্তারা ঝুঁকেছেন অতিরিক্ত খাবার ক্রয়ে। অন্যদিকে মহামারীর মধ্যে নিজ দেশের জনগণকে সাশ্রয়ী মূল্যে খাবার সরবরাহের তাগিদে খাদ্যপণ্য রফতানি বন্ধ করার পরিকল্পনা করেছে বিভিন্ন দেশ। করোনা মহামারীর প্রভাবে অভ্যন্তরীণ সরবরাহ নিশ্চিতে ভিয়েতনাম চালের নতুন রফতানি বিক্রয় চুক্তি সাময়িকভাবে বন্ধ রাখে কিংবা জাতীয় খাদ্যনিরাপত্তা সুনিশ্চিতের লক্ষ্যে মধ্য এপ্রিল পর্যন্ত চাল রফতানি নিয়ন্ত্রণের মতো উদ্যোগ নেয়। রফতানি সাময়িকভাবে বন্ধের ঘোষণা দেয় এশিয়ার অন্যতম শীর্ষ চাল রফতানিকারক দেশ কম্বোডিয়া। মিয়ানমারও একই আভাস দেয়। অন্যদিকে অনেক দেশ আবার বাড়তি আমদানিতে মনোযোগী। নভেল করোনাভাইরাসের প্রকোপে খাদ্য সংকটের আশঙ্কায় এশিয়ার অন্যতম শীর্ষ চাল উৎপাদনকারী দেশ ফিলিপাইন পণ্যটি আমদানি বাড়াচ্ছে। নভেল করোনাভাইরাসের ধাক্কা সামলে বাজারে খাদ্যপণ্যটির সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে বছর চীনের রেকর্ড পরিমাণ চাল কেনার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশ্বজুড়ে চাল রফতানি চাহিদা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় দামও বাড়ছে। চলমান সংকটে খাদ্যদ্রব্য রফতানি সমস্যায় পড়েছে অস্ট্রেলিয়া। কৃষিজ পণ্য রফতানি করতে পারছে না আরো অনেক দেশ। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যেসব দেশের খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন পর্যাপ্ত নয়, তারা এগিয়ে যাচ্ছে আরেক সংকটের দিকে। অবস্থায় বাংলাদেশের চাষযোগ্য জমির পাশাপাশি পতিত জমিগুলো চাষাবাদের উপযোগী করে ধান অন্যান্য শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচ্য। গতকাল দৈনিক বণিক বার্তায় দেশে পতিত জমি ১১ কোটি একর শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। পতিত জমিগুলো ব্যবহার উপযোগী করার বিকল্প নেই। তাছাড়া বিদ্যমান পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে বাংলাদেশে এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি পড়ে না থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

তাই খাদ্য পুষ্টিনিরাপত্তায় চাষ্যযোগ্য জমির পাশাপাশি পতিত জমি ব্যবহারের কৌশল নির্ণয় করতে হবে। জমিগুলো উৎপাদনশীল কিনা, তা যাচাইপূর্বক ফসল উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা চাই। কেউ যদি তার নিজের জমি চাষ না করে, তবে বর্গা বা অন্য কোনো উপায় অবলম্বন করে জমিকে উৎপাদনশীল রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনার পাশাপাশি প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে হবে। জমিগুলোকে উৎপাদনশীল রাখার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনের লক্ষ্যে অগ্রসর হওয়া সময়োপযোগী পদক্ষেপ। পর্যায়ে কৃষি মন্ত্রণালয়কে পরিকল্পনা প্রণয়নের পাশাপাশি তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজে নামতে হবে। প্রতিটি জেলা উপজেলা পর্যায়ে  স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে কমিটি গঠন করে তাদের দিকনির্দেশনা দিতে হবে। পতিত জমির মধ্যে যদি খাসজমি থাকে, তাহলে ভূমিহীন কৃষকদের তা চাষাবাদের জন্য দিতে হবে। দরিদ্র কৃষককে সুদমুক্ত ঋণ প্রদানের পাশাপাশি উন্নত বীজ সার দিয়ে সহযোগিতা করতে হবে।

সরকারের আন্তরিকতা উদ্যোগের অভাব না থাকলেও ভূমিহীন   প্রান্তিক  কৃষকের কাছে অনেক সময়ই ঋণ, ভর্তুকি বা প্রণোদনা পৌঁছে না। এক্ষেত্রে  সরকারি সহায়তা বিতরণ ব্যবস্থার অস্বচ্ছতা কাটিয়ে ওঠা জরুরি। ভূমিহীন প্রান্তিক চাষীকে চাহিদা অনুযায়ী ঋণসহায়তা পৌঁছে দেয়ার জন্য দক্ষ ব্যাংকিং মেকানিজম তৈরি করা চাই। পাশাপাশি আবাদযোগ্য জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি। প্রকাশিত তথ্যমতে, দেশে তিন ফসলি জমি রয়েছে ২০ কোটি ৬২ লাখ একর এবং চার ফসলি জমি রয়েছে কোটি ৩৪ লাখ ৭১ হাজার একর। এক ফসলি জমিগুলোকে দোফসলি জমিতে এবং দোফসলি জমিগুলোকে তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর করতে পারলে শস্য উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। এক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে জমিগুলোকে সর্বোত্তম ব্যবহার করার পদক্ষেপ নিতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চরম সংকটময় সময়ে ব্রিটেনের নারীরা খাদ্যনিরাপত্তায় এক অভূতপূর্ব অবদান রেখেছিলেন। আসন্ন দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে তত্কালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের আহ্বানে প্রায় ৮০ হাজার নারী কাস্তে-কোদাল নিয়ে ফসলের মাঠে, খামারে কাজে নামেন। ব্রিটিশ ওই ল্যান্ড গার্লস দুর্ভিক্ষ চরম খাদ্যাভাব থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন তিন কোটি ব্রিটিশ নাগরিককে। এভাবে সবার সমন্বিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমাদের দেশেরও খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি ভবিষ্যতের সংকট উত্তরণ সম্ভব হবে বলে আমরা মনে করি। তাই কভিড-১৯ মহামারী খাদ্য মানবিক সংকটে পরিণত হওয়ার আগে সরকারের পাশাপাশি ব্যবসায়ী, নাগরিক সমাজ এবং বিভিন্ন সংস্থাকে দ্রুত সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

জাতিসংঘের খাদ্যনিরাপত্তা কমিটির (সিএফএস) এক প্রতিবেদন সতর্ক করে দিয়ে বলেছে যে বিশ্বজুড়ে খাদ্য সরবরাহের ওপর অনিশ্চয়তা জোরালো হওয়ায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হবে দরিদ্রতম মানুষ। সম্ভাব্য খাদ্য বিপর্যয় নিয়ে এরই মধ্যে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সংস্থা। প্রকৃতিগতভাবে আমাদের দেশ কৃষি উপযোগী অথচ প্রতি বছর প্রায় ২৫ লাখ মানুষ বাড়লেও কৃষিজমি শতাংশ বাড়ছে না। বাংলাদেশে ভূমি অনুযায়ী লোকসংখ্যা অনেক বেশি। কৃষিজমি রক্ষায় সরকারকে দ্রুত সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন বাস্তবায়ন করতে হবে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন, আবাসন অবকাঠামো নির্মাণের রাশ টেনে ধরতে হবে। কৃষিজমি বাঁচিয়ে পরিকল্পিতভাবে এসব কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করা দরকার। আমাদের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি উদ্বৃত্ত ফসল রফতানি করার অপার সুযোগ রয়েছে। লক্ষ্যে চাষযোগ্য জমির পাশাপাশি পতিত ব্যবহারযোগ্য জমিরও পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার নিশ্চিত করা চাই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন