দুই সপ্তাহে ১ কোটি ১০ লাখ নমুনা পরীক্ষা, কীভাবে সম্ভব করলো চীন

বণিক বার্তা অনলাইন

দ্বিতীয়বারের মতো নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে চরম সাহসী একটি উদ্যোগ নিয়েছিল চীন। ভাইরাসটির সংক্রমণের প্রথম উপকেন্দ্র উহান শহরের সমস্ত জনগণকে পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয় দেশটি। পুরো বিশ্ব যখন যথেষ্ট রসদের অভাবে পর্যাপ্ত পরীক্ষা করতে না পারার কারণেই সংক্রমণ বিস্তার ঠেকাতে লড়ছে, তখন মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে উহানের ১ কোটি ১০ লাখ মানুষের নমুনা পরীক্ষা করেছে চীন। 

গত ১৩ মে শুরু হয়েছে ১ জুন শেষ হয় এ দুই সপ্তাহের কর্মসূচি। এ পরীক্ষার ফলাফলে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কেবল একজন সক্রিয় রোগী পাওয়ার কথা নিশ্চিত করেছে। তবে কিছু সূত্রে এ সংখ্যা ৩০ বলেও জানা যাচ্ছে। আর উপসর্গবিহীন করোনাভাইরাস পজেটিভ শনাক্ত হয়েছে ৩০০ জন। ৫ বছরের বেশি বয়সী প্রায় সব নাগরিকের সময়ের মধ্যে নমুনা পরীক্ষা করা হয়। আর গত শুক্রবার সক্রিয় সংক্রমিত ব্যক্তি ছিল মাত্র ৫ জন।

বিশ্বব্যাপী ৬০ লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত এবং ৩ লাখ ৭৬ হাজার প্রাণ কেড়ে নিয়েছে করোনাভাইরাস। কিন্তু প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর চীন এ ব্যাপারে সাড়া দিতে ইচ্ছাকৃতভাবে দেরি করেছিল বলে সমালোচনা রয়েছে। আজ মানুষ যেভাবে সরকারকে দোষ দিচ্ছে ভবিষ্যতে যেন তাদের এমন অনাস্থা না থাকে, ব্যাপকভিত্তিক পরীক্ষার উদ্যোগ সেই চেষ্টারই অংশ বলে মনে করা হচ্ছে।

কিন্তু কীভাবে এই অসম্ভবকে সম্ভব করলো চীন? অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল বায়োসিকিউরিটির অধ্যাপক রায়না ম্যাক ইনটায়ার বলেন, চীন দেখিয়েছে যে, প্রয়োজনের সময় দ্রুততার সঙ্গে ব্যাপকভিত্তিক মানবসম্পদ ও রসদ সংগ্রহ করার সামর্থ্য তাদের রয়েছে। এটি হলো প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার সমন্বয়।

গত সপ্তাহে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং দেশের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সংস্কার এবং প্রাদুর্ভাবের শুরুতেই শনাক্ত করা ও তা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার ব্যবস্থা উন্নয়নের আহ্বান জানান। গত বৃহস্পতিবার (৩০ মে) একটি সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, যে কোনো সংক্রমণ, যখনই পাওয়া যাবে, দ্রুত সেটাকে শনাক্ত করতে হবে। তথ্য লুকিয়ে রাখার প্রবণতা বরদাশত করা হবে না।

দুই সপ্তাহের মধ্যে উহানের সব বাসিন্দার নমুনা পরীক্ষার জন্য চীন একাধিক পদ্ধতি অনুসরণ করে। এর মধ্যে সক্রিয় সংক্রমণ সন্ধান থেকে শুরু করে রক্তে অ্যান্টিবডির উপস্থিতি পর্যন্ত বেশ কয়েকটি কৌশল অবলম্বন করা হয়। গলা ও নাক থেকে সোয়াব সংগ্রহ করতে পুরো শহরের আবাসিক এলাকাগুলোতে তাঁবু খাটিয়ে অস্থায়ী শিবির স্থাপন করা হয়। 

গলা থেকে সোয়াব সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে পরীক্ষার ফল পেতে প্রায় ২০ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়েছিল উহানের স্থানীয় বাসিন্দা ঝু জিয়াংইংকে। তিনি বলেন, মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে ১ কোটি ১০ লাখ মানুষের পরীক্ষা করা অবশ্যই একটা অলৌকিক ব্যাপার! 

এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে চীন ‘ব্যাচ পরীক্ষা’ পদ্ধতি অবলম্বন করেছিল। এতে স্বাস্থ্যকর্মীরা একসঙ্গে ১০টি নমুনা পরীক্ষা করতে সক্ষম হন। এপ্রিলের শেষ দিকে ল্যানসেট মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুযায়ী, দলগত বা ব্যাচ পদ্ধতিতে পরীক্ষার মাধ্যমে অল্প কিট দিয়ে অনেকগুলো নমুনা নির্ভুলভাবে পরীক্ষা করা সম্ভব হয়। ব্যাচের ফল যদি করোনাভাইরাস পজেটিভ আসে তাহলে সবগুলো নমুনা আলাদাভাবে পরীক্ষা করতে হয়। যদিও এ পদ্ধতি এখনো অন্যান্য দেশে সেভাবে অনুসরণ করা হয়নি। 

অধ্যাপক রায়না ম্যাক ইনটায়ার বলেন, এটা এই অর্থে নির্ভুল নয় যে যদি ব্যাচের ফলাফল পজেটিভ আসে তাহলে আপনি জানতে পারবেন না এই ব্যাচের মধ্যে কার পজেটিভ। তবে দ্রুত পরীক্ষার জন্য এটি একটি চমৎকার পদ্ধতি হতে পারে।

এ ব্যাপারে উহান ঝোংনান হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটের (আইসিইউ) পরিচালক পেং ঝিয়ং বলেন, সংক্রমণের হার ১ শতাংশের নিচে হলেই কেবল এ পদ্ধতি কার্যকর। মানুষের মধ্যে সংক্রমণের হার যদি উহানের আগের মতো হতো, তাহলে এ পদ্ধতিতে ব্যয় অনেক বেড়ে যেত। ফলে অন্যান্য দেশে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা যাবে না।

উহানের গণপরীক্ষার ঘটনায় পরীক্ষার সক্ষমতায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ অনেক উন্নত দেশকে ছাপিয়ে গেছে চীন। তবে কয়েকটি সংক্রমণের কারণে এত বিশাল জনগোষ্ঠীকে পরীক্ষা করা জরুরি ছিল কিনা- তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

পরীক্ষা কাজটি অনেকটা নির্ঝঞ্ঝাটেই শেষ হয়েছে। যদিও অনেকে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে না পারা নিয়ে অভযোগ করেছেন।

সরকারি ও সামাজিক চাপ এত মানুষকে নমুনা দিতে উৎসাহিত করেছে। পরীক্ষা না করলে নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হওয়ারও ভয় ছিল। পরীক্ষা না করালে স্বাস্থ্য কার্ডের বিশেষ কালার কোডে অবনিত হওয়ার হুঁশিয়ারি ছিল। কারণ সবুজ থেকে হলুদে নেমে এলেই আর কাজে যাওয়ার অনুমতি মিলতো না। এছাড়া উহানের বাইরে ভ্রমণ, রেস্তোরাঁ, গণপরিবহন ব্যবহার ও অন্যান্য সুবিধা পাওয়ার বিষয়টিও মানুষকে প্রভাবিত করেছে। উহানবাসীও কঠোরভাবে এ নির্দেশনা পালন করেছে। কারণ পরীক্ষা থেকে বাদ পড়লে তাকেই দায়বদ্ধ থাকতে হবে। 

ব্লুমবার্গ অবলম্বনে

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন