কভিড-১৯ ও আম্পান নিয়ে গার্ডিয়ানে প্রধানমন্ত্রীর নিবন্ধ

কীভাবে মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়েছি

ভারত মহাসাগরে মে মাসের দিকে যখন আম্পান ঘনীভূত হতে শুরু করে তখন আমাদের হাতে আর কোনো সময় ছিল না।

কিন্তু আশ্রয়কেন্দ্রগুলো শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করার বিষয়টিকে সামনে রেখে বাংলাদেশে নির্মিত হয়নি এবং দেশটি নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে: কীভাবে ২৪ লাখ মানুষকে কভিড-১৯-এর মতো আরো বড় বিপদে না ফেলে ঝড়ের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রক্ষা করা যায়।

স্বল্প সময়ের মধ্যে বিপুলসংখ্যক মানুষকে সরিয়ে নেয়া অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের। মানুষ তাদের ঘরবাড়ি অরক্ষিত রেখে কোথাও যেতে আগ্রহী হয় না। সময়ে চ্যালেঞ্জটি ছিল আরো অনেক বেশি জটিল। ভাইরাসের আশঙ্কায় মানুষ বাসস্থল ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে আরো বেশি ভীত ছিল। প্রথমে সাড়া প্রদানকারীদের নিশ্চিত করতে হয়েছে যে মানুষের আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়াটা যেন জোরপূর্বক না হয়ে স্বেচ্ছায় হয়।

কয়েক দিনের ব্যবধানে, বাংলাদেশ প্রায় ১০ হাজার ৫০০ অতিরিক্ত আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করেছে এবং হাজার ১৭১টি আশ্রয়কেন্দ্র আগে থেকেই ছিল। উদ্দেশ্য ছিল আশ্রয়কেন্দ্রে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে মানুষের সংস্থান করা। উপকূলীয় অঞ্চলজুড়ে ৭০ হাজারের বেশি ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি স্বেচ্ছাসেবীদের একত্র করা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় মাস্ক, বিশুদ্ধ পানি, সাবান জীবাণুনাশক বিতরণ করা হয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্পে রফতানি আদেশ স্থগিত বাতিল হওয়ার ঘূর্ণাবর্তে থেকেও ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ তৈরির কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।

মহামারীর চূড়ায় থেকে আম্পানের মতো ঘূর্ণিঝড়সহ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা এবং মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি প্রতিরোধে আরো সূক্ষ্ম দৃষ্টি রাখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশ্যান অ্যান্ড অ্যাটমসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ধারণা করছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আটলান্টিক ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের অস্বাভাবিক গরম পানির তাপমাত্রার কারণে চলতি বছরে যুক্তরাষ্ট্রে হ্যারিকেন মৌসুম রেকর্ড বইয়ে স্থান করে নেবে। বাংলাদেশের জন্য করণীয় হবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে দক্ষিণাঞ্চলে বসবাসরত জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কভিড-১৯-এর কারণে যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের জন্য প্রভাব মোকাবেলা আরো কঠিন হবে।

৫৫ হাজার মানুষের সহায়তাসহ বাংলাদেশের ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলা প্রস্তুতির কারণে আম্পানে বাংলাদেশ ভারত মিলে মৃতের সংখ্যা ১০০-এরও কমে রাখা গেছে। যদিও প্রতিটি মৃত্যুই দুঃখজনক, দেশের আগাম সতর্ক ব্যবস্থা দুর্যোগপ্রবণ এলাকার আবাসস্থল দ্রুত খালিপূর্বক আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার মহড়া কয়েক বছর ধরে হাজার হাজার মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে।

তাত্ক্ষণিকভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাবগুলো মোকাবেলা করাই যথেষ্ট নয়। স্থানীয় সম্প্রদায়কে পরবর্তী ঝড় বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ আরো ভালোভাবে মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত করা দরকার।

পরিকাঠামো পুনর্নির্মাণ জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থাকে স্বাভাবিক করা অবশ্য অন্য বিষয়। বাংলাদেশ এর আগেও বহুবার ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো পুনর্নির্মাণপূর্বক জেগে উঠেছে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকিতে থাকা বিশ্বের অন্যতম বাংলাদেশ। দেশটির দুই-তৃতীয়াংশ ভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠের পাঁচ মিটার নিচে অবস্থান করছে, যার ভূমি গঠনপ্রক্রিয়া এখনো চলমান। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিষয়টিকে আরো কঠিন করে তুলেছে। ঘূর্ণিঝড়গুলো ক্রমে আরো তীব্র এবং ঘন ঘন আঘাত হানছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে আমাদের ফার্মার জমিগুলোকে আরো দূষিত করছে। মহামারী এবং তার ফলে সৃষ্ট গভীর অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে সরকারকে অবশ্য স্বাস্থ্য, জলবায়ু পরিবর্তন অর্থনৈতিক জরুরি পরিস্থিতি একসঙ্গে মোকাবেলা করতে হচ্ছে।

উত্তর ভারতীয় মহাসাগর বঙ্গোপসাগরে উদ্ভূত ঘূর্ণিঝড় আম্পান ছিল রেকর্ডের দিক থেকে সবচেয়ে বিধ্বংসী মারাত্মক ঝড়। এটি আনুমানিক ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ (১০ দশমিক মিলিয়ন পাউন্ড) ক্ষতিসাধন করেছে। বাংলাদেশে আম্পান ৪১৫ কিলোমিটার রাস্তা, ২০০ সেতু, বিপুলসংখ্যক ঘরবাড়ি এবং কয়েক হাজার হেক্টর কৃষিজমি মাছ চাষের ঘের ধুয়েমুছে একাকার করে দিয়েছে। ঘূর্ণিঝড়সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর উদ্দেশ্যে নির্মিত ১৫০ কিলোমিটারের বেশি বাঁধ ধ্বংস করেছে আম্পান।

এটি বেশ বিপর্যয়কর ঝড় ছিল, কিন্তু জুতসই পরিকল্পনা দেশগুলোকে ভালোভাবে প্রস্তুত করেছে, যখন প্রাকৃতিক দুর্যোগটি উপকূলে আঘাত হানে। একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের তাত্ক্ষণিক প্রভাব মোকাবেলা যথেষ্ট নয়; জনগোষ্ঠীগুলোকে পরবর্তী ঝড় মোকাবেলায় আরো ভালোভাবে প্রস্তুতও করতে হয়। কাজটি ভীষণ জরুরি।

দেশকে ভালোভাবে পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তার লক্ষ্যে আমরা ২০১৪ সালে একটি ক্লাইমেট ফিসক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক গঠন করি। সেদিক থেকে বাংলাদেশই বিশ্বের মধ্যে প্রথম দেশ, যেটি জলবায়ু স্থায়িত্বশীলতা-সহনশীলতা নিশ্চিতের বিষয়টি অর্থায়নের জন্য কয়েক বছরভিত্তিক, বহু খাতভিত্তিক একটি অ্যাপ্রোচের উন্নয়ন ঘটিয়েছে। কয়েক বছরভিত্তিক বাজেটের সঙ্গে সংগতি রেখে আলোচ্য ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে কৃষি, গৃহায়ণ, জ্বালানিসহ ২০ সরকারি মন্ত্রণালয়ের জলবায়ুজনিত অভিঘাতের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির পরিমাণ এবং জলবায়ুসংক্রান্ত ব্যয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

বদ্বীপ অঞ্চলের জন্য ২০১৮ সালে একটি আট দশকব্যাপী জলবায়ু অভিযোজন পরিকল্পনা এবং ৩০ মিলিয়ন লোককে পুনর্বাসনের পরিকল্পনায়ও এই ফ্রেমওয়ার্কটি জুতসইভাবে অনুসরণ করা হয়েছে। বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-এর প্রথম দশকে বেশি জোর দেয়া হয়েছে ঝড়সৃষ্ট প্লাবন প্রতিরোধে উঁচু বেড়িবাঁধ নির্মাণের মতো অবকাঠামো শক্তিশালীকরণের ওপর। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর শক্তিশালী স্কুল, হাসপাতাল ঘরবাড়ি নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে, যাতে সেগুলো উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাস ঠেকাতে সহায়ক হতে পারে। একই সঙ্গে পরবর্তী প্রাকৃতিক দুর্যোগ যখন আঘাত হানবে, তখন আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করতে পারে।

বিশ্বজুড়ে কভিড-১৯ মহামারী সরকারি অর্থায়নে বিপুল চাপ সৃষ্টি করছে। তবে আমরা মনে করি যে দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক কাঠামো জলবায়ু অভিযোজন পরিকল্পনা দেশগুলোকে যেকোনো সংকট-দুর্যোগ মোকাবেলার ভালো টুলস প্রদান করে। স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক জলবায়ু স্থায়িত্বশীলতা একে অন্যের সঙ্গে আন্তঃসম্পর্কিত। কারণে বদ্বীপ পরিকল্পনায় ভূমি পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্প, স্থানীয় জনগোষ্ঠীগুলোকে আরো স্বাস্থ্যবান অধিক স্থায়িত্বশীল করার পদক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক একটি উদাহরণ দেয়া যাক। প্রতিটি বিপর্যয়কর ঘূর্ণিঝড়ের পরবর্তী সময়ে রোগ  প্রতিরোধে সোলার হোম কিটগুলো দূষিত পানি শোধনের ক্ষেত্রে ব্যবহূত হতে পারে।

বাংলাদেশ বোধ হয় একমাত্র দেশ, যেটি চলতি বছর একই সঙ্গে স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক জলবায়ুজনিত জরুরি অবস্থার সঙ্গে লড়ছে। কাজেই আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে বিরাজমান সাফল্য থেকে দেশগুলো শিখতে পারে এবং একে অন্যকে পৃষ্ঠপোষকতা জোগাতে পারে। কেবল একযোগে কাজ করলেই আমরা আরো শক্তিশালী আরো স্থায়িত্বশীল হিসেবে আবির্ভূত হব এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোও ভালোভাবে মোকাবেলা করতে পারব।       

 

শেখ হাসিনা: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের চেয়ার

প্যাট্রিক ভারকুজেন: গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপটেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা

 

দ্য গার্ডিয়ান থেকে ভাষান্তর: রুহিনা ফেরদৌস হুমায়ুন কবির

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন