বাস্তবতার ধারণা বদলে দিচ্ছে কভিড-১৯

রজত মিত্র

সম্প্রতি একটি ওয়েব সেমিনারে দুজন ছাত্রের সঙ্গে ভার্চুয়াল বনাম বাস্তব ধারণা নিয়ে এক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ি। এই আলোচনা বাস্তবতার সংজ্ঞায় গিয়ে ঠেকে এবং তারা বলছিলেন কেন তারা মনে করেন পুরনো প্রজন্ম নতুন বাস্তবতার সংজ্ঞা বুঝতে পারে না। সেই দুই ছাত্র জোর দিয়ে বলছিলেন তারা যেকোনো বিশ্বের যেকোনো শহরে চলে যেতে পারেন কম্পিউটার প্রোগ্রাম ব্যবহার করে এবং শহরের রাস্তা, ঐতিহাসিক স্থাপনা এবং জাদুঘর দেখতে পারেন বাস্তবিকভাবে সেই শহরে উপস্থিত না থেকেও। আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম, শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকা এবং কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে হাজির থাকার মাঝে কি কোনো পার্থক্য নেই? তারা অবিশ্বাস্য সুরে বললেন, এই প্রোগ্রাম দিয়ে তারা অনেক শহর ভ্রমণ করেছেন এবং এরপর আরো বললেন, তারা মনে করেন না এসব জায়গায় আর ভ্রমণের প্রয়োজন আছে।

আমি তাদের বলার চেষ্টা করলাম, ভার্চুয়াল উপস্থিতি বাস্তবিক উপস্থিতির মাঝে পার্থক্য আছে। এর মাঝে কোনো সেতুবন্ধ সম্ভব নয়। বললাম, একটি জায়গাকে চোখে দেখার যে অভিজ্ঞতা, অনুভব এবং ঘ্রাণ তা আমাদের মনে একটি চিত্র তুলে ধরে, যা কিনা স্থায়ী হয়ে যায়। রোমের একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে, এমন একটি জায়গা যেখানে তারা ভার্চুয়ালি ভ্রমণ করেছেন। এই শহরের ব্যাপারে বলা হয়, যদি কবুতর আপনার মাথায় বাথরুম না করে কিংবা আপনি যদি পকেটমারের কবলে না পড়েন তবে আপনার ভ্রমণ কখনো সম্পূর্ণ হয় না।

আমি বললাম, আপনি যখন ভার্চুয়াল শহরে ভ্রমণ করবেন, তখন শব্দ, গন্ধ সংবেদন কি আপনি মিস করবেন না? আপনি এটার মধ্য দিয়ে হাঁটছেন না। আপনি কেবল এক জায়গায় বসে দেখছেন। এগুলো বাস্তবিক পৃথিবী মানুষের শব্দ না। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় আপনি কখনো হারিয়ে যাবেন না এবং দিক খোঁজার জন্য আপনাকে ইংরেজি জানা মানুষও খুঁজে বেড়াতে হবে না।

সময় আমি বাস্তবিক দুনিয়ায় নিজের একাধিক অভিজ্ঞতার কথাও ওদের বর্ণনা করি। একমাত্রিক অভিজ্ঞতা কি কখনো সারা জীবন টিকে থাকতে পারে? সেই প্রোগ্রামকে আপনি যতই বাস্তবিক করে তোলার চেষ্টা করুন না কেন।

বর্তমানে কভিড-১৯ সম্ভবত আমাদের সঙ্গে এই কাজটাই করছে। বিশ্বের কোটি মানুষ পর্দার সামনে বসে কার্সর নাড়িয়ে নতুন বাস্তবতার মানচিত্র তৈরি করছে। বাস্তবতা কী দিয়ে তৈরি হয় তার সংজ্ঞা সম্ভবত একটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা কিনা পুরনো বাস্তবতাকে মলিন করে দিচ্ছে। আর এটা পরিচালিত হচ্ছে এক ধরনের ভয় দ্বারা, যেখানে শারীরিক পৃথিবী এখন আর মোটেই নিরাপদ না এবং ভার্চুয়ালি তাকে অনুভবের মাঝে নিরাপত্তা পাওয়া যায়।

ছাত্ররা আমার বক্তব্য ধরতে পারেননি যে ভার্চুয়াল দুনিয়া বাস্তব দুনিয়ার নিকটবর্তী না। এটি প্রোগ্রামের ভেতর প্রোগ্রাম নয় এমন কিছু যা কিনা অন্য মানুষের সঙ্গে যুক্ত করে বাস্তবতা নির্মাণ করে। আমি ছাত্রদের বলি, বিস্ময় পরিবর্তন অভিজ্ঞতাকে বাস্তবিক করে তোলে। জেমস বল্ডউইনের বিখ্যাত সেই কথাটি যে মানুষের একটি মাত্র স্পর্শ আপনাকে সারা জীবনের জন্য বদলে দিতে পারে।

আমার ধারণা, আমি ছাত্রদের হতবুদ্ধি অবস্থায় ফেলে দিয়েছি। আমি বিস্মিত হচ্ছি এই ভেবে, এটা কি কেবলই জেনারেশন গ্যাপ? এমন দিন কি আসবে যখন ভার্চুয়াল দুনিয়াকেও শারীরিক দুনিয়ার মতো সমানভাবে গণ্য করা হবে?

আমি বিশ্বাস করি কভিড-১৯ মহামারী আমাদের ধারণার চেয়ে দ্রুতগতিতে আক্রমণ করেছে। এই মহামারীর পর আমরা শারীরিক বাস্তবতাকে আগের প্রজন্ম যেভাবে দেখতাম সেভাবে দেখতে পারব না। আমরা সম্ভবত শেষ প্রজন্ম যারা  দুটি যুগের মাঝামাঝি পথে দাঁড়িয়ে আছি। যেখানে ভার্চুয়াল বাস্তবতা প্রাকৃতিক বাস্তবতার স্থলাভিষিক্ত হতে যাচ্ছে।

এখন আমি যখন অনলাইন ক্লাস নিচ্ছি, আমি নড়াচড়ার বিষয়-আশয় মিস করছি, সেই হাসি যা কিনা পেছনের সারির শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারত। সেই শূন্যদৃষ্টিগুলো মিস করি, যার ফলে আমাকে আবার পাঠ পুনরাবৃত্তি করতে হতো। বাস্তবতার উপলব্ধির জন্য এগুলো আমার প্রয়োজন ছিল।

বাড়িতে তিনটি স্ক্রিন সবদিক থেকে আমাদের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আমরা সবাই ল্যাপটপ সামনে নিয়ে বসে থাকি। রোমাঞ্চকর কিছু বলার থাকলে আমরা হাত তুলি, একটি কৌতুক কিংবা কার্টুন। এরপর আবার ল্যাপটপে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। আমার মেয়ে এরই মধ্যে ভাবতে শুরু করেছে যে আমাদের ল্যাপটপ পুরনো হয়ে গেছে এবং সে তার স্মার্ট ফোনকেই বেশি অগ্রাধিকার দেয়।

শারীরিক-বাস্তব জগেক আমরা পেছনে ফেলে এসেছি, যা আমাদের জীবনকে অর্থপূর্ণ করত। বাস্তবতা আমাদের দিয়েছে কবি, লেখক, বিজ্ঞানীদের, যারা সংবেদনশীল জগৎ থেকে কল্পনা উদ্দীপনা তৈরি করতেন, যা কভিড-১৯-পরবর্তী ভার্চুয়াল দুনিয়া দিতে পারবে না।

আউটলুক ম্যাগাজিন

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন