ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া বাঁচে না যেসব বস্তুর পৃষ্ঠে

বণিক বার্তা অনলাইন

ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়াগুলোর বিরুদ্ধে যে ওষুধগুলো ব্যবহার করা হয়, গত এক দশকে তার তালিকা ক্রমশ ছোট হয়ে এসেছে। এসেছে অর্থাৎ অনেক অ্যান্টিবায়োটিকই অকার্যকর হয়ে গেছে। রোগ সৃষ্টিকারী ছত্রাক, ভাইরাস ও অন্যান্য পরজীবী মোকাবেলায় যে ওষুধগুলো ব্যবহার করা হয়, দিন দিন সেসব ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে জীবাণুগুলো। এর অর্থ হলো, এসব প্যাথোজেন যেসব অসুস্থতা সৃষ্টি করে, সেগুলোর চিকিৎসা ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে। 

বর্তমানে ‘সুপারবাগ’ নামে নতুন এক পরিভাষা চিকিৎসা বিজ্ঞানে বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। এগুলো আসলে অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্ট জীবাণু, অর্থাৎ কোনো অ্যান্টিবায়োটিক এদেরকে প্রতিহত করতে পারে না।

এ পরিস্থিতির মধ্যে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে আবির্ভুত হয়েছে নভেল করোনাভাইরাস। এখন পর্যন্ত ভাইরাসটি বিশ্বজুড়ে ৬০ লাখের বেশি মানুষকে আক্রান্ত করেছে এবং প্রাণ নিয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজারের বেশি মানুষের। 

ব্রিটেনের ইম্পেরিয়াল কলেজ, লন্ডনের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ল্যারোই মাউমাস বলেন, আমরা যদি কিছু না করি তবে প্রতিবছর ১ কোটি মানুষ মারা যাবে। তিনি ও তার দল এমন একটি উপায় বের করেছেন, যার মাধ্যমে ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া রোধ করা সম্ভব। 

রোগজীবাণু বা ভাইরাসের বেশিরভাগ প্রজাতিই মানুষের ব্যবহার্য জিনিসপত্রের মাধ্যমে একজনের কাছ থেকে অন্যজনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ বস্তুর গায়েও এরা দীর্ঘ সময় জীবিত থাকতে পারে এবং স্পর্শকারী বা ব্যবহারকারীর মধ্যে সংক্রমণ ঘটাতে পারে।

যেমন কভিড-১৯ ভাইরাস কার্ডবোর্ডে ২৪ ঘণ্টা, প্লাস্টিক ও স্টেইনলেস স্টিলে (মরিচারোধী ইস্পাত) ৩ দিন পর্যন্ত সক্রিয় থাকতে পারে। আবার ই-কোলাই ও এমআরএসএর মতো ব্যাকটেরিয়া নির্জীব বস্তুর পৃষ্ঠে কয়েক মাস পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। সুতরাং আমাদের নিত্যব্যবহার্য বস্তুর পৃষ্ঠ নিয়মিত জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করার জরুরি হয়ে পড়েছে।

তবে কিছু বিজ্ঞানী আশা করেন, ব্যবহার্য জিনিসপত্রগুলোর গঠন পরিবর্তন করে বা দ্রুত ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসকে হত্যা করতে পারে এমন বস্তুর প্রলেপ দেয়া বা আলাদা একটি আবরণ দেয়ার মাধ্যমে সংক্রামক জীবাণুগুলো মানবদেহে প্রবেশের আগেই ধ্বংস করা সম্ভব হতে পারে। 

এ ধরনের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বস্তুর মধ্যে সবার আগেই আসছে তামার নাম। এই ধাতুর আয়নগুলো ভাইরাস ও ব্যাকটেরি রোধী বলে দাবি করছেন ডা. ল্যারোই মাউমাস। তিনি বলছেন, তামার পৃষ্ঠ দুই ঘণ্টার মধ্যে ৯৯ দশমিক ৯ শতাংশ ব্যাকটেরিয়া মেরে ফেলতে সক্ষম।

ডা. মাউমাস আরো বলেন, তিন হাজার বছর আগে থেকেই তামার জিনিসপত্র ব্যবহার হয়ে আসছে। প্রাচীন গ্রিকরা রান্না ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে তামার জিনিসপত্র ব্যবহার করতো। যদিও বর্তমানে এগুলোর ব্যবহার একেবারেই কম। এগুলো তামার তৈজসপত্র ও অন্যান্য ব্যবহার্য জিনিস এখন বেশ ব্যয়বহুল, এগুলোকে কোনো ধরনের ধাতুক্ষয় ব্যতিরেখে পরিষ্কার করাও কঠিন এবং অনেক মানুষ এ জাতীয় উপকণ ব্যবহার অপছন্দ করেন। তামার জায়গা এখন দখল করেছে প্লাস্টিক। তথাপি আপনি যদি তামা বা তামার প্রলেপ দেয়া জিনিসপত্র ব্যবহার করেন, তবে আপনাকে আর কষ্ট করে সেগুলো বারবার জীবাণুমুক্ত করতে হবে না।

ব্যবহার্য প্রতিটা জিনিসপত্রে তামার আস্তরণ ব্যবহার করা সবার পক্ষে হয়তো সম্ভব না। তবে ল্যারোই মাউমাস বিশ্বাস করেন, সবগুলোতে না হলেও লিফটের বোতাম, দরজার হাতল, পানির কলের মতো অতিব্যবহার্য জিনিসগুলোতে ধাতুটির প্রলেপ ব্যবহার করা যেতে পারে। ফলস্বরূপ জীবাণুর সংক্রমণ হ্রাস পাবে। 

যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের পারডৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা প্রথম আবিষ্কার করেন, তামা মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক-রেজিস্ট্যান্স ব্যাকটেরিয়াগুলোর উচ্চতর ঘনীভূত স্ট্রেনকেও মেরে ফেলতে পারে। এটা কেবল দরজার হাতলে নয়, চিকিৎসা সরঞ্জামেও তামার প্রলেপ ব্যবহার করতে পারলে- হাসপাতালগুলোতে সংক্রমণের সম্ভাবনা হ্রাস পাবে। 

জিনিসপত্রের পৃষ্ঠ নিজে নিজেই পরিষ্কার হয়ে যাবে- এমন বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন অস্ট্রেলিয়ার আরএমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মলিকিউলার বায়োকেমিস্ট এলেনা ইভানোভা। তিনি বলেন, সিকাডো নামের একটি পোকার ডানা স্বতঃপরিষ্কার বৈশিষ্ট্যে জন্য বিখ্যাত। তাদের ডানাগুলো সুপার হাইড্রোফোবিক, যার এতে কোনোভাবেই পানি আটকায় না। যেমন পদ্ম বা কচু পাতা। এটা প্রকৃতির নির্মিত একটা অনন্য প্রক্রিয়া।

ইভানোভা আরো কিছু আইডিয়ার কথা জানান। তিনি বলেন, কোনো ধরনের অণুজীবের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হবে সেটির ওপর ভিত্তিতে করে সে ধরনের জ্যামিতিক গঠন বৈশিষ্ট্য, প্যাটার্ন ও ঘনত্ব সম্পন্ন বস্তু তৈরি করা যেতে পারে। বিশেষ জটিল আঁকাবাঁকা গড়নের বস্তু পানি ও এসির ফিল্টারে ব্যবহার করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে দারুণ একটি উপাদান হতে পারে গ্রাফিন। গ্রাফিন শিট অবিশ্বাস্যরকম পাতলা এবং অতিসূক্ষ্ণ ধারাল ধার রয়েছে যা ব্যাকটেরিয়ার বাইরে আবরণ কেটে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে। তবে এ ধরনের বস্তু মানুষের ত্বকের জন্যই ক্ষতিকর। বিকল্প হিসেবে টাইটেনিয়াম ও টাইটেনিয়াম সঙ্কর ব্যবহার করা যেতে পারে। এ ধাতুকে উচ্চতাপ ও চাপে গলিয়ে পাতলা শিট বানিয়ে নিতে পারলেও সেটিও অনেক ধরনের ব্যাকটেরিয়া হত্যা করতে পারে। আবার টাইটেনিয়াম ডাই অক্সাইড অতিবেগুনী রশ্মির সংস্পর্শে এলে পারঅক্সাইডের তো কিছু অক্সাইড তৈরি করতে পারে যা অণুজীবকে নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারে।

আবার একই কৌশলে ধাতু বা গ্রাফিন দিয়ে ন্যানোপিলার তৈরির আইডিয়া নিয়ে কথা বলেছেন স্পেনের রোভিরা ভারর্জিলি ইউনিভার্সিটির জৈবপদার্থবিদ ভ্লাদিমির বাউলিন।

এসেনশিয়াল অয়েলও অ্যান্টিভাইরাল ও অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল হিসেবে কাজ করে বলে দাবি করেছেন আর্জেন্টিনার ইউনিভার্সিটি ন্যাসিওনাল দি মার দেল প্লাতা -এর কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার অলেহান্দ্রো পোনস। তিনি বলেন, পরীক্ষামূলক গবেষণায় চা গাছের তেলের অ্যারোসল শক্তিশালী অ্যান্টিভাইরালের কাজ করে এবং ৫ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে এটা ৯৫ শতাংশের বেশি ভাইরাস নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম।

তবে এই ধরনের পদ্ধতিগুলোর ওপর নির্ভর করা উচিত হবে না বলে মনে করেন সুইডেনভিত্তিক অ্যাক্ট অন অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট নেটওয়ার্ক রিঅ্যাক্টের পলিসি অফিসার মেঙ্গিং রেন। তিনি বলেন, প্রযুক্তিগুলো যত ভালোই হোক না কেন, আমাদের এখনও স্বাস্থ্যসেবা কর্মচারী, পরিচ্ছন্নকর্মী, স্বাস্থ্যকর পণ্য এবং সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সুবিধাগুলোর পাশাপাশি ভ্যাকসিন নিয়ে ভাবতে হবে।

যদিও সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ল্যারোই মাউমাস আত্মবিশ্বাসী যে, ব্যাকটেরিয়া গত ৩ হাজার বছরেও তামার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি, ফলে ভবিষ্যতেও প্রতিরোধ গড়ে তোলার সম্ভাবনা নেই। ফলে তামার প্রলেপ দেয়া পৃষ্ঠ সংক্রামক রোগ ও ভবিষ্যতের মহামারীগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হতে পারে।

তিনি বলেন, আমরা এখন সংক্রমণের মধ্যে রয়েছি। সুতরাং আমরা এখন যে লড়াই করছি তা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পরবর্তী মহামারীর জন্য প্রস্তুত হওয়া। কারণ এটি কখন আবার আসবে- তা আমরা জানি না। 

বিবিসি অবলম্বনে শিহাবুল ইসলাম

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন