চীনের বাইরে প্রথম নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ থাইল্যান্ডে। ফলে আশঙ্কা ছিল, দেশটিতে সংক্রমণ ও সংক্রমণজনিত মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াবে ভয়াবহ পর্যায়ে। কিন্তু সে আশঙ্কাকে অনেকটাই প্রশমিত করে দিয়েছে দেশটির সরকারের কঠোর পদক্ষেপ এবং থাই সংস্কৃতির সমন্বিত প্রভাব। এরই মধ্যে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণকে প্রায় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে থাইল্যান্ড। সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা শূন্যের কাছাকাছি চলে এলেও ভাইরাসটি থেকে পুরোপুরি পরিত্রাণ না মেলায় এখনই লকডাউন সম্পূর্ণরূপে তুলে নিতে চাইছে না ব্যাংকক।
থাইল্যান্ডে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে নভেল করোনাভাইরাসে নতুন সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা এক অংকেই স্থির রয়েছে। এ অবস্থায় ধীরে ধীরে মহামারী মোকাবেলায় আরোপিত বিধিনিষেধ শিথিল করে আনছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। গতকালই দেশটিতে লকডাউন তৃতীয় দফায় শিথিল করা হয়েছে। এ পর্যায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন বিনোদনকেন্দ্রে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি সীমিত পর্যায়ে কার্যক্রম চালানো হবে। এছাড়া কমিয়ে আনা হয়েছে সান্ধ্য আইনের সময়কালও। দেশটির সরকারের ঘোষিত সময়সীমা অনুযায়ী, এ লকডাউন পুরোপুরি প্রত্যাহার করে নেয়া হবে আগামী ১ জুলাই।
থাইল্যান্ডে এখন হাতেগোনা যে কয়টি নতুন সংক্রমণ শনাক্ত হচ্ছে, তার সবই বাইরে থেকে আসা। করোনা নিয়ন্ত্রণে সাফল্যের কারণে অস্ট্রেলিয়া, ভিয়েতনামের মতো থাইল্যান্ড থেকেও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কথা ভাবছে জাপান। দেশটিতে প্রথম কভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় ১৩ জানুয়ারি। চীনের বাইরে প্রথম করোনা রোগী এখানেই শনাক্ত হওয়ায় দেশটির করোনা পরিস্থিতি কোন দিকে গড়ায় তা নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন অনেকেই। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্য বলছে, থাইল্যান্ডে এখন পর্যন্ত নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমিত মোট রোগী শনাক্ত হয়েছে ৩ হাজার ৮২ জন। মৃত্যু হয়েছে ৫৭ জনের। এর মধ্যে গতকাল পর্যন্ত সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় কভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে মোটে একজন। ওই রোগী দুই সপ্তাহ আগে রাশিয়া থেকে এসেছিলেন। কোয়ারেন্টিনে থাকা অবস্থাতেই তার দেহে ভাইরাসটির উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। এর আগে রোববার শনাক্ত হয়েছিলেন চারজন। এরাও বিদেশ থেকে এসে কোয়ারেন্টিনে ছিলেন।
যে সময় থাইল্যান্ডে প্রথম নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হয়, সে সময় এর সম্পর্কে বিশ্ববাসী খুব একটা বুঝে উঠতে পারেনি। হাজার হাজার চীনা নাগরিক সে সময় থাইল্যান্ডে চান্দ্র নববর্ষ উদযাপনের জন্য থাইল্যান্ডে অবস্থান করছিল। অন্যদিকে স্বাস্থ্যের চেয়ে পর্যটন খাতকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে থাই সরকারও চীন ও অন্যান্য দেশের নাগরিকদের আগমনে কোনো লাগাম টানতে চায়নি। এ পরিস্থিতি বজায় ছিল মার্চের শেষ দিক পর্যন্ত।
পরিস্থিতি বদলে যায় থাই রাজপরিবার-সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের এক চিকিৎসকের এ-সংক্রান্ত এক পূর্বাভাসের পর। ওই চিকিৎসক বলেছিলেন, থাই সরকার যদি তখনই শক্ত পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে এপ্রিলের মাঝামাঝির মধ্যে থাইল্যান্ডে কমপক্ষে সাড়ে ৩ লাখ লোক আক্রান্ত হবে। এর মধ্যে প্রাণহানি হবে ৭ হাজার মানুষের।
ভয়াবহ এ পূর্বাভাস সামনে আসার পর পরই থাই প্রধানমন্ত্রী প্রায়ুত চান-ওচা তাত্ক্ষণিকভাবে জরুরি বেশকিছু ঘোষণা দেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমকে কেন্দ্রীভূত করে আনেন তিনি। বন্ধ করা হয় অন্যান্য দেশ থেকে থাইল্যান্ডে গমনাগমন। একই সঙ্গে জারি করা হয় সান্ধ্য আইনসহ কঠোর লকডাউন, যা এখন ধীরে ধীরে পর্যায়ক্রমে শিথিল করা হচ্ছে।
প্রায়ুত চান-ওচা শক্ত পদক্ষেপ নেয়ার পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় দক্ষ লোকদের চিহ্নিত করে তাদের সামনে নিয়ে আসার পদক্ষেপ নেন। একই সঙ্গে গোটা ব্যবস্থাপনার ভার তুলে দেয়া হয় পেশাদার স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের হাতে। থাই সরকারের কভিড-১৯ ব্যবস্থাপনায় নেতৃত্ব ও যোগাযোগ ব্যবস্থাপনার ভারটিও তাদের কাঁধেই তুলে দেয়া হয়।
এর ফলাফলও পাওয়া যায় হাতে হাতে। এপ্রিলেই থাইল্যান্ডে সংক্রমণের গতি হয়ে ওঠে নিম্নমুখী। গত ২৪ মে প্রথমবারের মতো ২৪ ঘণ্টায় শূন্য সংক্রমণ শনাক্তের কথা ঘোষণা দিতে সক্ষম হয় দেশটি। ২৬ মে পর্যন্ত দেশটিতে মোট সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৪৫। গতকাল পর্যন্ত এর পরের পাঁচদিনে দেশটিতে নতুন কভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছে মোটে ৩৭ জন।
থাইল্যান্ডের করোনা নিয়ন্ত্রণে এ সফলতার পেছনে অনেক কারণকেই চিহ্নিত করছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো। প্রথমত, দেশটির সরকার করোনা নিয়ন্ত্রণে ঘোষিত প্রতিটি পদক্ষেপের কঠোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করেছে।
দ্বিতীয়ত, দেশটির জনগণের মধ্যে করোনা নিয়ে ব্যাপক সচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়েছে। লকডাউনে থাই জনগণের ঘরে থাকাকে বর্ণনা করা হয়েছে দেশপ্রেমিকের দায়িত্ব হিসেবে। একই মাস্ক পরে চলাচল নিয়েও থাই জনগণের মধ্যে অনেক প্রচারণা চালানো হয়েছে। ফলে রাস্তায় দেখা গেছে, থাইল্যান্ডের সব নাগরিকই রোগটির সংক্রমণ বন্ধে মুখে মাস্ক নিয়ে চলাচল করেছে। থাইল্যান্ডে এ সময় যাদের মাস্ক ছাড়া চলাচল করতে দেখা গিয়েছে, তারা সবাই বহিরাগত, পশ্চিমা দেশের নাগরিক।
এছাড়া দেশটির সংস্কৃতিও করোনা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। দেশটিতে সম্ভাষণমূলক অভিবাদনের রীতি হলো বুকের সঙ্গে হাত ঠেকিয়ে মাথা ঝুঁকানো। কোলাকুলি, হাত মেলানো বা অন্যের অঙ্গ স্পর্শ করে অভিবাদন জানানোর রীতি নেই এখানে। ফলে জনগণের মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টি রক্ষা করতে খুব একটা অসুবিধাও হয়নি।
থাইল্যান্ডের সর্বজনীন স্বাস্থ্য খাতও এখানে বড় ভূমিকা রেখেছে। গোটা থাইল্যান্ডেই ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবার জন্য স্বল্পমূল্যে চিকিৎসাসেবা অনেক আগে থেকেই নিশ্চিত করা রয়েছে। এমনকি মহামারী না থাকা অবস্থায়ও এখানকার স্বাস্থ্য খাতের স্বেচ্ছাসেবীদের গ্রামে গ্রামে নিয়মিতভাবেই সবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে দেখা যায়।
গতকালই দেশটিতে তৃতীয় দফায় লকডাউন শিথিল করা হয়। এর আগে গত ১৭ মে দ্বিতীয় দফায় লকডাউন শিথিলের সময়ে শপিং মলসহ বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়। এর সঙ্গে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কঠোর শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। বর্তমানে দেশটির ক্রেতারা শপিং মলে কেনাকাটা করতে যেতে পারলেও শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করে স্যানিটাইজিং জেল ব্যবহারের পরই সেখানে ঢুকতে পারছে। খুলে দেয়া হয় খাবারের দোকান ও রেস্তোরাঁও। সেখানে গ্রাহকদের বসতে হচ্ছে একে অন্যের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে।
৩ মে থেকেই ধীরে ধীরে এ লকডাউন শিথিলের কার্যক্রম শুরু করে থাই সরকার। করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্তের সংখ্যা কমতির দিকে থাকায় দুই মাসমেয়াদি এ লকডাউন শিথিলের কার্যক্রম হাতে নেয় ব্যাংকক।
অনেকেই দেশটিতে সংক্রমণের সংখ্যা কম হওয়ার পেছনে কর্তৃপক্ষের তথ্য নিয়ে নয়-ছয় করার বিষয়টিকে সন্দেহ করছেন। এছাড়া দেশটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে নমুনা পরীক্ষা না হওয়ার কথাও বলেছেন অনেকে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এ সময়ের মধ্যে দেশটিতে ভাইরাস জ্বর বা নিউমোনিয়া জাতীয় সংক্রমণ নিয়ে আগত রোগীর চাপ বাড়ারও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এছাড়া অনেকেই বলছেন, স্বাধীন গণমাধ্যম ও আরো স্বাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে এ ধরনের কর্মকাণ্ড দেশটির সরকারি কর্মকর্তাদেরও মারাত্মক চাপের মুখে ফেলে দিতে পারত। এ কারণে নিন্দুকদের এসব দাবি পুরোপুরিই ভিত্তিহীন বলে মনে করছেন অনেকেই।
তবে মহামারীর ব্যাপক প্রাদুর্ভাবকে এ মুহূর্তের জন্য ঠেকিয়ে দেয়া সক্ষম হলেও দেশটির সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে অর্থনীতিতে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রক্ষেপণ বলছে, থাইল্যান্ডে চলতি বছর অর্থনৈতিক সংকোচন হতে পারে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। অন্যদিকে দেশটির বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংকের প্রক্ষেপণ আরো ভয়াবহ। ওইসব ব্যাংকের মতে, চলতি বছর প্রায় ৮ শতাংশের মতো সংকুচিত হতে পারে দেশটির অর্থনীতি।
এছাড়া অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে যদি আগামী ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে পর্যটনের ভরা মৌসুম শুরুর আগেই দেশটির পর্যটন খাতকে পুনরুদ্ধার করা না যায়। এরই মধ্যে অর্থনীতির ভঙ্গুর দশা কাটাতে দেশটির সরকার ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি থাই বাথের (৫ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ) প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এছাড়া মূল্য সংকোচনের চাপ কমাতে থাই বাথের বিনিময় হার হ্রাসের পদক্ষেপ নিয়েছে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সার্বিক পরিস্থিতি মিলিয়ে লকডাউন শিথিল করার বিষয়ে শুরু থেকেই ব্যাপক চাপের মুখে ছিল থাইল্যান্ড সরকার। যদিও এসব চাপ উপেক্ষা করে বর্তমানে ধাপে ধাপে লকডাউন শিথিল করছে ব্যাংকক।
এ লকডাউন শিথিল কার্যক্রমের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো এটিকে এমনভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে; যাতে তা বর্ষা মৌসুমের স্বাস্থ্য পরিস্থিতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ থাকে। মারাত্মক গরম থেকে আর্দ্রতর আবহাওয়ায় রূপান্তরের কারণে বর্ষাকালে দেশটির মানুষের মধ্যে এমনিতেই সর্দি ও ফ্লুয়ের প্রকোপ দেখা দেয়। মৌসুমি আবহাওয়ার সঙ্গে সংগতি রেখে লকডাউন শিথিলের কার্যক্রম হাতে নেয়ার এটিই একমাত্র কারণ।
(এশিয়া টাইমস, ব্যাংকক পোস্ট ও রয়টার্স অবলম্বনে)