মার্কেন্টাইল ব্যাংক স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে

মো. কামরুল ইসলাম চৌধুরী এক বছরের বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করছেন মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পদে। প্রায় ২০ বছর ধরে ব্যাংকটির বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। সম্প্রতি ২১ বছরে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের অর্জন, দেশের ব্যাংকিং খাতের গতিপ্রকৃতিসহ নানা বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাছান আদনান

২১ পেরিয়ে মার্কেন্টাইল ব্যাংক আজ ২২তম বর্ষে পদার্পণ করল। দীর্ঘ পথচলায় আপনাদের অর্জন সম্পর্কে বলুন।

১৯৯৯ সালের জুন দেশের তৃতীয় প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের যাত্রা। সেই থেকে দেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষের আর্থিক লেনদেন সহজতর করার জন্য ব্যাংক নিরলসভাবে কাজ করেছে। সাফল্যে গর্বের সঙ্গেই পার করেছে একে একে ২১টি বছর। বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ। তীব্র প্রতিযোগিতা সত্ত্বেও গত ২১ বছরে মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেডের সাফল্য ঈর্ষণীয়। আমাদের ব্যাংকের অবস্থান সমসাময়িক অন্যান্য ব্যাংকের তুলনায় অনেক সুদৃঢ়। 

যে কয়টি সূচকে দৃঢ় অবস্থান থাকলে একটি ব্যাংককে আদর্শ ব্যাংক বলা যায়, তার সবকয়টি সূচকেই মার্কেন্টাইল ব্যাংকের শক্ত অবস্থান রয়েছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের কাছে জনগণের ২৫ হাজার ২৩৮ কোটি টাকার আমানত গচ্ছিত ছিল। আমানতের অর্থের মধ্যে ২৩ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা আমরা গ্রাহকদের মধ্যে ঋণ হিসেবে বিতরণ করেছি। মানসম্মত ঋণ দেয়ায় আমাদের বিনিয়োগ সুরক্ষিত আছে।

মার্কেন্টাইল ব্যাংক দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের গর্বিত অংশীদার। গত বছর ব্যাংকের মাধ্যমে ১৮ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকার আমদানি হয়েছে। একই সময়ে আমাদের ব্যাংকের মাধ্যমে রফতানি হয়েছে ১৬ হাজার ৩১৫ কোটি টাকার পণ্য। আমরা গত বছর হাজার ৫২৩ কোটি টাকার রেমিট্যান্স দেশে এনেছি। দেশে থাকা স্বজনদের কাছে অর্থ পাঠানোর জন্য প্রবাসীরা মার্কেন্টাইল ব্যাংককে নিরাপদ মাধ্যম ভাবছে। ২০১৯ সালে ব্যাংক ৭৫৩ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা অর্জন করেছে। আমি আশাবাদী আগামী দিনগুলোতেও ব্যাংকের প্রতিটি আর্থিক সূচক ধারাবাহিক উন্নতি করবে।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীকে সামনে রেখে প্রতি বছরই আপনারা বৈচিত্র্যপূর্ণ কর্মসূচি পালন করেন। এবার কী কর্মসূচি নিচ্ছেন?

প্রতি বছর ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের আমরা সম্মাননা প্রদান করি। এছাড়া তরুণ ব্যাংকারদের উৎসাহিত করতে আমরা এমবিএল ইয়াং ব্যাংকার্স এপ্রিসিয়েশন অ্যাওয়ার্ড নামে একটি প্রতিযোগিতারও আয়োজন করি। গত কয়েক বছরে ব্যাংকারদের মাঝে অ্যাওয়ার্ড বিপুল সাড়া ফেলেছে। কিন্তু বছর বিশ্বব্যাপী প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে মার্কেন্টাইল ব্যাংক সম্মাননা-২০২০ এমবিএল ইয়াং ব্যাংকার্স অ্যাপ্রিসিয়েশন অ্যাওয়ার্ড-২০২০ আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপনের জন্য বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি নেয়া হয়েছে।

বিশ্বব্যাপী তাণ্ডব চালানো নভেল করোনাভাইরাস আমাদের প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিংয়ের গুরুত্ব বুঝিয়েছে। মানুষ এখন ঘরে বসেই লেনদেন করতে চায়। এক্ষেত্রে আপনাদের প্রস্তুতি কী?

মার্কেন্টাইল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ব্যাংকিং সেবায় প্রযুক্তির সমন্বয় করে চলেছে। সর্বাধুনিক বিভিন্ন ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা আগে থেকেই চালু থাকায় করোনা বিপর্যয়ের সময়ে আমরা সুফল পেয়েছি। আমাদের গ্রাহকরা ঘরে বসেই ব্যাংকের লেনদেন করতে পেরেছেন। গ্রাহকদের সর্বাধুনিক সেবা প্রদানে মার্কেন্টাইল ব্যাংক সর্বদা সচেষ্ট। সেবার আধুনিকায়নে প্রযুক্তির ব্যবহার অপরিহার্য। লক্ষ্যে ব্যাংক তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নিয়মিত বিনিয়োগ করে যাচ্ছে। দুর্যোগের সময় মানুষ যাতে ঘরে বসে অনলাইন ব্যাংকিং সুবিধা গ্রহণ করতে পারে, সেজন্য আমাদের রয়েছে অনলাইন রিলে টাইম ব্যাংকিং সুবিধা। মাই ক্যাশ নামে আমাদের নিজস্ব একটি মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস রয়েছে। সেবার মাধ্যমে গ্রাহকরা তার হাতে থাকা মোবাইল সেটকে ব্যাংক হিসাবের মতো ব্যবহার করে অর্থ লেনদেন করতে পারেন। এরই মধ্যে আমাদের সেবা জনসাধারণের মাঝে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে এবং এর গ্রাহক দিন দিন বাড়ছে। গ্রাহকদের নগদ উত্তোলন জমা সহজতর করতে আমরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ১৮১টি এটিএম বুথ ২০টি ক্যাশ ডিপোজিট মেশিন চালু করেছি।

মার্কেন্টাইল ব্যাংক এসএমই খাতে নতুন করে ঋণ বিতরণ বৃদ্ধি করছিল। আগের সেই অবস্থান কি ঠিক থাকবে?

এসএমই খাত নিঃসন্দেহে জিডিপির ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধির অন্যতম অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। দেশের মোট শ্রমবাজারের প্রায় ৮০ শতাংশ এসএমই খাতে নিয়োজিত। দেশের অর্থনীতিতে এসএমই খাতের গুরুত্বপূর্ণ অবদান অনুধাবন করে, মার্কেন্টাইল ব্যাংক শুরু থেকেই খাতে ঋণ প্রদানে অগ্রাধিকার দিয়ে এসেছে। ভবিষ্যতেও আমরা এসএমই খাতকেই প্রাধান্য দেব।

সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে ব্যাংকগুলোর জন্য কোনো চ্যালেঞ্জ দেখছেন কি?

নভেল করোনাভাইরাসের মহামারী বিশ্ব অর্থনীতিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এমনকি বাংলাদেশও এর বাইরে থাকবে না। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা দেবে নভেল করোনাভাইরাস। আমি বিশ্বাস করি, সবার সম্মিলিত উদ্যোগে ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করতে আমরা সক্ষম হব।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এপ্রিল মে মাসের সুদ স্থগিত, আগামী জুন পর্যন্ত কিস্তি না দিলেও খেলাপি না করার নির্দেশনা এবং লভ্যাংশ ঘোষণার সীমা বেঁধে দিয়েছে। এসব উদ্যোগকে কীভাবে দেখেন?

দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাকে আমি যথার্থই মনে করি। স্থগিতকৃত সুদের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। খেলাপি না করার নির্দেশনার ফলে অনেক সামর্থ্যবান গ্রাহকও ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ করছেন না। গ্রাহকদের উদ্দেশে আমি বলব, ব্যাংকের সুদ বাড়িয়ে লাভ নেই। এখন না দিলে ভবিষ্যতের জন্য আপনাদের বোঝা বাড়বে। এজন্য চেষ্টা করা উচিত সাধ্য অনুযায়ী ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করে দেয়া। ব্যাংক বাঁচলে অর্থনীতিও বাঁচবে। ব্যাংক দুর্বল হয়ে গেলে, অর্থনীতির দুর্যোগ বহু গুণ বাড়বে।

বছরের শুরুতে নিশ্চয় একটা কর্মপরিকল্পনা ঠিক করে এগোচ্ছিলেন। নভেল করোনাভাইরাসের কারণে সেসব ক্ষেত্রে কী ধরনের পরিবর্তন আনতে হচ্ছে?

নভেল করোনাভাইরাসের কারণে আমরা আমাদের কর্মপরিকল্পনা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী পরিবর্তন করব। তবে আমাদের লক্ষ্য হলো করপোরেট সুশাসন নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেনে শৃঙ্খলা বজায় রাখা, ঋণ বহুমুখীকরণের মাধ্যমে ঝুঁকি তথা খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনা। কৃষি এবং ক্ষুদ্র মাঝারি উদ্যোক্তাদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা হবে। প্রযুক্তির সর্বোচ্চ এবং সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে পরিচালন ব্যয় ঝুঁকি হ্রাস করে আমরা ব্যাংকের ভিত সুদৃঢ় করতে চাই। একই সঙ্গে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারদের সর্বোচ্চ প্রতিদানও দিতে চাই।

কভিড-১৯-এর প্রভাবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কোন খাতকে অগ্রাধিকার দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে?

করোনা পরিস্থিতি আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার দুর্বলতার দিকটিই সবার সামনে এনেছে। দেশের অনেক মানুষই বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন বলে প্রতিনিয়ত আমরা শুনতে পাচ্ছি। পরিস্থিতিতে ব্যাংকের বিনিয়োগে আমরা স্বাস্থ্য খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে চাই। বিদ্যমান হাসপাতালগুলো সম্প্রসারণ আধুনিকায়নে ঋণ প্রস্তাব এলে আমরা সবার আগে সেই ঋণ অনুমোদন দেব। একই সঙ্গে নতুন হাসপাতাল নির্মাণের যেকোনো উদ্যোগে আমরা বিনিয়োগকারীদের ঋণ দিয়ে পাশে থাকতে চাই।

মার্কেন্টাইল ব্যাংক হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে বলে জেনেছি। উদ্যোগ বাস্তবায়নে কতদূর এগোলেন?

উত্তরায় আমরা সর্বাধুনিক একটি হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি। সরকার থেকে আমরা জায়গাও বরাদ্দ পেয়েছি। দ্রুততম সময়ে হাসপাতাল নির্মাণের কাজ শুরু হবে। আশা করছি, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের নির্মিত হাসপাতাল দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে নতুন পথ দেখাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন