পঙ্গপালের কবলে ভারতে অন্তত ৫০ হাজার হেক্টর কৃষিজমি

রবিশস্যের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা

বণিক বার্তা ডেস্ক

নভেল করোনাভাইরাসের মহামরীতে এমনিতেই বৈশ্বিক কৃষি খাতের নড়বড়ে অবস্থা। তারপর আবার নতুন আতঙ্কে পরিণত হয়েছে মরু পঙ্গপাল। গত বছরে আফ্রিকার কয়েকটি দেশের কৃষি খাতে মারাত্মক ক্ষতি করেছে এরা। চলতি বছরও তাণ্ডব থামেনি। আফ্রিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে পাকিস্তান এবং সর্বশেষ ভারতে হানা দিয়েছে বিশাল ঝাঁকবদ্ধ পতঙ্গ। এরই মধ্যে ভারতের ব্যাপক এলাকাজুড়ে পঙ্গপালের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ পঙ্গপাল আক্রমণের শিকার হতে পারে, এমন প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে ভারত।

২০১৯ সালে ভারতের গুজরাট রাজস্থানে অল্পবিস্তর পঙ্গাপাল আক্রমণের ঘটনা ঘটেছিল। তবে চলতি বছরের শেষ নাগাদ পরিস্থিতি প্রকট আকার ধারণ করতে পারে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। গত ফেব্রুয়ারিতে তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ আক্রমণের শিকার হয় পাকিস্তান। এরপর সিন্ধু প্রদেশ হয়ে গত ১১ এপ্রিল ভারতে ঢুকে পড়ে বিধ্বংসী পতঙ্গের দল। রাজস্থানের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে শুরু হয় পঙ্গপালের আক্রমন। এরপর পার্শ্ববর্তী রাজ্য মধ্যপ্রদেশে হানা দেয় এরা। মে মাসের শেষ নাগাদ ভারতের রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ বাদেও গুজরাট, মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব, হরিয়ানা উত্তর প্রদেশে পঙ্গপাল প্রাদুর্ভাবের খবর পাওয়া গেছে।

ভারতের পঙ্গপাল সতর্কীকরণ সংস্থার (এলডব্লিউও) তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে সর্বশেষ ২০১০ সালে বড় আকারে পঙ্গপাল আক্রমণের ঘটনা ঘটেছিল। ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৯৭ সালের মধ্যে মোট ১৩টি পঙ্গপাল বিপর্যয় ঘটেছে দেশটিতে। ১৯৯৭ থেকে ২০১০ পর্যন্ত মোট পাঁচটি প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে ভারত। এর পর থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশটিতে কোনো বড় ধরনের পতঙ্গেও ঝাঁক বা প্রজননের ঘটনা ঘটেনি। তবে ২০১৯ সালে এসে দেশটির গুজরাট রাজস্থানে পঙ্গপালের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ওই সময়ে অঞ্চলের সাড়ে তিন লাখ হেক্টর জমির জিরা, রাই সরিষার ব্যাপক ক্ষতি করে দলটি, যা ছিল ১৯৯৩ সালের পর ভারতে পঙ্গপালের সবচেয়ে ভয়াবহ আক্রমণ।


আন্তর্জাতিক মহলে পঙ্গপাল মূলত লোকাস্ট নামে পরিচিত। এটি এক ধরনের ঘাসফড়িং। ইঞ্চি খানেক দৈর্ঘ্যের নিরীহ পতঙ্গটি স্বভাবগতভাবে একা থাকতে পছন্দ করে। তবে বিশেষ কারণে এরা স্বপ্রজাতির সঙ্গে দলবদ্ধ হয়ে বিশাল ঝাঁকে পরিণত হয়। একেক ঝাঁকে সাধারণত কয়েক লাখ থেকে এক হাজার কোটি পতঙ্গ থাকতে পারে। তখন এটি আর কোনো সাধারণ বা নিরীহ পোকা থাকে না। হয়ে ওঠে বিধ্বংসী পঙ্গপালে। জাতিসংঘের বিশেষায়িত খাদ্য কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, একটি প্রাপ্তবয়স্ক পতঙ্গ দৈনিক দুই গ্রাম শস্য খেতে পারে, যা তার নিজের ওজনের সমান। এক বর্গকিলোমিটার এলাকাব্যাপী পঙ্গপাল যে পরিমাণ খাবার খায়, তা দিয়ে ৩৫ হাজার মানুষকে এক বছর খাওয়ানো সম্ভব।

পঙ্গপাল মূলত আধা মরুভূমি বা আধা শুষ্ক আবহাওয়ায় টিকে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে অকাল দীর্ঘস্থায়ী বৃষ্টিপাত এবং ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঘটনা এদের বংশ বিস্তারের পক্ষে কাজ করছে। গত বছর ভারত মহাসাগরীয় ডিপোল, যা সাধারণত ভারতীয় নিনো নামে পরিচিত এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল যে জুনের দিকে প্রচণ্ড দাবদাহের উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলেছিল। এর প্রভাবে গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে শুরু হয় প্রবল বৃষ্টিপাত, যা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে এক মাস বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল।

গত বছর বৃষ্টিপাতে এক দশকের রেকর্ড ছাড়িয়ে যায় ভারত। বর্ধিত বৃষ্টিপাত পশ্চিম এশিয়া, ওমান, ইয়েমেন হর্ন অব আফ্রিকা বা ইথিওপিয়া, সোমালিয়া, কেনিয়ার বেশ কয়েকটি অংশে ছড়িয়ে পড়ে। অতিবৃষ্টির কারণে মরু অঞ্চলের শুষ্ক বালি আর্দ্র হয়ে ওঠে, যা মরু পঙ্গপালের ব্যাপক বংশবিস্তারে সাহায্য করেছে। গত বছর আফ্রিকার দেশগুলোয় পঙ্গপালের প্রাদুর্ভাব বাড়তে শুরু করে। এরপর অনুকূল বাতাসের জেরে এরা ঝাঁকবদ্ধ হয়ে উড়ে ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ভারতে ছড়িয়ে পড়ে এবং বংশবৃদ্ধি করতে শুরু করে।

এফএও সম্প্রতি পঙ্গপালের বংশবৃদ্ধির বিষয়ে সতর্কতা জারি করেছে। সোমালিয়া ইথিওপিয়ায় এবার কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় পঙ্গপাল বিপর্যের মুখোমুখি হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা দেয় সোমালিয়া। বছরের এপ্রিলে দ্বিতীয়বারের মতো জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা দেয় পাকিস্তান।

এদিকে বছর ভারতে তুলনামূলক হালকা গ্রীষ্মকাল বিরাজ করছে। দেশটির উত্তর পশ্চিমাংশে মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে কয়েক দফা বৃষ্টিপাত হয়ে গেছে। ধরনের আবহাওয়া পতঙ্গটির বংশবৃদ্ধিতে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে পারে। এরই মধ্যে দেশটির রাজস্থান মধ্যপ্রদেশের ৫০ হাজার হেক্টর জমিজুড়ে পঙ্গপালের প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে। ভারতে সাধারণত পঙ্গপালের মৌসুম চলে জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত। এদিকে সময়টাতে দেশটিতে খরিফ শস্যের মৌসুম চলে। খরিফ শস্যের মধ্যে ভারতে ধান, ভুট্টা, জোয়ার, বাজরা, তুলা, আখ, চীনাবাদাম, ডাল প্রভৃতি উৎপাদন হয়। ফলে চলতি বর্ষায় পতঙ্গের বংশ বিস্তার আরো বেড়ে গেলে দেশটির কৃষি খাতের জন্য তা মারত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

এলডব্লিউওর ডেপুটি ডিরেক্টর কেএল গুলজার বলেন, পাকিস্তান থেকে এবার ভারতে যে পঙ্গাপাল এসেছে, তার বেশির ভাগ অপরিণত। খাবারের সন্ধানে জন্মের ১০-১৫ দিন পরই ভারতে প্রবেশ করেছে এরা। ফলে পতঙ্গগুলো পূর্ণতার জন্য অনেক সময় পাবে এবং বংশবৃদ্ধি করবে। এরা বর্ষা শুরু হওয়ার পর ডিম পাড়া শুরু করবে এবং আরো দুই মাস ধরে প্রজনন চালিয়ে যাবে। এরপর খরিফ ফসল বৃদ্ধির সময়ে নতুন পোকার জন্ম হবে। ফলে ফসলের ক্ষয়ক্ষতির জন্য দীর্ঘ সময় পাবে এরা। বিশাল বাহিনী নতুন করে প্রজনন শুরু করলে তা ভারতের জন্য অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠবে বলে জানান তিনি।

ভারতের কৃষি বিভাগের মতে, চলতি বছর রাজ্যগুলোয় রাবি ফসল সংগ্রহ শেষ হয়ে গেছে এবং খরিফ বপনের মৌসুম এখনো শুরু হয়নি। ফলে পঙ্গপাল এখনো কৃষির তেমন কোনো ক্ষতি করে উঠতে পারেনি। তবে এরা গবাদিপশুর চারণভূমি ধ্বংস করে দিচ্ছে, যা খরাপ্রবণ জেলাগুলোয় গবাদিপশু পালনকারীদের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে।

এদিকে পঙ্গপাল দমনে মাঠে নেমে পড়েছে এলডব্লিউও। প্রতিষ্ঠানটি পঙ্গপাল আক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে রাজ্যগুলোয় ম্যালাথিয়ন ৯৬ ক্লোরপাইরিফস কীটনাশক স্প্রে করছে। তবে উভয় কীটনাশকই মানবশরীর পরিবেশের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। এর প্রভাবে মানুষের বমি বমি ভাব, মাথা ঘোরাসহ মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়া পরিবেশের ভারসাম্য পরিবর্তন করে মাটির উর্বরা শক্তি কমিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে দুটি কীটনাশকই। এলডব্লিউওর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিশাল আয়তনের মরু পঙ্গপালের আক্রমণ ঠেকাতে দুর্ভাগ্যক্রমে রাসায়নিক কীটনাশক স্প্রে করা ছাড়া তেমন কোনো কার্যকর পদ্ধতি নেই।

সম্প্রতি ভারতের কৃষি বিভাগ রাজস্থানের জয়পুর জেলার সামোদ অঞ্চলে পঙ্গপালে দমনে পরীক্ষামূলকভাবে একটি ড্রোনের মাধ্যমে কীটনাশক স্প্রে করেছে। ড্রোনটি ১৫ মিনিটের একটি ফ্লাইটে আড়াই একর জমিতে রাসায়নিক ছিটিয়ে দেয়ার কাজে ব্যবহার হয়েছে।

দ্য হিন্দুন্তান টাইমস, বিজনেস লাইন ইন্ডিয়া টুডে অবলম্বনে

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন